অধ্যায়২
সিদ্ধান্তঃ ভারতীয় জ্ঞানের পুনর্বিন্যাস
ভারতীয় ভূখণ্ড জয়ে নতুন এক বিপুল বিশাল জ্ঞানভাণ্ডারের দ্বার উন্মুক্ত হল
ব্রিটিশদের কাছে, যেটা তারা নিজের জ্ঞানচর্চার আঙ্গিকের মাধ্যমে ভাবতে এবং বুঝতে
চেষ্টা করছিল। অষ্টাদশ শতের শেষের আর উনবিংশ শতের শুরুর সময়ের শিক্ষিত ব্রিটিশারেরা
বাস্তবজীবনের নানান ঘটনা, অভজ্ঞিতা তাদের অনুভূতি আর জ্ঞানের মাধ্যমে নথিকরণ
করছিলেন। মোটামুটি তাদের বিশ্বাস ছিল, এই বিশ্বটা স্বর্গীয় ইচ্ছায় সৃষ্টি হয়েছে, ভুয়োদর্শনীয়
গবেষনার মাধ্যমে বিশ্বকে জানা যায়, মৌলিক গঠনশীল অনুভূতি মার্ফৎ বিশ্ব শাসনের প্রাকৃতিক
সূত্রগুলি উন্মোচিত হবে। জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে তারা শুধু যে বিজীতভূমিতে প্রবেশ
করল তাই নয়, তারা তাদের জ্ঞানচর্চার মাধ্যমে এই নতুন বিশ্বের জ্ঞানচর্চাতেও প্রভাব
ফেলল। ব্রিটিশেরা বিশ্বাস করত, তারা এই ক্ষেত্রটি শুধুই অনুবাদ কর্মের মাধ্যমে
বিশ্লেষণ এবং দখল করতে পারবে; আলাপ আলোচনার মাধ্যমেই এই অজানা এবং কিম্ভুতকিমাকার
এলাকাটিকে জানা যেতে পারে।
একসময় ব্রিটিশদের মনে হতে শুরু করল, তারা নিজেদের তৈরি যে চেনাশোনা ফ্রেম অব
রেফারেন্সের মাধ্যমে এই কিম্ভুতকিমাকার এলাকাটিকে নানান মার্কায় দেগে দিয়েছে, সেই
মার্কাগুলি বিশ্লেষণের মাধ্যমে, একে জানার কাজটা তুড়ি মেরে যত শীঘ্র সম্ভব সম্পন্ন
করে ফেলতে পারবে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, এই যুক্তিতে ব্রাহ্মণ হল পুরোহিত/প্রিস্ট
এবং অমরসিংহের কোষকে চিহ্নিত করা হল ডিক্সনারি অব স্যাংসকৃট ল্যাঙ্গুয়েজ হিসেবে। যেহেতু
প্রত্যেক ভাষার ব্যকরণ রয়েছে, ভারতীয় ভাষাগুলির টিপ্পনিকে সাহেবেরা ব্যবহার করল
সাম্রাজ্যের হুকুম জারি আর তথ্যসংগ্রহের হাতিয়ারের সূত্র হিসেবে। এই কাজে তারা
বিপুল সংখ্যক ভারতীয় জ্ঞানচর্চা সম্বন্ধে অসাধারণ জ্ঞানী আর দক্ষ দেশি দক্ষ,
জ্ঞানী, প্রজ্ঞাসম্পন্ন পথনির্দেশক, সাহায্যকারী এবং সহায়ক পেল এবং তাদের ব্যবহার
করল; এরা ভারতীয় জ্ঞানকে সূত্রায়িত, বিশ্লেষিত এবং প্রবাহিত করে পৌঁছে দিল নতুন
শাসকের জ্ঞান ভাণ্ডারে। প্রথম প্রজন্মের ভিক্টোরিয় জ্ঞানীরা তাদের লক্ষ্যকে
বৈজ্ঞানিক এবং ঐতিহাসিক বললেও, জোন্স, উলকিনস, এলিস ইত্যাদিরা ভারতকে একটি নজির
হিসেবে ব্যহার করে, অতীত খোঁড়া যায়, এমন একটা জ্ঞানচর্চায় ঢুকলেন, যেখানে তারা আগের
সাম্রাজ্যের ইতিহাসগুলিকে, প্রথা, ইত্যাদিকে যেন খোলা পাতার মত করে পেয়ে গেলেন।
১৭৮৫ সালে ল্যাটিন গ্রিক আর সংস্কৃতর মধ্যে সম্পর্কের কথা বলতে গিয়ে মূলত
জার্মান তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বের জ্ঞানীদের লেখা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন, যা
তাঁকে তুলনামূলক আইনতত্ত্ব, ধর্মতত্ত্ব এবং সমাজতত্ত্ব বোঝার কাজে এগিয়ে দিয়েছিল।
মধ্য উনবিংশ শতকেই তুলনামূলক নামক উপসর্গওয়ালা জ্ঞানচর্চার সাধারণীকরণ সম্পন্ন হল।
এটা আদতে অষ্টাদশ শতকের জ্ঞানচর্চার পদ্ধতির নকল আর বিস্তৃতিমাত্র। ইওরোপ যে প্রায়
সব কিছু জ্ঞানচর্চার শুরুটা খুঁজতে চেষ্টা করছিল, এই তুলনামূলক উপসর্গওয়ালা
জ্ঞানচর্চা তাকে সেই দিকে যাওয়ার ধাক্কাটা দিল। সাহিত্যিক এবং ভাষার আঙ্গিকের কুড়
খোঁজার জন্যে টেক্সটগুলির একত্রীকরণের পদ্ধতিটি(কোলেশন) ব্যবহার করা হল, যার
মাধ্যমে একটা সরলরৈখিক কালপঞ্জী পাওয়া যেতে পারে। টেক্সচুয়াল রিকন্সট্রাকশনেরমত
গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতিকে ইওরোপিয়রা ব্যবহার করল নথি, দলিল এবং টেক্সটগুলিকে
প্রতিষ্ঠা করে তাদের মত করে ‘শুদ্ধ’ ‘সত্যিকারের’ ইতিহাস নির্মানের। এবারে তারা
কোমর বেঁধে আবাল ভারতীয়দের একটা বিপুল বিশাল জ্ঞানচর্চা উপহার দিতে উদ্যত হল, যা
সে কাউকে কোনদিন দেয় নি, যা নাকি ভারতে কোনদিন ছিল না, সেটা হল ইতিহাস।
No comments:
Post a Comment