নবজাগরনীয় ভদ্রলোকেরা উপমহাদেশজুড়ে যে জ্ঞানচৌর্যবৃত্তি করেছেন, সেই প্রেক্ষিতে বিদ্যাসাগর মশাইএর কাজকর্মকে বোঝা দরকার। আমার মনে হয় তাঁর নানা কাজকে আমাদের আজ নিরামিশই মনে হবে - যদিও বিদ্যাসাগর মশাই বলেই বিষটি চোখে লাগে, অস্বস্তি বোধ হয়। সময়ের প্রেক্ষিতে তাঁর কিছু কাজে যে বৌদ্ধিক নৈতিকতার অভাব দেখি সেগুলোর বিশাল প্রভাব পড়েছিল এটাও মনে রাখা দরকার।
তিনি যা করেছেন সব প্রমিত সমাজের কাণ্ডারী ভদ্রলোকেদের উপকারের জন্যে - নিজের বা নিজের পরিবারের জন্যে একফোঁটা কিছুই করেন নি। তাঁর সময়ের প্রখ্যাতরা ব্রিটিশ সম্পদ লুঠের সঙ্গী হয়ে প্রচুর সম্পদ উত্তররজন্মের জন্যে রেখে গিয়েছেন, তিনি তা করেন নি - তাঁর শেষ কপর্দকটুকুও বেঁটে দিয়ে গিয়েছেন। সমাজের রাষ্ট্রের জন্য তিনি প্রাণ নিবেদন করে দিলেও, কলকাতার বিশ্বাসঘাতক প্রমিত সমাজ একটাও আন্দোলনে তাঁর পাশে দাঁড়াল না, বরং তাঁকে নানাভাবে অপদস্থ করার চেষ্টা করে গিয়েছে - রসময় দত্ত ঘটনা মনে করুণ।
কি ধরণের চুরির পরিবেশ? সে সময়ের একটা-দুটো উদাহরণ দেব। ভারতজোড়া উদাহরণ দিতে গেলে গোটা ফেবু পাতায় লিখেও লেখা ফুরোবে না।
ধরা যাক অয়ুর্বেদের কথা। এটি সংহিতা অর্থাৎ সঙ্কলন। অর্থাত চরক সুশ্রুত এবং যতদূর সম্ভব বাঙালি ভগভট্ট আলাদাভাবে তাত্ত্বিকভাবে স্বাস্থ্য নিদানগুলি আকাশ থেকে দৈববানী হিসেবে পান নি, বা নিজেরাও আবিষ্কার করেন নি - বরং নানান সমাজে প্রচলিত নিদানগুলি নিয়ে বহু সময় ধরে একটা কার্যকরী নিদান সংকলন বানাচ্ছেন। কিন্তু কোন নিদান কোন সমাজ থেকে তাঁরা ধার নিচ্ছেন, সে সূত্র রাখছেন না - মনে হচ্ছে এটি স্বয়ম্ভূ - আদতে তা প্রমিত চুরিই। আপনারা কি বলতে পারেন মেচ/রাভা/কুড়মি/সাঁওতাল/লোধা ইত্যাদি সমাজ তাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা আয়ুর্বেদ থেকে স্রেফ টুকেছে? তা অসম্ভব। গোটা ধারাটা প্রমিত ব্যবস্থা অপ্রমিত সমাজ থেকে চুরি করে নিজের নামে চালিয়ে দিয়েছে।
আসামের পালা বিজয়গুপ্তের মনসামঙ্গল বা দেওধনী - ওজাদের নাচের চলন দেখে বুঝবেন কি জটিল হস্তসঞ্চালন এবং পদসঞ্চালন - দেখতে ধ্রুপদী নাচের মত - আমিও লিখলাম ধ্রুপদী নাচের মত। ললিতা যখন অসমজুড়ে গবেষণা করছিল অধ্যাপকেরা তাকে বলে দিলেন এগুলি অপ্রমির সমাজ ধ্রুপদী ধারা থেকে নকল করে দেশিয়করণ করেছে। নানান বইতে তাইই লেখা আছে।
মনসাপুজা প্রেক্ষিতে আসামের মনসামঙ্গল ওজাপালিতে দেখিয়েছি কিভাবে প্রমিত সমাজ গোটা অপ্রমিত সমাজের নানা ধারা আত্মস্থ করছে এবং অপ্রমিত সমাজে যে সে রেণুগুলির চল ছিল সে স্মৃতি মুছে দিচ্ছে প্রমিত সমাজ-স্মৃতি থেকে। এবং আমরা গবেষণা করতে না গেলে জানতেই পারতাম না এই চুরি - হস্তমুদ্রা থেকে পদসঞ্চালন সব - সংস্কৃতওয়ালারা টুকন করেছে অবলীলায়। শুভঙ্কর পণ্ডিত(লাহিড়ী/চক্রবর্তী) এগুলি সঙ্কলন করলেন শ্রীহস্তমুক্তাবলীতে। এটি হয়ে উঠল ভারতীয় নৃত্যশাস্ত্রের একমাত্র আকরগ্রন্থ - অথচ সূত্র নেই কোথা থেকে তারা পেলেন। পরে গ্রাম সমাজের গভীরে গিয়ে এসব জানতে পারলাম।ভরতনাট্যমের যা আঢাউ, সত্রীয়ায় তা মাটি আখরা - যা নাচের মৌলিক একক। সত্রীয়ায় তা স্থানীয় অসংস্কৃত নামে পরিচিত জানলাম - এই হস্তমুদ্রাগুলি স্থানীয় পাখি ইত্যাদি নামে সংজ্ঞায়িত। কিন্তু শুভঙ্কর পণ্ডিতমশাই যখন টুকছেন তখন সেই দেশিয় নাম সংস্কৃতগন্ধী হয়ে যাচ্ছে, দেশিয় রেশ চলে যাচ্ছে - এবং স্থানীয় সূত্রগুলিও উবে যাচ্ছে।
বিদ্যাসাগর মশাই যখন প্রমিতদের উদ্ধারে রত তখন এই সব দুষ্কর্ম চলছে সারা উপমহাদেশে ইংরেজদের তাত্ত্বিকতায় ইওরোপিয় ক্ল্যাসিক্যালতা নকল করে ধ্রুপদীত্ব তৈরির বাসনায়। ভদ্রলোকেদের সমাজে উঠতে জ্ঞানচুরি, ঐতিহ্যচুরিই একমাত্র পথ। উপমহাদেশে যা কিছু লোকের ব্যবহার্য সব কিছু সৃষ্টি করেছে তো ছোটলোকে। পলাশীর আগে ভদ্রলোকেদের সংখ্যা কত আর বাংলার কৃষ্টিতে তাদেরই বা অবদান কত?
বিদ্যাসাগর মশাইকে এই চুরির প্রেক্ষিতে মনে হয় দেখতে হবে। এই প্রমিত ভদ্রলোকিয় চৌর্যবৃত্তির আবহাওয়ায় বিদ্যাসাগর মশাই ভাষাকে উদ্ধার করছেন যবনী মিশেল থেকে। তিনি এই চৌর্যাবহাওয়ায় এবং মেকলের তাত্ত্বিককতায় দেশিয় কৃষ্টিতে সার্বিক ঘৃণা তৈরির পরিবেশ তৈরি হল তিনি সেই আবহাওয়াতেই উষ্ট হচ্ছেন তাঁর মত করে। তিনি সেই পরিবেশের ধাক্কা প্রতিহত করতে পারছেন না। দ্বারকানাথের মত সঙ্গী হচ্ছেন।
যখন বুঝছেন তখন আর ফেরা উপায় নেই। পাশার দান তিনি চেলেই দিয়েছেন।
No comments:
Post a Comment