Wednesday, August 8, 2018

উপনিবেশ বিরোধী চর্চা - ছোটলোকেদের দৃষ্টিতে বিদ্যাসাগর চরিত্র

বিদ্যাসাগর মশাই বিতর্কে কতগুলো বিষয় পরিষ্কার করা দরকার-
তিনি তীক্ষ্ণাধী ছিলেন, স্মৃতিধর ছিলেন, ব্যক্তিত্ববান ছিলেন, দৃঢচেতা ছিলেন, সংস্কৃত এবং ইংরেজি উভয় ভাষায় তার অসীম দখল ছিল, তিনি একলষেঁড়ে ছিলেন, দেশাচার নিয়ে তাঁর খুব বেশি উৎসাহ ছিল না, সাহিত্যিক ছিলেন, শিল্প উদ্যমী ছিলেন, মানুষকে সাহায্য করতেন, মহিলাদের বিষয়ে তাঁর মমতা অসম্ভব ছিল এবং সেটা তিনি তাঁর বাবার থেকে পেয়েছিলেন, মিতব্যয়ী ছিলেন, তাঁর মতে আড় হয়ে দাঁড়ালে পরিবারকেও রেয়াত করতেন না, অসম্ভব পরিশ্রমী ছিলেন, অসম্ভব মজলিসি ছিলেন, মনের মানুষের সঙ্গে প্রচুর ইয়ার্কি করতেন, নিজের জীবনের চাহিদাগুলি খুব নিম্নতারে বেঁধে রাখতেন শুধু মরোক্কো চামড়ায় বই বাঁধাই ছাড়া, তিনি যেটিকে সঠিক মনে করতেন তা বাস্তবে রূপায়িত করতে নিজের জীবনও বাজি রাখতেন, ছাপাখানাটা ভালই বুঝতেন, সঙ্গে ব্যবসাতে সেযুগে মাসে ৫০০০টাকা রোজগার করতেন অথচ ভোগ বিলাস ছিল না প্রায় ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি বলেও কতগুলো কথা ছোটলোকদের পক্ষে বলা দরকার, কারণ এতদিন তাঁর যে মূল্যায়ন হয়েছে সেটি মূলত ভদ্র সমাজের করা।
১। তিনি বাংলা লিপির আবিষ্কর্তা নন। বাংলায় হাজারো লিপি শিক্ষার বই আর উদ্যমের মধ্যে বর্ণপরিচয় একটি মাধ্যম। সেটি বেশ ভাল বই। খুব খেটেছিলেন।
২। সিভিলিয়ানদের প্রাচ্য ভাষা শিক্ষার জন্য প্রতিষ্ঠিত হিন্দির স্রষ্টা, ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের হেড পণ্ডিত ছিলেন পাঁচ বছর।
৩। গত কয়েক দশকে হিন্দি থেকে আরবি ফার্সি শব্দ বাদ দেওয়ার যে কাণ্ডটা চলছে, বিদ্যাসাগর মশাই বাংলা ভাষায় এই কাজটা করে দেখান তার সময়েই, কঠিন কঠিন সংস্কৃত শব্দ ঢুকিয়ে, তার আগের দীর্ঘকালএর ভাষার বিবর্তনের স্বাভাবিক প্রকাশভঙ্গী রুদ্ধ করে। তিনি সুশীল প্রমিত গদ্যের ধারা তৈরি করে যবনী মিশেল থেকে সাহিত্যিক বাংলাকে উদ্ধার করার উদ্যম নেন।
৪। বলা দরকার তার ব্যঙ্গ লেখা - যাকে তিনি ফাজিল চালাকি বলে অভিহিত করেছেন, সেগুলি অসামান্য বাংলার নিদর্শন, কিন্তু অনেকগুলি স্বনামে লিখিত হয় নি।
৫। ১৮৪১ থেকে ১৮৪৬ সাল পর্যন্ত ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের হেড পণ্ডিত ছিলেন।এই কলেজে অধ্যাপনাকালে তিনি ইংরেজি ও হিন্দি ভাষায় মনোনিবেশ করেন।(সূত্রঃ সুবোধ চন্দ্র বোস আর অঞ্জলি সেনগুপ্ত সম্পাদিত সংসদ বাঙ্গালি চরিতাভিধান)
৬। বাংলা ব্যকরণের ওপর সংস্কৃত ব্যকরণের চামড়া পরান তিনি।
৬। এই সময় থেকেই হিন্দুদের ভাষা আর মুসলমানেদের ভাষা কার্যত আলাদা করে দেগে দেওয়া হল।
৭। তিনি এডামের সমীক্ষা তার জীবনেও ছুঁয়ে দেখেছেন এমন নিদর্শন নেই। বাংলা-বিহারের দেড় লক্ষ গ্রামে ১ লক্ষ পাঠশালা মক্তব ছিল সেগুলিতে মূলত ছোটলোকেরা পড়ত, সে বিষয়ে তাঁর কোন ভাবনা ছিল না। অথচ সাম্রাজ্য নেতা বেন্টিংকের প্রত্যক্ষ্য সাহায্যে সমীক্ষাটি হয় এবং তাঁর সময়ে এডাম বেশ প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব ছিলেন - সতী আইন প্রণয়নে তার ভূমিকা অসামান্য ছিল। এটি পরোক্ষে সরকারি সমীক্ষা, তার নিদর্শন উইলিয়ম এডাম সমীক্ষার মুখবন্ধেই পেশ করেছেন খরচের হিসেবের অনুমোদন নিয়ে। সে সময় বহু কাজ সরকারি সাহায্য, পৃষ্ঠপোষকতায় করলেও তিনি সেই গণবিদ্যালয় বিষয়ে সমীক্ষা সম্বন্ধে উদাসীন থেকেছেন।
৮। বিদ্যালয়কে সেনা ছাউনি করতে দিয়েছেন অক্লেশে সিপাহি হ্যাঙ্গামের সময়।
৯। মেকলের অশ্লীলতম প্রস্তাব বিষয়ে অন্যান্য নবজাগরণীয় সুশীলদের মত নিশ্চুপই ছিলেন। সরকারি উপাধি নিয়ে বলার নেই, কারণ রবিবাবুও স্যর উপাধিটি পাঁচ বছর ব্যবহার করেন। সরকারকে কুকি আর প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সাহায্য করার জন্যে নীলদর্পন রচয়িতা দীনবন্ধু মিত্র আর প্রফুল্ল রায়ও উপাধিটি পান। ফলে তিনি ব্যতিক্রমী নন। এটা লুঠেরা খুনি অত্যাচারী সাম্রাজ্য বন্ধুত্বের সূচক মাত্র।
১। এবং নবীন চন্দ্র সেনের বয়ানে পাই শেষ বয়সে এসে তিনি উপলব্ধি করছিলেন, যে পাঠ্যক্রম তিনি ভদ্রদের জন্যে তৈরি করেছে্ন সেটি বাংলায় বিষবৃক্ষ ফলিয়েছে। তাঁর কলকাতা ছাড়ার একটা কারণ হয়ত ঠিক সময়ে সাম্রাজ্যের নীতিগুলি উপনিবেশে প্রয়োগ করার কাজে দায়িত্বপ্রাপ্ত কলকাতার নবজাগরনীয় বাবুদের স্বার্থবুদ্ধিতে জুঝতে না পারা – আদতে উপমহাদেশে সাম্রাজ্যের উদ্দেশ্য ঠিক সময় বুঝতে না পারার হতাশা।

No comments: