অধ্যায় ৩
আইন এবং ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র
হেস্টিংস এবং পরম্পরার কর্তৃত্ব এবং শাসনের নতুন সংজ্ঞা
তার উদ্দেশ্যপূরণে হেস্টিংস ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কিছু যুবা আমলাকে ভারতের
ধ্রুপদী ফারসি, আরবি আর সংস্কৃত ভাষা শিখতে প্রণোদিত করেন। এটি এমন একটি জ্ঞানচর্চা
এবং প্রায়োগিক পদক্ষেপ উদ্যোগ, যার মাধ্যমে যে জ্ঞান সৃষ্টি হল সেটি ভারত সমাজ
নিয়ন্ত্রণে ব্যবহৃত হবে। ভারত বলতে ব্রিটিশেরা যে ভৌগোলিক এলাকাটি বুঝত, হেস্টিংস
সেটির সংজ্ঞা নির্নয় করলেন এবং একটি আইন নির্ভর শাসন ব্যবস্থা তৈরি করার দিকে
এগোলেন, যাকে মনে হবে যেন দেশিয় শাসন ব্যবস্থার মূর্ত রূপ। এই শাসন ব্যবস্থা
ব্রিটিশেরাই পরিচালন করত এবং একই সঙ্গে যোগ হল ব্রিটিশ ন্যায় দানের ধারণা আর সঠিক
শৃঙ্খলা, বৈচিত্রের নানান আঙ্গিক, এবং শাসক আর শাসিতের সম্পর্কের মধ্যে থাকা একটি
মধ্যস্থতা। তাঁর এক জীবনীকার লিখছেন, হেস্টিংস ভারতের প্রাচীনতাকে নব্য ব্রিটিশ
ধারণা এবং মানদণ্ডে যুক্ত করলেন। তাকে এমন একটা ব্যবস্থা তৈরি করতে হল যেখানে
ব্রিটিশ আমলারা কাজ করতে পারে এবং ব্রিটিশ মত আর পথানুযায়ী পূর্বের দেশের শাসন
ব্যবস্থাকে চালানো যায়।
এই দায়িত্বে শেষ হতে না হতেই ব্রিটিশ কর্তারা তাকে আরও কিছু গুরু দায়িত্ব চাপিয়ে
দিলেন, ভারতীয় প্রশাসনকে নিয়মিত রাজস্ব আদায় করলেই হবে না, প্রশাসনের খরচখরচা বাদ
দিয়ে কোম্পানির অংশিদারদের লভ্যাংশ ফেরত দিতে হবে। ভারতে কোম্পানির ইতিহাস জুড়ে সব
থেকে বড় প্রশাসনিক দক্ষতা হিসেবে চিহ্নিত হত নিরুপিত বাৎসরিক রাজস্বের পুরোটা আদায়
করা। প্রশাসন চালানোর ব্রিটিশ যুক্তিটা কিছু পূর্ব নির্ধারিত ধারণায় নিবদ্ধ ছিল।
যদি কোন কৃষক তার উচ্চতর কর্তৃপক্ষ, যার জমিতে অধিকার আছে, তাকে বস্তুতে বা অর্থে দেয়
দেয়, তাহলে সেটাকে ব্রিটিশ যুক্তিতে বলা হবে খাজনা এবং যে এই খাজনাটি গ্রহণ করছে তাকে জমিদার বলতে হবে এবং যিনি খাজনাদেন
তিনি ভাড়াটিয়া। গ্রহীতা যদি রাজনৈতিক ভূমিকা পালন করে, সেনা বাহিনী পোষে,
নিরাপত্তা দেয়, ধর্মীয় সঙ্গঠনের পৃষ্ঠপোষকতা করে, সার্বভৌমত্বের নানান ইঙ্গিত বহন
করে তাহলে এই দেয়টি খাজনা নামে অভিহিত হবে আর দাতা গ্রহীতার মধ্যে সম্পর্কটি শাসক
আর শাসিতের হবে।
হেস্টিংসের কালেক্টরেরা তাদের রাজস্ব আদায়ের প্রশাসনিক কাজ ছাড়াও দুটি আদালত
চালানোর ভার পেল। প্রথমটি ধারণাটি হেস্টিংস ধার করেছিলেন মুঘল প্রশাসনিক বিভাগ
থেকে – যাকে মুঘলেরা দেওয়ানি আদালত বলত, এখানেও কালেক্টরেরা রাজস্ব আর দেওয়ানি
বিবাদ দুটোই সামাল দেবেন ঠিক হল। অন্যটি ফৌজদারি আদালতে বসা এবং শান্তিশৃঙ্খলা
রক্ষা করা। দেওয়ানি আদালতে হিন্দুদের জন্য হিন্দু আইন আর মুসলমান প্রজাদের জন্য
মুসলমান আইন বরাদ্দ হল। ফৌজদারি আদালতে মুসলমান আইন কার্কর হবে ঠিক হল; দেওয়ানি
আদালতে কালেক্টির তার সহযোগী দেওয়ানকে সঙ্গে নিয়ে বসতেন। বাদী বিবাদীরা আদালতে
সাক্ষ্যপ্রমান জমা দিত, সেই সাক্ষ্য প্রমান অনুযায়ী সাজা হত। দেওয়ান এবং একজন
হিন্দু আইন আধিকারিক (পণ্ডিত) কোন মামলায় কোন আইন কার্যকর হবে সেটি কালেক্টরকে জানাতেন।
যদি মামলাটা মুসলমান সমাজ সংক্রান্ত হয়, তাহলে মুসলমান আইন আধিকারিক(মৌলভি)
কালেক্টরকে বিচারপ্রক্রিয়ায় সাহায্য করতেন। এটা সর্বজনগ্রাহ্য ছিল যে দুই পরম্পরায়
আলাদা আলাদা আইন এবং বিধান ছিল এবং এই আইন ব্যখ্যা করতেন ব্রিটিশদের ভাষায় ল’ প্রফেসরেরা।
ভারতীয় আইনে অতিগুরুত্ব দিয়ে হেস্টিংস একটা বিষয় প্রমান করলেন পূর্বতন অব্রিটিশ
শাসকেরা স্বৈরাচারী ছিল না।
No comments:
Post a Comment