হাওড়া
উদয়নারায়ণপুরের মাদুর
উদায়নারায়ণপুর আর আমতা অঞ্চলে জোড়া মাদুর তৈরি হয়। মাদুর বোনার সময় দুটি মাদুরকাঠি নিয়ে একটি টানার অর্ধেক বোনার পর অপর কাঠি বুনে টানার শেষ পর্যন্ত নিতে হয়। প্রথম কাঠির ডগা ধার বাঁধার মত রেখে গোড়া যেখানে শেষ হয়, সেখানে টানার নিচে ঢুকিয়ে দিতে হয়। তাই মাঝখানে জোড়া মাদুরের আয়তন বেশ বড় হয়। সাধারনের চোখে বোঝা না গেলেও তবে নজর করে মাঝখানটা হাত দিলে একটু মোটাই লাগে।
দার্জিলিং
নকশালবাড়ির কাঠের কাজ
বিশ্বায়নের আগের সময়ে, অন্তত নয়ের দশকের প্রথম পর্যন্ত,
বাংলায় বিদেশি দ্রব্য, মেড ইন বিদেশ লেবেল ফেলে-ছড়িয়ে পাওয়া যেত না কলাকাতার
খিদিরপুর আর শিলিগুড়ির ফ্যান্সি বাজার ছাড়া; এর বাইরে শস্তায় বিদেশে গিয়ে বাঙালি চাকুরিজীবি
মধ্যবিত্ত যে শহরে আকছার ফোরেন গুডস কিনত সেটি ছিল ভারত-নেপাল সীমান্ত শহর
ধুলাবাড়ি। আটের দশকের শেষের দিকে বন্ধু আনিন্দ্যর বাবা কাজ করতেন শিলিগুড়িতে। তাঁর
হাত ধরে একবারই গিয়েছিলাম পানিট্যাংকি হয়ে ধুলাবাড়ি। এই ধুলাবাড়ি যেতে হত শিলিগুড়ি
শহর থেকে নেপালের পথে শিলিগুড়ি-পানিট্যাংকি রাস্তায় প্রখ্যাত নকশালবাড়ি হয়ে – বাসে
যেতে যেতে চোখে পড়েছিল নকশালবাড়ি নামটি। বামপন্থী রাজনীতি করা বাবা-মায়ের বহু
বর্ণিল বন্ধু-বান্ধবই নকশাল রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন – কিন্তু তখনো জানতামও না,
ধারণাও ছিল না, নকশালবাড়ি একটি স্থান নাম। যাওয়ার সময় স্থানমাহাত্ম্যের দিব্য
দর্শন হল। চোখ ফেড়ে ফেড়ে দেখেছিলাম নকশালবাড়ি। এককালে বসন্তের বজ্রনির্ঘোষ উঠেছিল এই এলাকা থেকেই –
কিন্তু ক্রমেই বুঝতে পারছিলাম একটি ছোট সীমান্তবর্তী ছোট গঞ্জ নকশালবাড়ির সেই
মাহাত্ম্যটি ফুরিয়েছে – যেমন দেহপটসনেনটসকলিহারায়।
আজ কিন্তু নকশালবাড়ি শহরটার এসব নিয়ে যেন সত্যিই মাথা
ব্যথা নেই। যে একালার রাজনৈতিক কার্যকলাপের সঙ্গে একদা জঙ্গল সাঁওতাল, চারু মজুমদার,
কানু সান্যালের মত নামগুলো জড়িয়ে ছিল পরত্র পরতে, সেই এলাকায় পারম্পরিক হস্ত
শিল্পী সঙ্ঘের বেশ দারুন সংগঠন, কার্যকলাপ গড়ে উঠেছে বিগত কয়েক বছর ধরে। এখানে ধিমাল সনাজের সঙ্গে
তাদের নাচ গান আর কাঠের কাজের একটা সাংগঠনিক বোঝাপড়া গড়ে উঠেছে।
স্থানীয় কাঠ খোদাই শিল্পী আশু বাগচী, ভবানী বিশ্বাসসহ
বেশ কিছু মানুষ বিগত কয়েক দশক ধরে নকশালবাড়ি এলাকায় গড়ে তুলেছেন নতুন কাঠ খোদাইএর অনুপম ঐশ্বর্য আর পুরোনো খোদাই
দ্রব্য বাজারজাত করার আপ্রূপ প্রচেষ্টা। যেহেতু এই একালায় এখনও সাঁওতালসহ নানান আদিবাসী মানুষের
বসতি রয়েছে, এবং তাদের জীবনধারণের
যাত্রায় নিজস্বতার একটা বড় ভূমিকা রয়েছে, ফলে এই মানুষদের নানান সাংস্কৃতিক কাজ,
দক্ষতা ইত্যাদি কাজে লাগিয়ে তৈরি এবং বিক্রি হচ্ছে, নানান কাঠের কাজ যেগুলি আবার
অন্যদের থেকে বেশ আলাদা। যেগুলির সাংস্কৃতিক শেকড় চারিয়ে গিয়েছে এক্কেবারে দেশের,
সমাজের অভ্যন্তরে।
ছম মুখোশ
বৌদ্ধ ধর্ম প্রভাবিত মুখোশ এই এলাকার অন্যতম শিল্প। এই
মুখোশগুলির নাম ছম। এই মুখোশগুলি সাধারণত তান্ত্রিক বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাবে তৈরি হয়।
পেদংএ এই মুখোশ পরে নৃত্যও করেন বৌদ্ধ ভিক্ষুরা।
থাংকা ছবি
বৌদ্ধ ধর্মের অন্যতম প্রধান শিল্প। সুতি, রেশম বা মিশ্র
কাপড়ের ওপর বিভিন্ন বৌদ্ধ দেব মূর্তি, বৌদ্ধ জাতকের গল্পের কোনও দৃশ্য বা
তান্ত্রিক মণ্ডল আঁকা হয়। সাধারণত তেল বা এক্রেলিক দিয়ে আঁকা হয়। থাংকা ঠিকমত আঁকা
হলে বহুকাল থাকে তবে এগুলি শুকনো এলাকায় রাখতে হয়। বড় থাংকাকে জড়ানো পট বলে।
কুকরি
বাংলায় আন্যতম প্রধান লোহা-ইস্পাত শিল্প যাতে কখনও জং
পড়ে না। প্রায় ১০০ বছর আগে, ১৯০৮ সালে ওয়াটসন বাংলার লোহা ইস্পাত শিল্পের যে
মনোগ্রাফ রচনা করেছিলেন তাতে বিশদে কুকরি তৈরির বর্ণনা রয়েছে। কিন্তু সেই ধরণের
কুকরি তৈরির দক্ষ কারিগরের আভাবকেও তিনি চিহ্নিত করেছেন। তবে আজও যে কুক্রি পাওয়া যায়, তাঁর মানও খুব খারাপ নয়।
চা-গাছের আসবাব
চা বাগানে যখন প্রায় শতাব্দ প্রাচীন চা গাছ উপড়ে ফেলে
নতুন গাছ লাগানো হয়, তখন সেই বনসাই গাছগুলির শেকড় বেশ মোটা হয় এবং নতুন শিল্পীরা
এই গাছ ব্যবহার করে মধ্যবিত্তের বসার ঘরের কাঁচের মাথাওয়ালা নানান ধরণের আসবাব
তৈরি করছেন। এগুলির চাহিদা বেশ ভাল। দামও বেশ মাঝারি ফলে প্রথমে শিলিগুড়িতে শুরু
হলেও, এখন গোটা ডুয়ার্স জুড়ে চড়িয়ে গিয়েছে এই শিল্পটি।
হুগলি
বালিদেওয়ানগঞ্জের কাঁসা পিতল
আরামবাগ-বালিদেওয়ানগঞ্জ রাস্তায়। এখানে বেশ পুরনো কাঁসা
পিতলের কাজ হয়। এতদিন ঘটি তৈরি হত। সম্প্রতি তাঁরা কিছু কিছু নতুন জিনিস উৎপাদন
করতে শুরু করেছেন।
কলকাতা
বড়িশা, দক্ষিণ বেহালা শীলপাড়া অঞ্চলে বেশ দারুন পাটের
শৈল্পিক কাজ হয়। পাটের থলে, ঘর সাজানো নানান জিনিসপত্র, চপ্পল, জ্যাকেট, পাটের
বিনুনির থলে ইত্যাদি তৈরি করেন অন্তত কয়েক হাজার
শিল্পী।
বাগবাজার, শ্রীমানী বাজার
শাঁখের কাজ বেশ পুরোনো দিনের। বলা হয় বিষ্ণুপুরের পর
কলকাতার বাজার এবং শিল্পীর দক্ষতা।
কুমোরটুলি
উত্তর কলকাতার প্রবাদপ্রতীম এলাকা। মূলতঃ মাটির মূর্তি
বানানোর কাজে আতীব দক্ষ মানুষ জনের সমাবেশ হয়েছে এই স্থানে। মূর্তি ছারাও পাওয়া
যায় নানান ধরণের সাজ সজ্জার জিনিসপত্র – বিশেষ করে শোলার নানান জিনিস। মাটির,
শোলার, থার্মোকল, গ্লাস ফাইবার ইত্যাদির ছোট মূর্তিও পাওয়া যায়। পাশেই বাবু বাজার।
সেটিও অতীব প্রখ্যাত বাজার। মাটির নানান কাজ এই বাজারে পাওয়া যায়। উনুন তৈরির তন্দুর
এখানের সঙ্গে কুমোরটুলিতেও পাওয়া যায়।
উল্টোডাঙ্গায় বাসন্তী কলোনী
উল্টোডাঙ্গার চার নম্বর প্ল্যাটফফর্মের নিচে নেমেগেলে
খাল, তাঁর পাড়ে বিশাল মাটির নানান জিনিস তৈরির বাজার। কলকাতার আশেপাশে যে ধরণের
রেড অক্সাইড প্রলেপ লাগানো নানান জিনিস পাওয়া যায়, সেগুলি বাসন্তী কলোনীতে তৈরি
হয়। মাটির গয়না তৈরিতে বাসন্তী কলোনি প্রখ্যাত।
আলিপুরদুয়ার
বাঁশের কাজ
নতুনতম জেলা। রাজাভাতখাওয়া জঙ্গলে সাঁওতাল সম্প্রদায় বেশ
ভাল বাঁশের কাজ করেন।
(কিছু তথ্যের সূত্রঃ দীপঙ্কর ঘোষ, অঞ্জন সেন, মধুমঙ্গল
মালাকার, সোমা মুখোপাধ্যায়)