অসমের বামপন্থী নেতা রোহিনী গোস্বামী গত বছর প্রয়াত হয়েছেন। তার পরিবার এবং পরিজন এ বছর প্রয়াণ দিবসে এই বইটি বের করে। পুত্র এবং বইটির সহসম্পাদক স্নেহের Uddipan আমায় এই লেখাটি করয়ে নেয়।
---
অসমের প্রয়াত সিপিয়াই জননেতা রোহিনী গোস্বামীর জীবন নিয়ে লেখার বিন্দুমাত্র যোগ্যতা আমার নেই। কিন্তু স্নেহাস্পদ উদ্দীপনকে আমি এবং আমার স্ত্রী অন্তত এক দশকের বেশি জানি –এক সময়ে কলকাতাস্থিত অসম হাউসে যাতায়াত, নানান সাংস্কৃতিক সঙ্গঠনে জড়িত থাকার সুবাদে। ক্রমে আমার স্ত্রীর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়া এবং নিয়মিত নানান অনুষ্ঠান আয়োজন করার সূত্রে আমাদের সঙ্গে তার আত্মীয়তা তৈরি হয়েই যায়। তা ছাড়া আমরা কলকাতার যে অঞ্চলে থাকি সে তার কাছাকাছি এলাকাতেই থাকত। পরের দিকে নিয়মিত দেখা না হলেও উদ্দীপনের সঙ্গে টেলিফোনে নিয়মিত যোগাযোগ আছে। মাস কয়েক আগে সে যখন তার প্রয়াত পিতা স্বনামধন্য রোহিনী গোস্বামীর উদ্দেশ্যে একটি লেখা তৈরি করে দিতে অনুরোধ করল প্রাথমিকভাবে আমি অস্বীকার করেছিলাম। রোহিনীবাবুকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনতাম না – উদ্দীপন আর অসম হাউসের আধিকারিক রয়্যাল আহমেদের কাছে কয়েকবার নাম শুনেছি মাত্র – সেইটুকু পরিচিতিতে কোন গণআন্দোলনের, গণজাগরণের মানুষ সম্বন্ধে লেখা করা ধৃষ্টতার সামিল। আমি জানতাম তাঁর সম্বন্ধে কোন কিছু লেখা খুব দিগদারি হয়ে যাবে। কিন্তু উদ্দীপন ছাড়ল না। লেগেই রইল। ইতোমধ্যে সে আমার ফেসবুকেও বন্ধু হয়েছে। সে কোন কথা না শুনে তাঁর পিতার মৃত্যুর পর প্রকাশিত হওয়া বেশ কিছু কাগজপত্র ইত্যাদি আমায় পাঠায়। আমি রোহিনীবাবুর অপূর্ব জীবনী জেনে সত্যই মুগ্ধ হয়ে যাই – কেন যেন আমার বাবা-মা’র জীবনের সঙ্গে কিছুটা হলেও মিল পাই। ঠিক করি লেখা দরকার, আমার নিজের শিক্ষার জন্যে, আমার উত্তরপ্রজন্মের শিক্ষার জন্যে – কি ধরণের মানুষ কিভাবে সমাজ গড়ার ব্রত নিয়ে বহু মানুষের জীবনের মোড় ঘুরিয়েছিলেন – সেটা জানানোর জন্যেও।
শিক্ষিত মানুষ যে রাস্তা দিয়ে হাঁটতে দ্বিধা বোধ করে, অদীক্ষিত মানুষ সেই রাস্তায় বিনাদ্বিধায় হেঁটে যায়। তাই রোহিনীবাবুকে ব্যক্তিগতভাবে না চিনেও, শুধু তার উত্তরপ্রজন্মককে চিনে, তার সরবরাহ করা তথ্য সম্বল করে অদীক্ষিত মানুষের মত অজানা অচেনা পথে হাঁটতে রাজি হলাম কয়েকটা কারণেই। অসমের সঙ্গে আমার পরিচয় আমার জীবনে বড় ভূমিকা পালন করেছে। আজ অসম আমার জীবনে জড়িয়ে গিয়েছে নানাভাবে। অসমের কৃষ্টি আমার স্মৃতিসত্ত্বা তৈরি করতে সাহায্য করেছে দেশকে জানা চেনার কাজে। শ্রীমন্ত শঙ্করদেব, মাধব দেব, অসমের সত্র, শৈবধর্ম, নাথ ধর্ম, বিহু, ওজাপালি, নাচ গান মাজুলি, সত্র, কামাখ্যা, মসজিদ, ইসলাম ধর্ম সব কিছুই আমায় ভীষণভাবে প্রভাবিত করেছে যে শ্রীমন্ত শঙ্করদেবের প্রথম বাংলা ভাষায় জীবনী গ্রন্থ আমি লিখি রয়্যাল আহমদের সঙ্গে যৌথভাবে। সত্রের লাই খুঁটার নাম তৈরির ইতিহাস জেনে আপ্লুত হই। শঙ্করদেবের সঙ্গে বাংলার ইতিহাসও জড়িয়ে আছে। তো, কোন কারণে রোহিনীবাবুর জীবন কৃতি বিষয়ে অদীক্ষিত আমি তাঁর সম্বন্ধে লিখতে রাজি হয়ে গেলাম সেই কৈফিয়ত দিয়ে আমি স্বল্পাকারে রোহিনীবাবুর জীবন নিয়ে আলোচনা করার চেষ্টা করব। কারণ আমার জীবনে অসমের কৃষ্টির অসীম প্রভাব ছোটকরে ব্যখ্যা না করলে কেন অপরিচিত কৃষ্টিগণআন্দোলনের সঙ্গঠক রোহিনী গোস্বামীর জীবন সম্বন্ধে দুচারকথা লিখতে রাজি হলাম সেটা বোঝানো যাবে না। এই লেখায় কিছুটা আমিত্বের প্রভাব থাকবে। পাঠকেরা নিজগুণে মার্জনা করবেন। তথ্যে যদি কোন ঘাটতি ভুল থাকে তার দায় লেখকের।
উদ্দীপনের কাছে যখন জানলাম তার পিতা প্রয়াত রোহিনী গোস্বামী নিজেও অসমের কৃষ্টি জগতের মানুষ ছিলেন এবং সেই মানুষটির মাধ্যমে আমি যদি অসমিয়া কৃষ্টির প্রতি প্রণাম জানাতে পারি তাহলে আমার জীবন সার্থক হবে বলে মনে করলাম। আমার স্ত্রীর অসমেই জন্ম এবং মাধ্যমিকস্তর পর্যন্ত অসমেই পড়াশোনা। তার পরে তিনি জলপানি নিয়ে কলকাতায় চলে এসে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করে নৃত্যে অসাধারণ অধ্যাবসায়ে স্নাতকোত্তরে ভরতনাট্যম শ্রেণীতে অসীম যোগ্যতামান নিয়ে উত্তীর্ণ হলেন এবং অসমের সুসন্তান রুক্মিনীদেবী অরুণ্ডেলের সাক্ষাত শিষ্য খগেন্দ্রনাথ বর্মনের কাছে আজও তিনি ভরতনাট্যম শেখেন। ১৯৯৬ সালে সত্রীয়া, ওজাপালি আর দেওধনী কৃষ্টি নিয়ে তাঁর প্রাথমিক গবেষণা কাজ শুরু হয়। পিএইচডির কাজ শুরু হয় ১৯৯৮ সালে। গাইড ছিলেন মণিপুরী নৃত্যের অধ্যাপিকা নৃত্যাঙ্গনা ড শ্রুতি বন্দ্যোপাধ্যায়। আমার প্রয়াত শ্বশুরমশাই, উত্তর সীমান্ত রেলের ইঞ্জিনিয়ার সুখেন্দু ঘোষ এবং আমার স্ত্রী ড লিলতা ঘোষের সঙ্গ করেই অসমের কৃষ্টি জানার কাজে যুক্ত হলাম। তাদের সূত্রে অসমের মহান সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সম্বন্ধে জানলাম। অসম জুড়ে সত্র সংস্কৃতির প্রতি আমার টান তৈরি হয়ে গেল আমার স্ত্রী অসমের দুহিতার সত্রীয়া নৃত্য গবেষণা এবং সেই নাচকেই বাংলায় প্রতিষ্ঠা করার ব্রতে। আজও তিনি গুয়াহাটির প্রখ্যাত সত্রিয়া গুরু রামকৃষ্ণ তালুকদারের শিষ্যা। কলকাতায় তার বিদ্যালয় কলাবতী মুদ্রায় অসমের ওজাপালি, দেওধনী নাচ শেখানো হয়। তিনি সত্রীয়া নৃত্যে একমাত্র বাঙালি শিল্পী। তার গবেষণার কাজে গিয়েছি এক সত্র থেকে অন্য সত্রে। মাজুলির কমলাবাড়ি সত্রে গিয়েছি, আউনিআটি সত্রেও গিয়েছি। এছাড়াও আরও অনেক সত্রে গিয়েছি। থেকেছি। সত্রাধিকারীদের সঙ্গে আলাপ করেছি। গায়ন বাদন দেখেছি। যতীন গোস্বামী, ইন্দিরা পিপি বরার সঙ্গে আলাপ হয়েছে। স্ত্রীর কর্মের মাধ্যমে আজ থেকে কুড়ি বছর আগে আমার প্রথম আলাপ গুয়াহাটি-মঙ্গলদৈ রাস্তায় পড়া সিপাঝারের হাতিডুবা গ্রামের ওজাপালি গুরু প্রণম্য ললিতচন্দ্র নাথ ওজার সঙ্গে। যাঁর বাড়িতে আমরা শুধু নিয়মিতই যাই নি, তাঁর দল আর তাঁকে কলকাতায় নিয়ে এসে ওজাপালির অনুষ্ঠান করাই অসম-বাংলা আদিবাসী লোক সংস্কৃতি উতসবে। তিনি তাঁর বাড়িতে আমাদের গামোছা বুনে উপহার দিয়েছেন।
দ্বিতীয়ত যেহেতু রোহিনী গোস্বামী নিজে আজন্ম সিপিআই সঙ্গঠক ছিলেন এবং আমার আমার মা-বাবা উভয়েই সিপিয়াইএর সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত ছিলেন ১৯৮৪ সালের সিপিয়াই ভাগ হওয়ার আগে পর্যন্ত। আমার মনে হল, তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানানো্র কাজে আমায় যুক্ত করে রোহিনীবাবুর বড় পুত্র শ্রীমান উদ্দীপন আমায় ঋণী করলেন। আমি নিজে ছোটবেলা থেকেই আইপিটিএর সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। নকশাল আন্দোলনের তুঙ্গ সময়ে আমার বয়স যখন দশের অনেক কম তখন কলকাতার পুরোনো এলাকা বড়িশা অঞ্চলে আইপিটিএর অন্যতম সংগঠন আদিত্য মিত্রর নেতৃত্বে স্কোয়াডে গান করেছি। আমার মাস্টার মশাই, বাবা-মায়ের সহকর্মী আইপিটিএর অন্যতম বরিষ্ঠ নেতা, নাট্য তাত্ত্বিক প্রণম্য ব্রজসুন্দর দাস কলনায়ক নামে একটি নাট্য দল চালাতেন, সেখানেও নাটক শিখেছি করেছি। বাংলাদেশের মুক্তি যুদ্ধ, ভিয়েতনাম কাম্বোডিয়ায় সাম্রাজ্যবাদী আক্রমণের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমেছি সেই বাচ্চা বয়স থেকেই। মা-বাবা যখন আন্দোলন করে ১৭ দিনের জেল খাটছেন আমি তখন মায়ের পেটে। ফলে উদ্দীপনের থেকে যখন জানলাম যে রোহিনীবাবুও আইপিটিএর অন্যতম সঙ্গঠক ছিলেন, আমার মনে হল এই স্মৃতিতর্পণ করা খুব জরুরি, বিশেষ করে সেই অজানা মানুষটির প্রতি যিনি তাঁর জীবন উতসর্গ করে দিয়েছিলেন সমগ্র নিপীড়িত মানুষের মুক্তির কাজে, যাঁদের তৈরি করা রাস্তায় আমরা সক্কলে আজও হেঁটে চলেছি।
তৃতীয় এবং শেষ কারণটি হল আমার অসমকে জানা বোঝার হাতে খড়ি হয় সাংবাদিক জীবনের শুরুতে। আমার লেখালিখির জীবন শুরু হয়েছিল অসামান্য সাংবাদিক নিখিল চক্রবর্তী প্রতিষ্ঠিত কিংবদন্তী কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় আজও চলা সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘সপ্তাহ’তে। যে সময়টা নয়ের দশকের প্রথম দিক। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে গ্যাছে। চিন, দেং জিয়াও পিং লাইন অনুসরণ করে বেড়ালের রং কি তা না দেখে পুঁজি ভজনায় ব্যস্ত। কমিউনিস্ট জগতে দুই প্রধান তাত্ত্বিক দেশের তাত্ত্বিক অবস্থানের পরিবর্তনে ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলন তত্ত্বে বিপুল শূন্যতা। গর্বাচভ, ইয়েলতসিনকে নিয়ে বিপুল অস্বস্তি। সিপিয়াই ভেঙ্গে এআইসিপির সাধারণ কর্মী হিসেবে কাজ করছি। সেই সময় সপ্তাহ পত্রিকায় কাজ করা এবং কবি অধ্যাপক তরুণ সান্যাল, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের মত চিন্তাবিদ লেখকের স্নেহ আমায় জীবনে নোঙরের কাজ করেছে। এই সময় সপ্তাহ পত্রিকার হাত ধরে আমি অসমকে প্রথম চিনতে শিখলাম। বামপন্থীদের বড় ঘাঁটি অসম থেকে আজ থেকে প্রায় ৩০ বছর আগে যিনি সপ্তাহে অসমের চিঠি লিখতেন, তাঁর নাম আর আজ মনে নেই, কিন্তু তাঁর লেখার সুবাদে অসমের রাজনৈতিক, কৃষ্টিগত নানান খুঁটিনাটি, অসমের বিপুল রাজনৈতিক পরিবর্তনের দিকে আমায় সূচিত করার কাজ করে – আসুর উত্থান, আলফার আন্দোলন, সঞ্জয় ঘোষের মৃত্যু, নেলির হত্যাকাণ্ড ইত্যাদি সব জানলাম বুঝলাম। সপ্তাহ পত্রিকার কবিতার পাতা আমায় খুব বেশি আকর্ষণ না করলেও সেই প্রথম অসমের চিঠি আমায় পরিচয় করিয়ে দিল হীরেণ ভট্টাচার্যের সঙ্গে। তারপর তার কবিতা। স্বয়ং কবির সঙ্গেও পরে আলাপ হয়েছে, জেনেছি “মৃত্যুও তো এক শিল্প/জীবনের কঠিন পাথরে কাটা নির্লোভ ভাস্কর্য”(রমানাথ ভট্টাচার্যের অনুবাদ) অথবা কবিতা এটা আরম্ভ করা টান।/ পোনপটীয়াকৈ একোয়েই উজু বাটেরে/ মোর কলমলৈ নাহে।/ সুরে মোক আগতেই ধরা দিয়ে।... অথবা দেশে-দেশে মোর বন্ধু আছে। এনে বহু দেশর অরঙে-দরঙে/মই ঘুরিছো। বহু বন্ধুর সতে হাতে হাতে হাত ধরি ফুরিছোঁ/ কেতিয়াবা সাগর পারত, কেতিয়াবা খেজুর তলত, নতুবা/পাহারতলিত খন্তেক জিরাইছোঁ। বন্ধুর সতে প্রাণ খুলি প্রাণর/কথা পাতিছোঁ। তার পিছত আকৌ আরম্ভ করিছোঁ নতুন যাত্রা।র মত মায়াময় স্তবক। জানলাম হীরেণবাবু রোহিনীবাবুর বন্ধু ছিলেন, তখন গর্বে বুক ভরে গেল।
প্রথমেই বলেছি, রোহিনীবাবুর জীবন আলোচনায় আমি যোগ্য ব্যক্তি নই। সে বিষয় নিয়ে বিশদে নিশ্চই আলোচনা করবেন তাঁর যোগ্য পুত্রদ্বয়, তাঁর সঙ্গে কাজ করা কর্মীরা বা তাঁর আত্মীয়স্বজন, অথবা দলের, গণসঙ্গঠনের কর্মী সংগঠনের নেতারা। আমি শুধু তার জীবনের কৃতিটুকু ছুঁয়ে গিয়ে লেখায় ইতি টানব। সেই কৃষ্টিময় রাজ্য এবং লখিমপুরের অসমের মানুষ কমরেড রোহিনী গোস্বামীর ১৯৪৬এর উত্তাল দিনগুলিতে লখিমপুরে জন্ম। উত্তর লখিমপুর সরকারি হাইস্কুলে তার পড়াশোনা। শিলঙের সেন্ট এনথনি কলেজে উচ্চশিক্ষা লাভ। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ভারত জোড়া দুর্বার কমিউনিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে জোড়া অসম শাখার আন্দোলনের প্রতি তিনি ক্রমে মানসিকভাবে জড়িয়ে পড়তে থাকেন। ছাত্রাবস্থায় তিনি সাঙ্গঠনিক প্রতিভা প্রদর্শন করার সুযোগ পান। তিনি লখিমপুর অঞ্চলের ছাত্রদের সংগঠিত করেন। মাত্র কুড়ি বছর বয়সে জড়িয়ে পড়েন ছাত্র আন্দোলনে। ১৯৬০ সালে ভাষা আইন নিয়ে অসম জুড়ে আন্দোলন গড়ে উঠতে থাকে। তাঁর উদ্যোগে লখিমপুরে গড়ে ওঠে উত্তর লখিমপুর ছাত্র সংস্থা। লখিমপুর জেলা হয় ১৯৭১ সালে। তার পিছনে এই সংগঠনের অবদান বিপুল। ১৯৬৪ সালে খাদ্য আন্দোলনের প্রেক্ষিতে তৈরি হয় স্টুডেন্টস একশন কমিটি। তিনি সম্পাদক নির্বাচিত হন। আমার বাবা-মায়েরর মত তিনিও আন্দোলন করতে গিয়ে জেল খাটেন।
ছাত্রাবস্থায় তিনি আর প্রয়াত বিধায়ক মহানন্দ বরার পুত্র দেবাবন্দ বরা বক্তৃতা দেওয়ার জন্যে এই অঞ্চলে বিখ্যাত হয়ে ওঠেন – যদিও দুজনের রাজনৈতিক বিশ্বাস আলাদা ধরণের – রোহিনীবাবু কমিউনিস্ট আর দেবাবন্দবাবু কংগ্রেসি – কিন্তু বলার, মানুষকে প্রভাবিত করার শক্তির জন্যে বিভিন্ন এলাকায় তাঁদের বলতে নিয়ে যাওয়া হত। একদা লখিমপুরে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির উদ্যোগে আয়োজিত জনসভায় খগেন হিলৈদারী, বেনা দত্ত, নামেশ্বর পেগু, বিষ্ণু বরা, ভূবন গগৈ, বন্ধুরাম পায়েগাম, হেম রাজখোয়া, সৈফুদ্দিন আলি হাজরিকা লাল এবং অবশ্যই রোহিনী গোস্বামী বক্তৃতা করতে আসেন। প্রত্যেকেই অসাধারণ বক্তা। সেই অদম্য মানুষদের বক্তৃতা সে অঞ্চলে বিপুল প্রভাব সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিল। সেই ঘটনার কথা সশ্রদ্ধভাবে লিখেছেন হারনুল রশিদ।
অসমের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বিমলাপ্রসাদ চালিহা একবার লখিমপুরে আসেন। রোহিনীবাবু তখন উত্তর লখিমপুর সরকারি উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের যৌথ ছাত্র সংগঠনের নেতা। তাঁর যোগ্য নেতৃত্বে সেখানকার পরবর্তীকালের সাংসদ বলীন কুলি, রণধীর নাথ, কননাথ ফুকন ইত্যাদি আটজন ছাত্র মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেন। দীর্ঘ একঘণ্টা আলোচনা হয়। সেই মুহূর্তে মুখ্যমন্ত্রী কোন আশ্বাস না দিলেও পরে ছাত্রদের দাবি নির্ভর করে সে বিদ্যালয়ে, অঞ্চলে বিকাশের অনেক কাজ হয়। ১৯৬৮ সালে এআইএসএফের স্বর্ণ জয়ন্তী উপলক্ষ্যে তার নেতৃত্বে অসমিয়া কৃষ্টি দল দিল্লি যায়। যোরহাটের এআইএসএফের স্বর্ণ জয়ন্তী উপলক্ষ্যে অনুষ্ঠান আয়োজনের দায়িত্ব তাঁর ওপরেই ন্যস্ত ছিল। ১৯৬৯ সালে গুয়াহাটি অধিবেশনে তিনি সিপিয়াইর সদস্য এবং লখিমপুর শাখার সদস্য হন।
পরে সর্বভারতীয় কৃষক সংগঠনের অন্যতম কর্মী-সঙ্গঠক হয়ে ওঠেন। এআইএসএফের তিনি বহুকাল নেতৃত্বে ছিলেন। ছাত্র আন্দোলনের জন্যে ১৯৭১ সালে তাঁর কারাবাস। নিখিল ভারত যুব ফেডারেশনের রাজ্য সভাপতির দায় গ্রহণ করেন। পরে সম্পাদকও হন। ১৯৭৮ সালে সোভিয়েত ভূমি সহ পূর্ব ইওরোপের কমিউনিস্ট দেশগুলোয় ভ্রমণ করতে যান। তেল শোধনাগারের কর্মীদের দাবিদাওয়ার আন্দোলনে তিনি জড়িয়ে যান। লখিমপুর অঞ্চলে তাঁর প্রখর পড়াশোনা, জ্ঞান আর স্মৃতির জন্যে তাঁকে অনেকেই চলন্ত এনসাক্লোপিডিয়া নাম দিয়েছিলেন। ১৯৮৩ সালে লখিমপুরে ছাপাখানা তৈরির সিদ্ধান্ত নেন রোহনীবাবু। নাম হয় পপুলার প্রিন্টার্স। সেই ছাপাখানা খুব ভাল করে চালাতেও তার সাঙ্গঠনিক প্রতিভা কাজে লেগেছিল। ১৯৯১ সালে বিধানসভাতেও লড়েছিলেন রোহিনীবাবু।
১৯৮৬ সালে ভারতীয় গণনাট্য সংঘ আবার নতুন করে সংগঠিত হয় তিনি অসমের সহসম্পাদক হন। উত্তর লখিমপুরের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে তিনি জড়িয়ে পড়েন। লখিমপুর কেন্দ্রিয় রঙ্গালি বিহুর প্রধান সম্পাদক ছিলেন ১০ বছর। এছাড়াও উত্তর লখিমপুর সাহিত্য সভা, ফুটবল এসোসিয়েসন ইত্যাদি নানান সংগঠনের সঙ্গে তিনি আমৃত্যু জড়িয়েছিলেন।
শেষের দিকে দুরারোগ্য ব্যধিতে তার শরীর ভেঙ্গে পড়তে থাকে। ২০১৭ সালের ৫ জুলাই তার দেহাবসান ঘটে।
অসম রাজ্য লাচিত বরফুকনের রাজ্য। বছর তিনেক আগে অসম আক্রমণকারী ঔরঙ্গজেবের মুঘল সেনাপতি মীর জুমলার জীবন অনুবাদের কাজে বিশদে জানতে পারি লচিত বরফুকনের জীবনী আর কৃতি – কিভাবে তিনি সরাইঘাট যুদ্ধে বিপুল বিশাল মুঘল বাহিনীকে পরাজিত করেন। এবং অসম বাহিনীর সঙ্গে যুঝতে না পেরে মীর জুমলার মৃত্যু ঘটে অসমের মাটিতেই। যুদ্ধ চলাকালীন লাচিত, কর্তব্য অবহেলায় তার মামার শিরচ্ছেদ করে বলেন, “দেশতকৈ মোমাই ডাঙৰ নহয়”। সেই অসাধারণ যুদ্ধ প্রতিভা এবং অহমিয়া জাতি মুঘল সাম্রাজ্যচেষ্টার প্রতিরোধের গল্প বরাবরের জন্যে আমার হৃদয়ে স্থান পায়। সেই অসাধারণ রাজ্যের লাচিতের লড়াইয়ের উত্তরসূরী এই অসামান্য জননেতার প্রতি এই ক্ষুদ্র মানুষের প্রাণ ভরা প্রণতি জানিয়ে আমার লেখায় ইতি টানলাম।
উদ্দীপনের কাছে যখন জানলাম তার পিতা প্রয়াত রোহিনী গোস্বামী নিজেও অসমের কৃষ্টি জগতের মানুষ ছিলেন এবং সেই মানুষটির মাধ্যমে আমি যদি অসমিয়া কৃষ্টির প্রতি প্রণাম জানাতে পারি তাহলে আমার জীবন সার্থক হবে বলে মনে করলাম। আমার স্ত্রীর অসমেই জন্ম এবং মাধ্যমিকস্তর পর্যন্ত অসমেই পড়াশোনা। তার পরে তিনি জলপানি নিয়ে কলকাতায় চলে এসে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করে নৃত্যে অসাধারণ অধ্যাবসায়ে স্নাতকোত্তরে ভরতনাট্যম শ্রেণীতে অসীম যোগ্যতামান নিয়ে উত্তীর্ণ হলেন এবং অসমের সুসন্তান রুক্মিনীদেবী অরুণ্ডেলের সাক্ষাত শিষ্য খগেন্দ্রনাথ বর্মনের কাছে আজও তিনি ভরতনাট্যম শেখেন। ১৯৯৬ সালে সত্রীয়া, ওজাপালি আর দেওধনী কৃষ্টি নিয়ে তাঁর প্রাথমিক গবেষণা কাজ শুরু হয়। পিএইচডির কাজ শুরু হয় ১৯৯৮ সালে। গাইড ছিলেন মণিপুরী নৃত্যের অধ্যাপিকা নৃত্যাঙ্গনা ড শ্রুতি বন্দ্যোপাধ্যায়। আমার প্রয়াত শ্বশুরমশাই, উত্তর সীমান্ত রেলের ইঞ্জিনিয়ার সুখেন্দু ঘোষ এবং আমার স্ত্রী ড লিলতা ঘোষের সঙ্গ করেই অসমের কৃষ্টি জানার কাজে যুক্ত হলাম। তাদের সূত্রে অসমের মহান সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সম্বন্ধে জানলাম। অসম জুড়ে সত্র সংস্কৃতির প্রতি আমার টান তৈরি হয়ে গেল আমার স্ত্রী অসমের দুহিতার সত্রীয়া নৃত্য গবেষণা এবং সেই নাচকেই বাংলায় প্রতিষ্ঠা করার ব্রতে। আজও তিনি গুয়াহাটির প্রখ্যাত সত্রিয়া গুরু রামকৃষ্ণ তালুকদারের শিষ্যা। কলকাতায় তার বিদ্যালয় কলাবতী মুদ্রায় অসমের ওজাপালি, দেওধনী নাচ শেখানো হয়। তিনি সত্রীয়া নৃত্যে একমাত্র বাঙালি শিল্পী। তার গবেষণার কাজে গিয়েছি এক সত্র থেকে অন্য সত্রে। মাজুলির কমলাবাড়ি সত্রে গিয়েছি, আউনিআটি সত্রেও গিয়েছি। এছাড়াও আরও অনেক সত্রে গিয়েছি। থেকেছি। সত্রাধিকারীদের সঙ্গে আলাপ করেছি। গায়ন বাদন দেখেছি। যতীন গোস্বামী, ইন্দিরা পিপি বরার সঙ্গে আলাপ হয়েছে। স্ত্রীর কর্মের মাধ্যমে আজ থেকে কুড়ি বছর আগে আমার প্রথম আলাপ গুয়াহাটি-মঙ্গলদৈ রাস্তায় পড়া সিপাঝারের হাতিডুবা গ্রামের ওজাপালি গুরু প্রণম্য ললিতচন্দ্র নাথ ওজার সঙ্গে। যাঁর বাড়িতে আমরা শুধু নিয়মিতই যাই নি, তাঁর দল আর তাঁকে কলকাতায় নিয়ে এসে ওজাপালির অনুষ্ঠান করাই অসম-বাংলা আদিবাসী লোক সংস্কৃতি উতসবে। তিনি তাঁর বাড়িতে আমাদের গামোছা বুনে উপহার দিয়েছেন।
দ্বিতীয়ত যেহেতু রোহিনী গোস্বামী নিজে আজন্ম সিপিআই সঙ্গঠক ছিলেন এবং আমার আমার মা-বাবা উভয়েই সিপিয়াইএর সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত ছিলেন ১৯৮৪ সালের সিপিয়াই ভাগ হওয়ার আগে পর্যন্ত। আমার মনে হল, তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানানো্র কাজে আমায় যুক্ত করে রোহিনীবাবুর বড় পুত্র শ্রীমান উদ্দীপন আমায় ঋণী করলেন। আমি নিজে ছোটবেলা থেকেই আইপিটিএর সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। নকশাল আন্দোলনের তুঙ্গ সময়ে আমার বয়স যখন দশের অনেক কম তখন কলকাতার পুরোনো এলাকা বড়িশা অঞ্চলে আইপিটিএর অন্যতম সংগঠন আদিত্য মিত্রর নেতৃত্বে স্কোয়াডে গান করেছি। আমার মাস্টার মশাই, বাবা-মায়ের সহকর্মী আইপিটিএর অন্যতম বরিষ্ঠ নেতা, নাট্য তাত্ত্বিক প্রণম্য ব্রজসুন্দর দাস কলনায়ক নামে একটি নাট্য দল চালাতেন, সেখানেও নাটক শিখেছি করেছি। বাংলাদেশের মুক্তি যুদ্ধ, ভিয়েতনাম কাম্বোডিয়ায় সাম্রাজ্যবাদী আক্রমণের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমেছি সেই বাচ্চা বয়স থেকেই। মা-বাবা যখন আন্দোলন করে ১৭ দিনের জেল খাটছেন আমি তখন মায়ের পেটে। ফলে উদ্দীপনের থেকে যখন জানলাম যে রোহিনীবাবুও আইপিটিএর অন্যতম সঙ্গঠক ছিলেন, আমার মনে হল এই স্মৃতিতর্পণ করা খুব জরুরি, বিশেষ করে সেই অজানা মানুষটির প্রতি যিনি তাঁর জীবন উতসর্গ করে দিয়েছিলেন সমগ্র নিপীড়িত মানুষের মুক্তির কাজে, যাঁদের তৈরি করা রাস্তায় আমরা সক্কলে আজও হেঁটে চলেছি।
তৃতীয় এবং শেষ কারণটি হল আমার অসমকে জানা বোঝার হাতে খড়ি হয় সাংবাদিক জীবনের শুরুতে। আমার লেখালিখির জীবন শুরু হয়েছিল অসামান্য সাংবাদিক নিখিল চক্রবর্তী প্রতিষ্ঠিত কিংবদন্তী কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় আজও চলা সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘সপ্তাহ’তে। যে সময়টা নয়ের দশকের প্রথম দিক। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে গ্যাছে। চিন, দেং জিয়াও পিং লাইন অনুসরণ করে বেড়ালের রং কি তা না দেখে পুঁজি ভজনায় ব্যস্ত। কমিউনিস্ট জগতে দুই প্রধান তাত্ত্বিক দেশের তাত্ত্বিক অবস্থানের পরিবর্তনে ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলন তত্ত্বে বিপুল শূন্যতা। গর্বাচভ, ইয়েলতসিনকে নিয়ে বিপুল অস্বস্তি। সিপিয়াই ভেঙ্গে এআইসিপির সাধারণ কর্মী হিসেবে কাজ করছি। সেই সময় সপ্তাহ পত্রিকায় কাজ করা এবং কবি অধ্যাপক তরুণ সান্যাল, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের মত চিন্তাবিদ লেখকের স্নেহ আমায় জীবনে নোঙরের কাজ করেছে। এই সময় সপ্তাহ পত্রিকার হাত ধরে আমি অসমকে প্রথম চিনতে শিখলাম। বামপন্থীদের বড় ঘাঁটি অসম থেকে আজ থেকে প্রায় ৩০ বছর আগে যিনি সপ্তাহে অসমের চিঠি লিখতেন, তাঁর নাম আর আজ মনে নেই, কিন্তু তাঁর লেখার সুবাদে অসমের রাজনৈতিক, কৃষ্টিগত নানান খুঁটিনাটি, অসমের বিপুল রাজনৈতিক পরিবর্তনের দিকে আমায় সূচিত করার কাজ করে – আসুর উত্থান, আলফার আন্দোলন, সঞ্জয় ঘোষের মৃত্যু, নেলির হত্যাকাণ্ড ইত্যাদি সব জানলাম বুঝলাম। সপ্তাহ পত্রিকার কবিতার পাতা আমায় খুব বেশি আকর্ষণ না করলেও সেই প্রথম অসমের চিঠি আমায় পরিচয় করিয়ে দিল হীরেণ ভট্টাচার্যের সঙ্গে। তারপর তার কবিতা। স্বয়ং কবির সঙ্গেও পরে আলাপ হয়েছে, জেনেছি “মৃত্যুও তো এক শিল্প/জীবনের কঠিন পাথরে কাটা নির্লোভ ভাস্কর্য”(রমানাথ ভট্টাচার্যের অনুবাদ) অথবা কবিতা এটা আরম্ভ করা টান।/ পোনপটীয়াকৈ একোয়েই উজু বাটেরে/ মোর কলমলৈ নাহে।/ সুরে মোক আগতেই ধরা দিয়ে।... অথবা দেশে-দেশে মোর বন্ধু আছে। এনে বহু দেশর অরঙে-দরঙে/মই ঘুরিছো। বহু বন্ধুর সতে হাতে হাতে হাত ধরি ফুরিছোঁ/ কেতিয়াবা সাগর পারত, কেতিয়াবা খেজুর তলত, নতুবা/পাহারতলিত খন্তেক জিরাইছোঁ। বন্ধুর সতে প্রাণ খুলি প্রাণর/কথা পাতিছোঁ। তার পিছত আকৌ আরম্ভ করিছোঁ নতুন যাত্রা।র মত মায়াময় স্তবক। জানলাম হীরেণবাবু রোহিনীবাবুর বন্ধু ছিলেন, তখন গর্বে বুক ভরে গেল।
প্রথমেই বলেছি, রোহিনীবাবুর জীবন আলোচনায় আমি যোগ্য ব্যক্তি নই। সে বিষয় নিয়ে বিশদে নিশ্চই আলোচনা করবেন তাঁর যোগ্য পুত্রদ্বয়, তাঁর সঙ্গে কাজ করা কর্মীরা বা তাঁর আত্মীয়স্বজন, অথবা দলের, গণসঙ্গঠনের কর্মী সংগঠনের নেতারা। আমি শুধু তার জীবনের কৃতিটুকু ছুঁয়ে গিয়ে লেখায় ইতি টানব। সেই কৃষ্টিময় রাজ্য এবং লখিমপুরের অসমের মানুষ কমরেড রোহিনী গোস্বামীর ১৯৪৬এর উত্তাল দিনগুলিতে লখিমপুরে জন্ম। উত্তর লখিমপুর সরকারি হাইস্কুলে তার পড়াশোনা। শিলঙের সেন্ট এনথনি কলেজে উচ্চশিক্ষা লাভ। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ভারত জোড়া দুর্বার কমিউনিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে জোড়া অসম শাখার আন্দোলনের প্রতি তিনি ক্রমে মানসিকভাবে জড়িয়ে পড়তে থাকেন। ছাত্রাবস্থায় তিনি সাঙ্গঠনিক প্রতিভা প্রদর্শন করার সুযোগ পান। তিনি লখিমপুর অঞ্চলের ছাত্রদের সংগঠিত করেন। মাত্র কুড়ি বছর বয়সে জড়িয়ে পড়েন ছাত্র আন্দোলনে। ১৯৬০ সালে ভাষা আইন নিয়ে অসম জুড়ে আন্দোলন গড়ে উঠতে থাকে। তাঁর উদ্যোগে লখিমপুরে গড়ে ওঠে উত্তর লখিমপুর ছাত্র সংস্থা। লখিমপুর জেলা হয় ১৯৭১ সালে। তার পিছনে এই সংগঠনের অবদান বিপুল। ১৯৬৪ সালে খাদ্য আন্দোলনের প্রেক্ষিতে তৈরি হয় স্টুডেন্টস একশন কমিটি। তিনি সম্পাদক নির্বাচিত হন। আমার বাবা-মায়েরর মত তিনিও আন্দোলন করতে গিয়ে জেল খাটেন।
ছাত্রাবস্থায় তিনি আর প্রয়াত বিধায়ক মহানন্দ বরার পুত্র দেবাবন্দ বরা বক্তৃতা দেওয়ার জন্যে এই অঞ্চলে বিখ্যাত হয়ে ওঠেন – যদিও দুজনের রাজনৈতিক বিশ্বাস আলাদা ধরণের – রোহিনীবাবু কমিউনিস্ট আর দেবাবন্দবাবু কংগ্রেসি – কিন্তু বলার, মানুষকে প্রভাবিত করার শক্তির জন্যে বিভিন্ন এলাকায় তাঁদের বলতে নিয়ে যাওয়া হত। একদা লখিমপুরে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির উদ্যোগে আয়োজিত জনসভায় খগেন হিলৈদারী, বেনা দত্ত, নামেশ্বর পেগু, বিষ্ণু বরা, ভূবন গগৈ, বন্ধুরাম পায়েগাম, হেম রাজখোয়া, সৈফুদ্দিন আলি হাজরিকা লাল এবং অবশ্যই রোহিনী গোস্বামী বক্তৃতা করতে আসেন। প্রত্যেকেই অসাধারণ বক্তা। সেই অদম্য মানুষদের বক্তৃতা সে অঞ্চলে বিপুল প্রভাব সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিল। সেই ঘটনার কথা সশ্রদ্ধভাবে লিখেছেন হারনুল রশিদ।
অসমের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বিমলাপ্রসাদ চালিহা একবার লখিমপুরে আসেন। রোহিনীবাবু তখন উত্তর লখিমপুর সরকারি উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের যৌথ ছাত্র সংগঠনের নেতা। তাঁর যোগ্য নেতৃত্বে সেখানকার পরবর্তীকালের সাংসদ বলীন কুলি, রণধীর নাথ, কননাথ ফুকন ইত্যাদি আটজন ছাত্র মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেন। দীর্ঘ একঘণ্টা আলোচনা হয়। সেই মুহূর্তে মুখ্যমন্ত্রী কোন আশ্বাস না দিলেও পরে ছাত্রদের দাবি নির্ভর করে সে বিদ্যালয়ে, অঞ্চলে বিকাশের অনেক কাজ হয়। ১৯৬৮ সালে এআইএসএফের স্বর্ণ জয়ন্তী উপলক্ষ্যে তার নেতৃত্বে অসমিয়া কৃষ্টি দল দিল্লি যায়। যোরহাটের এআইএসএফের স্বর্ণ জয়ন্তী উপলক্ষ্যে অনুষ্ঠান আয়োজনের দায়িত্ব তাঁর ওপরেই ন্যস্ত ছিল। ১৯৬৯ সালে গুয়াহাটি অধিবেশনে তিনি সিপিয়াইর সদস্য এবং লখিমপুর শাখার সদস্য হন।
পরে সর্বভারতীয় কৃষক সংগঠনের অন্যতম কর্মী-সঙ্গঠক হয়ে ওঠেন। এআইএসএফের তিনি বহুকাল নেতৃত্বে ছিলেন। ছাত্র আন্দোলনের জন্যে ১৯৭১ সালে তাঁর কারাবাস। নিখিল ভারত যুব ফেডারেশনের রাজ্য সভাপতির দায় গ্রহণ করেন। পরে সম্পাদকও হন। ১৯৭৮ সালে সোভিয়েত ভূমি সহ পূর্ব ইওরোপের কমিউনিস্ট দেশগুলোয় ভ্রমণ করতে যান। তেল শোধনাগারের কর্মীদের দাবিদাওয়ার আন্দোলনে তিনি জড়িয়ে যান। লখিমপুর অঞ্চলে তাঁর প্রখর পড়াশোনা, জ্ঞান আর স্মৃতির জন্যে তাঁকে অনেকেই চলন্ত এনসাক্লোপিডিয়া নাম দিয়েছিলেন। ১৯৮৩ সালে লখিমপুরে ছাপাখানা তৈরির সিদ্ধান্ত নেন রোহনীবাবু। নাম হয় পপুলার প্রিন্টার্স। সেই ছাপাখানা খুব ভাল করে চালাতেও তার সাঙ্গঠনিক প্রতিভা কাজে লেগেছিল। ১৯৯১ সালে বিধানসভাতেও লড়েছিলেন রোহিনীবাবু।
১৯৮৬ সালে ভারতীয় গণনাট্য সংঘ আবার নতুন করে সংগঠিত হয় তিনি অসমের সহসম্পাদক হন। উত্তর লখিমপুরের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে তিনি জড়িয়ে পড়েন। লখিমপুর কেন্দ্রিয় রঙ্গালি বিহুর প্রধান সম্পাদক ছিলেন ১০ বছর। এছাড়াও উত্তর লখিমপুর সাহিত্য সভা, ফুটবল এসোসিয়েসন ইত্যাদি নানান সংগঠনের সঙ্গে তিনি আমৃত্যু জড়িয়েছিলেন।
শেষের দিকে দুরারোগ্য ব্যধিতে তার শরীর ভেঙ্গে পড়তে থাকে। ২০১৭ সালের ৫ জুলাই তার দেহাবসান ঘটে।
অসম রাজ্য লাচিত বরফুকনের রাজ্য। বছর তিনেক আগে অসম আক্রমণকারী ঔরঙ্গজেবের মুঘল সেনাপতি মীর জুমলার জীবন অনুবাদের কাজে বিশদে জানতে পারি লচিত বরফুকনের জীবনী আর কৃতি – কিভাবে তিনি সরাইঘাট যুদ্ধে বিপুল বিশাল মুঘল বাহিনীকে পরাজিত করেন। এবং অসম বাহিনীর সঙ্গে যুঝতে না পেরে মীর জুমলার মৃত্যু ঘটে অসমের মাটিতেই। যুদ্ধ চলাকালীন লাচিত, কর্তব্য অবহেলায় তার মামার শিরচ্ছেদ করে বলেন, “দেশতকৈ মোমাই ডাঙৰ নহয়”। সেই অসাধারণ যুদ্ধ প্রতিভা এবং অহমিয়া জাতি মুঘল সাম্রাজ্যচেষ্টার প্রতিরোধের গল্প বরাবরের জন্যে আমার হৃদয়ে স্থান পায়। সেই অসাধারণ রাজ্যের লাচিতের লড়াইয়ের উত্তরসূরী এই অসামান্য জননেতার প্রতি এই ক্ষুদ্র মানুষের প্রাণ ভরা প্রণতি জানিয়ে আমার লেখায় ইতি টানলাম।
No comments:
Post a Comment