Saturday, August 25, 2018

উপনিবেশ বিরোধী চর্চা - ঔপনিবেশিকপুর্ব বুদ্ধিজীবি - ঔপনিবেশিক জ্ঞানভাণ্ডারের বিকাশ১

(বিতর্ক - উপনিবেশপূর্ব জ্ঞান সরবরাহকেরা কি সক্রিয় না অক্রিয়। আমাদেরর মত শেষ পর্বে)
সম্প্রতি ওয়েলেসলিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিলিপ বি ওয়াগানার ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রগুলির জ্ঞানভাণ্ডারের চরিত্রটি কি, এবং সেটি বিকাশের কার কত যোগদান তাই নিয়ে সুন্দর একটি প্রবন্ধ তৈরি করেছেন(প্রিকলোনিয়াল ইন্টালেকচুয়ালস এন্ড দ্য প্রোডাকশন অব কলোনিয়াল নলেজ)। তিনি বলছেন, যে উপনিবেশ তৈরি হল বিশ্বাসঘাতকতা, লুঠ গণহত্যা অত্যাচারের মধ্যে দিয়ে, সেই উপনিবেশ চালাতে যে জ্ঞানভাণ্ডার তৈরি/বিকাশ ঘটল, অর্থাত সাম্রাজ্যবাদীরা যে উপনিবেশ তৈরি করল, তাতে কি উপনিবেশপুর্ব সাবজেক্টরা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিল, নাকি তাদের অংশগ্রহণ ছিল না, মোটামুটি উপনিবেশিক শাসকেরা যা ঠিক করে দিয়েছিলেন তাই হয়েছে।
এটা নিয়ে আমরা আলোচনা করেব কয়েক পর্বে। বলা দরকার এটা আমাদের ভাষ্য নয়। আমরা দেখব এই অংশগ্রন বিষয়ের বিতর্কে দুটি পক্ষ আছে। আমরা এই দুপক্ষের মতবাদ তুলে দেব। বলা দরকার আমরা কোন পক্ষই নই। আমাদের বক্তব্য শেষ পর্বে থাকবে। মোটামুটি তিনটে পর্বে এটা সমাধা হবে বলে ধারণা হচ্ছে।
এক পক্ষের ভাবনা উপনিবেশ তৈরির জন্যে যে জ্ঞানভাণ্ডার প্রয়োজন ছিল, সেই জ্ঞানভাণ্ডারের বিকাশে উপনিবেশের মানুষদের অংশগ্রহণ প্রায় ছিলই না, খুব বেশি হলে তাদের নিস্ক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল, তারা বড়জোর এই কাজে মধ্যস্থ হিসেবে কাজ করেছে। তারা সাম্রাজ্যকে তাদের কাছে থাকা যে তথ্যভাণ্ডার ছিল সেগুলি সরবরাহ করেছে। সেই তথ্য নিয়ে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র সাগরপারের প্রযুক্তি/পদ্ধতি ব্যবহার, ব্যবস্থাপনা করে সাম্রাজ্য চালানোর নানা রেণু তৈরি করেছে। উল্টোদিকে আরেক গবেষক দলের বক্তব্য ব্যাপারটা মোটেই তাই নয় উপনিবেশের বুদ্ধিজীবিরা শুধুই ইনফরট্যান্ট হিসেবেই কাজ করে নি, তারা সক্রিয়ভাবে সাম্রাজ্য তৈরি করার কাজে জটিল উপায়ে অংশগ্রহণ করেছে এবং সাম্রাজ্য তৈরির কাজে তাদের জ্ঞান সক্রিয়ভাবে কাজে লেগেছে। যদিও এই বিতর্কটা শুরু হয়েছিল ভারতের ঔপনিবেশিক সময় আলোচনায় কিন্তু ক্রমে এটি সাধারণ বিশ্বজোড়া উপনিবেশের জ্ঞানচর্চা বিষয়ক আলোচনায় রূপান্তরিত হয়েছে।
প্রথম মতবাদের পক্ষে মধ্যে প্রখ্যাতরা হলেন এডওয়ার্ড সঈদ, রোনাল্ড ইন্ডেন, বার্নার্ড কোহন, নিকোলাস ড্রিকস, গৌরী বিশ্বনাথন, টমাস মেটকাফ ইত্যাদি। এঁদের প্রচুর গবেষণা করে শেষমেশ গ্রামশি আর ফুকো নির্দেশিত পথে এসে পড়েন এবং বলেন ইওরোপিয় সাম্রাজ্য স্থাপন শুধু উন্নত সেনাবাহিনী, উন্নত রাজনৈতিক সংগঠন এবং বিকশিত আর্থিক ক্ষমতার জোরে হয় নি, এর সঙ্গেও যোগ হয়েছিল জ্ঞানের ক্ষমতার জোরটুকুও – ড্রিকস যাকে বলছেন কালচারাল টেকনলজিস অব রুল। এই গবেষকেরা দেখাচ্ছেন কিভাবে গোটা ঔপনিবেশিক জ্ঞানএর চরিত্র – প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা – যেমন দৈনন্দিন কর্মের আদমসুমারি থেকে ইতিহাস বা জাতিতত্ত্ব বিষয়ের মত মৌলিক জিজ্ঞাসা শুধু অব্জেক্টিভ বাস্তবতা বিকাশেরর জন্যে ছিল না বরং ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র তৈরির কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়ে ছিল। তারা বলছেন এই ঔপনিবেশিক জ্ঞানের সঙ্গে সাম্রাজ্যের বিজয় মিলেজুলে, পরস্পরের সঙ্গে দেওয়া নেওয়া করে যে নতুন জ্ঞান তৈরি হল, সেই জ্ঞান ব্যবহার করে উপনিবেশের ভিত্তিভূমি তৈরি হয়। সেই ভিত্তিটিকে আরও জোরদার করার জন্যে আরও জ্ঞান বিকাশের প্রয়োজন অনুভূত হল, এবং এর ফলে রাজনৈতিক ক্ষমতা জোরদার হল। যদিও এই ঔপনিবনেশিক জ্ঞান উপনিবেশেই বিকাশ ঘটেছে, কিন্তু এটা শুধুই আর উপনিবেশের জ্ঞান হয়েই থাকল না – বরং এটি সাগরপার থেকে চলে আসা প্রিডিফাইনড ইওরোপিয় জ্ঞান হিসেবেই চিহ্নিত হল, কোহনের যাকে বলছেন ইনভেস্টিগেটিভ মোডালিটিজ – যেখানে পাতি সামাজিক এবং কৃষ্টিগত তথ্য সরবরাহকারক হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে ঔপনিবেশিক সমাজ। অন্য ভাষায় বলতে গেলে উপনিবেশ তৈরি করা ইওরোপিয় সমাজ, ঔপনিবেশিক নিষ্ক্রিয় বুদ্ধিজীবিদের ব্যবহার করেই ঔপনিবেশিক জ্ঞান তৈরি করছে। ড্রিকস আর কোহন বলছেন, উপনিবেশের সাব্জেক্টসরা ইতিমধ্যে তাদের অধিকার হারিয়ে ফেলেছে শুধু নয়, দেশিয় জ্ঞানকে ঔপনিবেশিকরা তুচ্ছ জ্ঞান করে তাকে পিছনের সারিতে সরিয়ে দিয়ে, সেই ফাঁকা যায়গায় আমদানিকরা ইওরোপিয় জ্ঞান হিংসকভাবে সবলে ঢুকিয়ে দ্যায়। একে এরা বলছেন জ্ঞানচর্চাগত হিংসা, যা ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র উপনিবেশের ওপর চাপিয়ে দ্যায়। এর আরেকটা সিদ্ধান্ত হল উপনিবেশ তার সাবজেক্টসদের তার শেকড়ে ফরতে বাধা দ্যায়, সব ধরণের দেশিয় জ্ঞান, কৃষ্টি প্রথার সমূলে উচ্ছেদ চালায়।
(চলবে)

No comments: