বাগদাদ এবং কায়রোর ঐতিহ্য
মাথায় রেখে মুঘল সাম্রাজ্য গুরুত্বপূর্ণ সরকারি তথ্যাদি সংরক্ষণ করার সুচারু
ব্যবস্থা করেছিল। মুঘল সরকারকে বর্ণনা করতে গেলে একে বলতে হবে কাগজি রাজ, কেননা এই
সরকার চালাতে বিপুল পরিমান কাগজ লাগত(যদিও রুশি ঐতিহাসিকেরা সে সময়ের সব কটি
রাষ্ট্রের মত মুঘল সাম্রাজ্যকেও সামরিক রাষ্ট্র হিসেবে দাগিয়ে দ্যান, এবং সেই
দাগানো আজও বর্তমান। যদুনাথ সরকার সরকারের সামরিক চরিত্র নির্ধারণ করেছেন। কিন্তু
আমরা লেখক বিমল দত্তের মত মনে করি মুঘল সাম্রাজ্যের চরিত্র ছিল লেখ্য সাম্রাজ্য। একটি
কাগজের/তথ্যের বিপুল পরিমান নকল তৈরি হত বিভিন্ন দপ্তরে সংরক্ষণ করে রাখার জন্যে -
অনুবাদক)।
মুঘল সাম্রাজ্য জুড়ে প্রচুর
খবর লেখক এবং করণিক নিযুক্ত ছিল, যারা প্রত্যেক সারকারি তথ্যের এবং নির্দেশনামার
প্রচুর নকল বানাতেন। গোটা সাম্রাজ্যে কত পরিমান তথ্য লেখক ছিলেন এই পরিমানটা
আন্দাজ করা যাবে, যদি সাম্রাজ্যের প্রথম ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা আকবরের দরবারের
তথ্য লেখক সচিবদের হিসেব নিই, দরবারে শুধু ছিল ১৪ জন সংবাদ লেখক। আবুল ফজল এবং ডি জারির
দেওয়া তথ্য, সত্যকেই প্রতিষ্ঠিত করে।
সংবাদ লেখক বা
ওয়াকিয়ানবিশের দায়িত্ব সম্বন্ধে আবুল ফজল লিখছেন, তাদের দায় ছিল পাদশাহের
কর্মকাণ্ড এবং নির্দেশাবলী আর দপ্তরের পরিচালকদের প্রত্যেকটি প্রতিবেদন লিপিবদ্ধ
করা। ডি জারি আমাদেরর জানাচ্ছেন, রাজার... সঙ্গে বেশ কয়েকজন সচিব থাকতেন তার বলা
প্রত্যেকটি শব্দ তারা লিখে নিতেন। আওরঙ্গজেবকে রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে
সংবাদ লেখক এবং সচিবদের পাঠানো সাপ্তাহিক প্রতিবেদন প্রতিদিন রাত নটায় একজন মহিলা
কর্মচারী পড়ে শুনিয়ে সারা রাষ্ট্র যা ঘটছে সে বিষয়ে তিনি অবগত রাখতেন। ভেনিসের মানুচি
বলছেন ঔরঙ্গজেব পারস্যে যে একটি দৌত্য দল পাঠিয়েছিলেন, সেই দলে একজন ওয়াকিয়ানিবিশ
আর একজন খুফিয়ানবিশ ছিল।
মুঘল মহাফেজখানায় যে সব
ধরণের রাষ্ট্রীয় তথ্য জমা রাখত, সেগুলি হল
১) দরবারের ওয়াকিয়া বা
দৈনিক প্রতিবেদন,
২) রাজকীয় নির্দেশ বা আহকম
৩) সরকারি চিঠিপত্র,
রাজপরিপবারের সদস্যদের পাঠানো চিঠি, অভিজাত/প্রখ্যাতদের নিজেদের মধ্যে এবং
সম্রাটকে সম্বোধন করে লেখা চিঠি, গুরুত্বপূর্ণ সচিবদের চিঠিপত্র এবং রাষ্ট্রজুড়ে
পাঠানো নির্দেশাবলী বা ফতেহানামা তুমহার
৪) বিভিন্ন দপ্তর থেকে
বিভিন্ন দপ্তরের জন্যে জারি করা সরকারি নির্দেশাবলী
৫)নানান ধরণের তথ্যাবলী যেমন ইচ্ছাপত্র বা ওয়াসিয়তনামা, সংখ্যাতাত্ত্বিক
হিসেব, সরকারি বাৎসরিক পঞ্জী, সরকারি প্রতিবেদন(নিউজ লেটার্স)
৬) আদালতের কাজকরররমের বর্ননা এবং মুন্সিদের লেখা চিঠি
উল্লিখিত তথ্য এবং নথিগুলি
মূলত কেন্দ্রিয় সরকার এবং সুবাগুলির সদরে রাখা হত। সাম্রাজ্যের মুল চ্যানসারি বা
দপ্তরখানার দায়িত্বে থাকতেন তথ্যের দায়িত্বে থাকা একজন দারোগা। সুবার দপ্তরখানার
দায়িত্বে থাকতেন প্রধানমন্ত্রী বা দেওয়ান।
মুঘল সাম্রাজ্য তার
প্রতিবেশি রাজ্যগুলির নানান দ্গরণেরে তথ্যাদি দপ্তরখানায় জমিয়ে রাখত। আকবরের সময়
আগ্রয়ার মহাফেজখানায় পারস্যের শাহ তামসের ফারমান অথবা তারিখহীন শাহজাহানী ফরমান বিজাপুর
বা গোলকুণ্ডার সুলতানকে পাঠানো হায়দ্রাবাদের বাগানগরের মহাফেজখানায় পাওয়া যাওয়া এই
তত্ত্বকে প্রমান করে।
ফতেপুর সিক্রির যে বাড়িটি
মহাফেজখানা হিসেবে ব্যবহার হত সেটি আজও আছে এটি একটি বড় সাড়ে আটচল্লিশ ফুট লম্বা
এবং সাড়ে আঠাশ ফুট বন্ধ বারান্দাওয়ালা সামনের কক্ষ। আকবর পাদশার শোয়ার ঘরের দক্ষিণ
দিকেরে ভিতে করা হয়েছিল।
উইলিয়ান ফিঞ্চ(১৬১১), জোনস
ডি ল্যাক্ট(১৫৯৩-১৬৪৯) বা সেবেস্টিয়ান মনরকে(১৬৪০)মত বহু ইওরোপিয় মুসাফির আগরার
দপ্তরখানা ভ্রমণ করেছেন। আওরঙ্গজেব বা বাহাদুর শাহের সময় দিল্লি দুর্গেও একই ধরণের
মহাফেজখানার বিস্তৃত ব্যবস্থাপনা করা হত।
No comments:
Post a Comment