ডি পি আগরওয়াল, লোকবিজ্ঞান কেন্দ্র, আলমোড়া
(ছবিতে চিনা সেনাপতি জেং হির ২৮ বছর ধরে সমুদ্রযাত্রার বর্ণনা দিলাম - ভাস্কোর প্রায় নব্বই বছর আগে তিনি সমুদ্রবাহিত হয়ে সারা বিশ্ব ঘুরে ফেলেছেন আর ভাস্কো মেলিন্দের উপকূলে ভারত খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন। মালামো কানা না হলে তার যে কত বছর লেগে যেত ভারত পৌঁছতে, আদৌ পৌঁছতে পারতেন কিনা প্রশ্ন ওঠে। এর থেকে প্রমান হয় ইওরোপিয়রা সমুদ্র বিদ্যায় কত নাদান ছিল।)
(ছবিতে চিনা সেনাপতি জেং হির ২৮ বছর ধরে সমুদ্রযাত্রার বর্ণনা দিলাম - ভাস্কোর প্রায় নব্বই বছর আগে তিনি সমুদ্রবাহিত হয়ে সারা বিশ্ব ঘুরে ফেলেছেন আর ভাস্কো মেলিন্দের উপকূলে ভারত খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন। মালামো কানা না হলে তার যে কত বছর লেগে যেত ভারত পৌঁছতে, আদৌ পৌঁছতে পারতেন কিনা প্রশ্ন ওঠে। এর থেকে প্রমান হয় ইওরোপিয়রা সমুদ্র বিদ্যায় কত নাদান ছিল।)
এর আগে বলেছি পঞ্জিকা সংস্কারের জন্যে ম্যাটিও রিশিকে বেসরকারিভাবে ভারতে পাঠানো হল, তিনি কোচিনে ভাষা, অঙ্ক শিখে চিন হয়ে ইওরোপে গেলেন। তবুও অঙ্ক আদতে পঞ্জিকা বা নৌ চলাচলের সমস্যার সমাধানের ইঙ্গিত ইওরোপিয় পঞ্জিকা বা অঙ্ক শাস্ত্রে দেখা গেল না। প্রথম সমস্যা ইওরোপের বেশ পুরোনো – হিসেব করার অক্ষমতা। যদিও ইওরোপিয়রা দশমিক বিদ্যাটা আস্তে আস্তে শিখছিল এবং যোগ বিয়োগ গুণ ভাগের যুক্তিবিদ্যাটাও শিখছিল। তখনও জটিলতম কলনবিদ্যা আর ত্রিকোণমিতি শেখার মত যোগ্যতা তারা অর্জন করে উঠতে পারে নি।
ত্রিকোণমিতি ইওরোপে এসেছিল রেজিওমনটেনাসের(মুল নাম এবং জীবনকাল - Johannes Müller von Königsberg (6 June 1436 – 6 July 1476)) হাত ধরে, উপমহাদেশে বিকাশিত হবার এক হাজার বছর পরে। ত্রিকোনমিতি বোঝার অক্ষমতা বুঝতে পারি যদি আমরা তাদের দেওয়া ত্রিকোণমিতির চলকগুলি নাম দেওয়া থেকে। সাইন(sine) শব্দটা এসেছে ভারতীয় জ্যা(jya বা jiva) শব্দ থেকে। সেখান থেকে আরবিতে গিয়েছে জিবা(jiba) হিসেবে। বহু সময় আরবিতে স্বরবর্ণ লেখা হয় না। ফলে jiba হল jb। যাকে ভুল পড়া হল jmb বা ভাঁজ বা sinus হিসাবে – এই ভাবে ইওরোপে সাইন শব্দের উতপত্তি । করণ বা ক্যালকুলাসকে ঠিকঠাক কাজ করাতে গেলে সাইন চলকের সঠিক মান প্রয়োজন হয়, যা ভারতে ষোড়শ শতের তন্ত্রসংগ্রহে তৈরি করা ছিল। ইওরোপের সে সময়ের অঙ্কতাত্ত্বিক পেড্রো নুনেজ, ক্রিস্টোফ ক্লভিয়াস অথবা সাইমন স্টিভেন সকলেই ভারতীয়দের কাছাকাছি সাইন চলকের মান নির্নয় করার চেষ্টা করে গিয়েছেন যাতে সমুদ্রযাত্রা সঠিক হয়। অক্ষাংশ নির্ণয় করার জন্য সাইন চলকের প্রয়োজন হয়। আগে উল্লিখিত প্রথম ভাষ্করের বা অল-বিরুনির তত্ত্বানুযায়ী দ্রাঘিমাংশ নির্ণয় করতেও অক্ষাংশের মান জানা প্রয়োজন হয়।
ষোড়শ শতকে ইওরোপ যে সাধারণ যোগ বিয়োগ গুণ ভাগ এবং দশমিকের প্রায় প্রাথমিকের পড়াশোনা করে ত্রিকোণমিতি করার যে চেষ্টা করছিল ভারত সে সময় তাদের থেকে বহু আগে সেই কাজ সমাধা করে ফেলেছে। ক্রিস্টোফ ক্লভিয়াসএর সময় থেকে ১৫৮২ সালের পঞ্জিকা সংস্কারের সময় পর্যন্ত ইওরোপিয়রা অঙ্ক এবং পঞ্জিকা তৈরি বিষয়ক ভারত, আরব এবং চিনাদের থেকে জটিল জ্ঞান আহরণ করার চেষ্টা করছিল(কোচিন থেকে ম্যাটিও রিশি কিন্তু চিনে যান)। সমস্যা হল ইওরোপিয়রা সে সময় এত জটিল এশিয় অঙ্ক বুঝতে পারছিল না। এর ফল আমরা দেখতে পাই সপ্তদশ শতে ক্যাভালিয়েরি, ফেরম্যাট, পাসক্যাল, গ্রেগরির কাজে সরাসরি এবং লিবনিতজ, ওয়ালিস এবং নিউটনের কাজে পরোক্ষে, যদিও তারা তাদের কাজে সূত্র মুছে দিয়েছেন এবং তাদের পদ্ধতিটাও বিস্তৃতভাবে বলেন নি। ফেরম্যাট ইওরোপিয় অঙ্কবিদদের বেশ কিছু অঙ্ক সমাধান করতে দিয়েছেন, তার উত্তর বহু আগেই বহু জনপ্রিয় ভারতীয় জ্যোতির্বিদ্যা এবং অঙ্কতত্ত্বে বিশদে কষে দেওয়া আছে – বিশেষ করে ব্রহ্মগুপ্ত এবং দ্বিতীয় ভাষ্করের কাজে। তবে এটা পরিষ্কার ইওরোপের প্রথিতযশা অঙ্কবিদেরা ভারতীয় কলনবিদ্যার মৌলিক বিষয়গুলি বুঝতে পারেন নি – যে জন্য দেকার্ত বলে দেন অসীম শ্রেণী(সিরিজ) মানুষের বোধগম্যতার বাইরের ব্যাপার। এই সমস্যাটা বাস্তব কারণ, ভারতীয়দের কাছে অঙ্ক অতিবাস্তব(practical), ধারনামূলক (computational) এবং প্রয়োগবাদী বা অভিজ্ঞতাজনক(empirical)। অন্যদিকে অঙ্ক সম্বন্ধে ইওরোপিয় ধারণাটি পারমার্থিক(spiritual), প্রমানসিদ্ধ(proof-oriented) আর নিয়মনিষ্ঠ(formal)। যুক্তিভাষায় অসীম শ্রেণী(series)র আকঁ কষা হয়েছে ন্যায়-বৈশেষিক দর্শনের পরমাণুতত্ত্ব অনুযায়ী যেখানে একটি বৃত্তকে ভাঙতে ভাঙতে যখন সেটি পুরমাণু আকারে চলে আসে, তখন থামার কথা ওঠে। কিন্তু যখন জেসুঈট ক্যাভালিয়েরি অঙ্কতে অবিভাজ্য (indivisible) শব্দটা ব্যবহার করেন, এই একই অসীম শ্রেণীর আঁক কষতে কষতে, তখন প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। এই সমস্যাটা অতিক্ষুদ্র(infinitesimal) কলনবিদ্যায় উনবিংশ শতক পর্যন্ত ইওরোপে থেকেই যায়।
No comments:
Post a Comment