হস্তলেখাবিদ হলেন সেই সব করণিক
যাঁরা কলমের মোচড়ে লেখায় শিল্প ফুটিয়ে টোলার কাজে আত্মনিয়োগ করতেন। তারা শুধু যে
পুথি নকল করতেন তাই নয়, তারা সেই পুথির লেখাটার সৌন্দর্যকে অসাধারণভাবে ফুটিয়ে
তোলার কাজে তাদের অর্জিত দক্ষতাকে নিবেদন করতেন।
হস্তিলেখবিদের প্রাথমিক কাজ
লেখার সৌন্দর্যবর্ধন। ইসলামি যুগে হস্তলেখার বিপুল বৈচিত্র উদ্ভাবন হতে থাকে। এবং
সমাজের সর্বস্তরে এই শিল্পকে যথেষ্ট গুরুত্ব ও সম্মান দেওয়া হত।
১২০৩ খ্রির এক প্রখ্যাত
হস্তিলেখবিদের নাম তাকত মুস্তাসামি এবং নকশ লেখক হিসেবে তাঁর বিপুল সম্মান ছিল। ১৩২৪
সালে তিনি আভেন্নার শাফা নকল করে মহম্মদ তুঘলককে পাঠান। রাজা ব্যাপক খুশি হয়ে
তাঁকে ২০০ মিলিয়ন মিসকুয়াল মূল্যের সোনা পাঠান। হস্তিলেখবিদ এই দান তুচ্ছ মনে করে
ফিরিয়ে দ্যান।
প্রখ্যাত হস্তলেখাবিদ
খালিলুল্লা সাহ নউ-রসের একটি নকল দাক্ষিনাত্যের আদিলশাহকে পাঠান। এই কাজে তিনি এতই
মুগ্ধ হন যে তিনি শুধু তাকে কলমের রাজা উপাধি দ্যান তাই নয়, তার সিংহাসন শিল্পীর
বসার জন্যে কিছু সময়ের জন্যে ছেড়ে দ্যান।
নানান মুসলমান দেশের মতই
ভারতে হস্তরেখাশিল্প যথোচিতভাবে বিস্তারলাভ করে। তবে তার আগের সময়ের কিছু নিদর্শন
সময়ের ভ্রুকুটি সয়েও থেকে গিয়েছে।
হস্তলেখাশিল্প মুঘল সময়ে
শৈল্পিক দক্ষতার চূড়ান্ত শীর্ষে ওঠে। উপমহাদেশ সে সময় বিপুল পরিমান দক্ষ ও যোগ্য
হস্তলেখাবিদ তৈরি করেছিল যাদের কাজ আজও বিশ্বজুড়ে নানান জাদুঘর গ্রন্থাগার এবং
ব্যক্তিগত সংগ্রহে শোভা পাচ্ছে।
দক্ষ এবং যোগ্য হস্তলেখাবিদ
তাদের দক্ষতা এবং যোগ্যতা অনুযায়ী সম্মানিত হতেন। তাদের যে সব উপাধি দেওয়া হয়েছে,
সেগুলির মধ্যে ছিল জারিন-রাকম(সোনার লেখক), শিরিন-রাকম(মিষ্টি লেখক),
রৌশন-রাকম(উজ্জ্বল লেখক) মুসকিন-রাকম(সুগন্ধিত লেখক)।
শাহজাহানকে যে সব
হস্তলেখাবিদ নানান ধরণের উপহার দিয়েছেন, তাদের প্রত্যেককে তিনি ঈয়াক-সুতি (শতজীবি)
উপাধি দিয়েছেন।
হস্তলেখার উচ্চাঙ্গের শিল্প
হিসেবে যখন সমাদৃত হচ্ছে সে সময় বহু অনামী এবং ছাত্র প্রখ্যাত শিক্ষকদের নাম ধার
করে লেখা তৈরি করতেন। জইনুদ্দিনের মোসলেমএর ক্যালিগ্রাফি বইতে আমরা পাচ্ছি, মুল্লা
মীর আলির নামে বহু নকল তৈরি করেছিলেন মৌলানা খ্বাজা মুহম্মদ। তার ছাত্র সম্বন্ধে,
ছাত্রদের কাছে লিখিতভাবে মীর আলি অভিযোগ করছেন, কিছু সময়ের জন্য খ্বাজা মুহম্মদ
আমার ছাত্র ছিল, যতক্ষণ না তার হাতের লেখা একটা স্তরে বিকাশ লাভ করছে। আমি তার
বিরুদ্ধে যাই নি, সেও আমার কোন ক্ষতি করে নি, কিন্তু সে প্রচুর ভাল খারাপ লেখালিখি
করে আমার নামে স্বাক্ষর করে।
হস্তলেখাবিদ যারা তাদের কাজ
চরম দক্ষতায় তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন, তারা তাদের দক্ষতা সম্পর্কে প্রভূতভাবে সচেতন ছিলেন।
তার জন্যে তাঁরা জানও দিতে প্রস্তুত থাকতেন। জাহাঙ্গীরের প্রাণের হস্তরেখাবিদ
মুল্লা মীর আলি লিখছেন - আমার কলম চমতকার সৃষ্টি করে, এবং সে শিল্প শব্দের মানের
থেকেও অতিরিক্ত স্তরে উঠে যায়। আমার অক্ষরের বাঁক শেখানো আদে স্বর্গীয় দাসত্ব
স্বীকার করে নেওয়া, এবং প্রত্যেক রেখার মূল্য অসীমের দ্যোতক।
মুঘল আমলের শেষের দিকে
সাধারণ শিল্পকলা উৎসাহিত করা হতে থাকে। বাহাদুর শাহ নিজে শিল্পকলার অনুগামী ছিলেন,
এবং দাক্ষিনাত্যের সুলতানেরা যে ঐতিহ্য সৃষ্টি করেছেন তা হায়দারাবাদের নিজাম
বহুকাল পর্যন্ত বহন করে এনেছেন।
No comments:
Post a Comment