কৈবর্তদের ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদের পর বৌদ্ধ কাঠমোয় রাষ্ট্র বিপুল বিনিয়োগ করার সিদ্ধান্ত নেয় - তার আগেও রাষ্ট্রীয় স্তরে বিনিয়োগ হত কিন্তু কৈবর্তদের সঙ্গে যুদ্ধের পরে বিনিয়োগের পরিমান বিশালভাবে বাড়তে থাকে। পরের কয়েক শতক বিশাল বৌদ্ধ সামাজিক কাঠামো গড়ে উঠতে থাকে পূর্বভারত জুড়ে। ভদ্ররা মঠে চাকরিবাকরি পায় - বিদেশে যায় শিক্ষা আর ধর্মপ্রচারে। এই কাঠামোয় সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ আর খুব একটা রইল না - এমনিতেই বৌদ্ধ পন্থ পুঁজি পোষিত। রাষ্ট্র এবং শ্রেষ্ঠী ব্যয় করত। বাংলার রূপা বাগদি রাজা কিন্তু বৌদ্ধ ছিল।
এর সঙ্গে যুক্ত হল আরেকটি বিষ ফোঁড়া। বৌদ্ধ প্রবজ্যার নিয়ম ছিল বৌদ্ধ কোন শ্রেষ্ঠী প্রবজ্যা নিলে তার বিপুল বিশাল সম্পত্তি পাবে বৈদ্ধ মঠ। কিন্তু অ-বৌদ্ধদের তা ছিল না। অবৌদ্ধরা সন্ন্যাস নিলে তার উত্তরাধিকারীকে সেই সম্পদ দিয়ে যেত। ফলে গোটা বৌদ্ধ মঠ ফুলে ফেঁপে উঠতে থাকে। ঐতিহাসিকভাবেই বৌদ্ধ পন্থ মোটামুটি রাজ ও শ্রেষ্ঠী পোষিত প্রথম থেকেই। যতটা বৌদ্ধদের জনগণমুখী দেখানো হয় ততটা তারা ছিল কি না আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে - নানা বৌদ্ধ সাহিত্য পড়ে এই ধারনা হয়েছে - বৌদ্ধরা জনমুখী এই ধারনাটা ঔপনিবেশিক - এবং নেহেরুর পঞ্চশীলের সময় এই ধারণা জোরদার করা হয় - গণহত্যাকারী অশোক প্রজাপালক হন ইত্যাদি। আদতে বিপুল বিনিয়োগ আসত রাজাদের আর শ্রেষ্ঠীদের থেকে। গৌতমের ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা কোন কোন শ্রেষ্ঠী ছিল দেখুন - গোটা বিশ্বে বৌদ্ধ পন্থ রাষ্ট্র আর শ্রেষ্ঠীদের মাধ্যমে ছড়িয়েছে, মূলত ব্যবসার দ্বারা।
তো যে সব বাঙালি শ্রেষ্ঠী বৌদ্ধ ছিল তারা মঠের এই প্রবজ্যা নীতির বিরুদ্ধাচরণ করতে লাগল। তাদের প্রবজ্যায় উত্তরাধিকারীরা কিস্যু পাবে না অথচ তাদের বিপুল বিশাল সম্পত্তি মঠ পাবে এটা তারা মেনে নিতে পারছিল না। নানান বণিক বৌদ্ধ পন্থ ছাড়তে শুরু করে। বেনের মেয়ে উপন্যাসে এই বিতর্কের কিছুটা আঁচ পাবেন।
রাষ্ট্র আর শ্রেষ্ঠী এই দুই বিপুল বিশাল সম্পত্তি পেয়ে জনগনের থেকে বিচ্ছিন্ন বৌদ্ধপন্থ আরও বিচ্ছিন্ন হতে শুরু করে। তারপর বৌদ্ধ প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনায় মেধার মত মধ্যবিত্তিয়-আভিজাত্যময় ইত্যাদি ধারণার একটা ঝামেলা ছিল। নালন্দায় জানি মঠগুলিতে ছেঁকে নেওয়া হত ছাত্রদের - সেখানে মোটামুটি ভদ্রবিত্তদের প্রবেশাধিকার ছিল কারণ তারা সেখানে ঢোকার জন্যে বিধিবদ্ধভাবে পড়াশোনাটা করতে পারত - ঠিক আজকে নানান মিশনে যা বাংলায় ঘটছে - পরীক্ষা নিয়ে প্রবেশ ইত্যাদি। এতে সাধারণের থেকে আরও বিচ্ছিন্নতা বাড়ে বৌদ্ধদের। শ্রেষ্ঠী আর রাজারা যখন বৌদ্ধ মঠগুলির পৃষ্ঠপোষকতা থেকে সরে গেল তখন আর এই বিশাল বিশাল কাঠামোর বাঁচিয়ে রাখার বিনিয়োগ আর এল না। জনগনও সঙ্গে নেই প্রায়। আর স্থানীয় জনগণের বিনিয়োগে এই বিপুল বিশাল কাঠামো চলা মুশকিল।
ফলে যদি ধরেও নি তুর্কি আগ্রাসনে বাংলায় বিপুল বৌদ্ধ কচুকাটা হয়েছে(যা সম্পূর্ণ অনৈতিহাসিক - যতটা বলা হয় ততটা নয়, হয়ত নয়ই), কিন্তু তারপরেও তো সে ধাক্কা সামলে নিতে পারত তারা - যদি জনগণের পৃষ্ঠপোষকতা থাকত। সেটা কিন্তু এক্কেবারেই পারল না। মনে রাখুন নতুন সময়ে কলকাতায় সিংহলিরা বৌদ্ধ সংগঠন মহাবোধি সোসাইটি তৈরি করেছে - বাঙালি বৌদ্ধদের সেই কোমরের জোরটা ছিল না।
বৌদ্ধদের আজকে বাংলার সিপিএমের মত অবস্থা হল। কিছু গেল মুসলমান সমাজে আর কিছু গেল অমুসলমান সমাজে। আর যারা পড়ে রইল তাদের আজ এই মলিন চেহারা দেখি আমরা। আজ ভারত জোড়া বৌদ্ধ মঠগুলিতে সাহায্য করছে কিন্তু কোরিয়া জাপান।
(এই ধারণাটা কিছুটা করেছি দেবীপ্রসাদ-অলকা চট্টোপাধ্যায়ের ৮৪ সিদ্ধর কাহিনী বই থেকে আর কিছুটা হরপ্রসাদ শাস্ত্রী থেকে)
No comments:
Post a Comment