বিদ্যাসাগর মশাইকে নিয়ে Arjundeb Sensarma খুব আকর্ষণীয় কিছু প্রকাশনা করেছেন। সব ক'টাতে আমাদের প্রবেশ অনধিকারতুল্য। তিনি এবং অনল পাল অসাধারণ বিতর্ক চালিয়েছেন, উভয়কে কারিগরদের পক্ষ থেকে আন্তরিক অভিনন্দন।
এ প্রসঙ্গে একটা কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে রাখা দরকার যে তিনি আমাদের চোখে আঙ্গুল দেখিয়ে বললেন, অন্নদামঙ্গল বিদ্যাসাগর মশাই পড়াতে অস্বস্তিবোধ করতেন, অথচ সেই অন্নদামঙ্গল ফোর্টউইলিয়াম কালেজের বরাতে ছাপলেন, এবং অর্জুনদেব এই তথ্যটি বিষয়ে যথোচিত মন্তব্য "যা বিশ্বাস করি না,তা যদি বিক্রয় করি,হয় তা হিপোক্রেসি,নয়তো অবচেতন। কেউ যদি অন্য কিছু বোঝেন,জানাবেন।"
এ রকমই একটি প্রকাশনায় অর্জুনদেবের সঙ্গে আমাদেরও কিছু আলোচনা হয়। প্রাসঙ্গিক অংশ নিচে তুলে দেওয়া গেল। তিনি মন্তব্য করেছিলেন, বিদ্যাসাগর মশাই "অবিমিশ্র সাম্রাজ্যবন্ধুও নন,অবিমিশ্র সাম্রাজ্যশত্রুও নন"। এই অংশটাকে ধরে আমাদের মধ্যে কিছু আলোচনা হয়।
---
আমরা লিখলাম -
"অবিমিশ্র সাম্রাজ্যবন্ধুও নন,অবিমিশ্র সাম্রাজ্যশত্রুও নন" এর মানে কি দাঁড়াল জানি না।
আমরা মনেকরি সে যুগে চরিত্রের দিক থেকে সংযমের দিক থেকে অসামান্য ব্যতিক্রমী বিদ্যাসাগর অবশ্যই সাম্রাজ্য বন্ধু ছিলেন, যে অর্থে ব্লেয়ার বি ক্লিং দ্বারকানাথকে পার্টনার ইন এম্পায়ার বলেছেন। দ্বারকানাথ দেখছেন তাঁর ব্যাঙ্ক তাঁর সামনে ব্রিটিশ করণিক এবং প্রখ্যাত আমলা লুঠ করছে অথচ তিনি নিজে সেই লুঠগুলির ভর্তুকি দিচ্ছেন, এবং কড়ার করে নিচ্ছেন তার টাকা শোধ(সে যুগে কয়েক লক্ষ টাকা) কেউ যেন না জানে।
বিদ্যাসাগর মশাই নীলমাধব মুখোপাধ্যায়ের থেকে ৬০০ টাকা ধার নিয়ে(৬০০ টাকার কেনার ক্ষমতা কত ছিল? ১৮২০ সালে তাঁর বাবা মাসে ২টাকা রোজগার করে বাড়িতে উদ্বৃত্ত মায়ের কাছে পাঠাবার কথা ভাবছেন) সংস্কৃত ডিপোজিটারি প্রেস তৈরি করার পরেই ফোর্ট উইলিয়ামের সম পরিমান টাকার বইএর বরাত পান। একটা বইএর দাম পড়ল ৬টাকা! এবং যে অন্নদামঙ্গল পড়তে তিনি "রীতিমত সঙ্কোচ বোধ করতেন" সেটি তিনি প্রাইম দামে ছাপলেন।
তাকে কে পৃষ্ঠপোষকতা করল? ফোর্ট উইলিয়াম কালেজ।
তিনি সিপাহী হ্যাঙ্গামের সময় টালবাহানার পরে তার বিদ্যালয়কে ব্যারাক করার জন্য ছেড়ে দিলেন। কেন? বুঝি। তিনি সাম্রাজ্যের পৃষ্ঠপোষকতায়, ভদ্র-সমাজের 'ক্লেদ' সরাতে লড়ছেন। তারপক্ষে বিন্দুমাত্রও সাম্রাজ্য শত্রু হওয়া অসম্ভব।
এডামের সমীক্ষা দেখেছেন কি না জানা নেই। মেকলের প্রস্তাবের প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে বিরোধিতা করেন নি।
ফলে নবজাগরনীয় ভদ্রলোকেরা তাঁকে মহান বানাবেন সেটাই স্বাভাবিক।
কিন্তু তাতে ছোটলোকেদের, আম-গাঁইয়াদের কী?
উত্তরে Arjundeb Sensarma বললেন
ঠিক,সবই ঠিক।কিন্তু বহুবিবাহ,স্ত্রীশিক্ষা,বিদ্যালয়প্রসার এগুলি ভাববেন না?
বাংলাভাষার প্রচার,এমনকি মুসলিম সমাজেও আবেদন পাঠানো-এও তো তিনি করেছেন।ভদ্রদের উপর ক্রুদ্ধ হতেও শিখিয়েছেন।
চেতনা বুর্জোয়াসিতে উপর থেকেই তো নিচের দিকে নামে।
এখন,এদেশে স্বাভাবিক পথে আধুনিকতা আসেনি।এসেছে মিশ্র পথে।সে পথ যদি আজ সরল হয়,মঙ্গল।
ঠিকই তো। তাই জন্যে লিখেছি 'তিনি সাম্রাজ্যের পৃষ্ঠপোষকতায়, ভদ্র-সমাজের 'ক্লেদ' সরাতে লড়ছেন'। আপনি যে বিষয়গুলো বলছেন সেগুলি মূলত ভদ্র সমাজের আভূষণ। তিনি ভদ্রদের ওপর ক্রুদ্ধ হয়েছেন কেন? তার জীবন ভদ্র সমাজের সেবায় উতসর্গ করে দিলেও, সে সময়ের ঔপনিবেশিক ভদ্র সমাজ তার এজেন্ডা অনুযায়ী এগোয় নি, তার পাশে দাঁড়ায় নি। প্রতিপদে বাধা দিয়েছে। তিনি ক্রুদ্ধ হয়ে ছোটলোকেদের দিকে মুখ ফিরিয়েছেন। ছোটলোকেদের দিকে মুখ ফেরানো তার প্রথম অপশন ছিল না কিন্তু, তার সেরা সময়টা তিনি ভদ্রলোকেদের জন্যেই বরাদ্দ করেছেন।
--
এবারে আধুনিকতার প্রবাহ নিয়ে...
ভদ্রলোকিয় আধুনিকতা নিয়ে জোর প্রশ্ন আছে আমাদের। আগামী নভেম্বরে বালুরঘাটে তিনদিন পোস্টমর্ডানিজমএর বিরুদ্ধে মূলত কবিরা আমাদের ডেকেছেন একটা বেলা ছোটলোকেদের জগত নিয়ে আলোচনা করতে - পোস্টমডার্নিজম অর্থে তারা বলছেন পরম্পরার বিপরীতে আধুনিকতার পোস্ট/খাম্বা গেড়ে দেওয়ার চেষ্টা। তাদের মতে ভদ্র ইওরোপেরত পদপ্রান্তে প্রশ্ন হীন নিমজ্জ ভদ্র বাঙালি পোস্টমর্ডানিজমের বাংলা ভুল করেছে উত্তরআধুনিকতা; আসলে এটা নতুন করে ঐতিহ্য বিরোধী লুঠেরা খুনি অত্যাচারী আধুনিকতার খুঁটি গাড়া।
সেই জন্যে আড়াইশ বছরতে এত অর্থ ব্যয় এত ঢাকঢোল বাজিয়েও গোটা উপমহাদেশের প্রশ্নহীন মাত্র ৬% মানুষ আনুগত্যময় আধুনিকতার পথে যাত্রা করেন তার পূর্বজের শেকড়-বাকড় মুড়িয়ে, বাকিও ৯৪% পশ্চিম আর আধুনিকতার মুখে মুড়ো ঝাঁটা মেরে শেকড়ে গেড়ে থাকেন আধুনিকতার ধ্বজাধারী নেহেরু প্রণীত ইওরোপের জাতিবাদী রাষ্ট্র/করপোরেটদের অতি অত্যাচার সয়েও। ঠিক সেই জন্যে উপমহাদেশে আধুনিকতার বাহন ইংরেজি শেখাতে বিপুল অর্থ ব্যয় হলেও অধিকাংশ গাঁইয়া তা আপন করেন না। আজও আধুনিকতার ধ্বজাধারীদের পরম পুজ্য অশ্লীলঅম মেকলে - যে জন্যে বিদ্যাসাগর মশাই থেকে শুরু করে তার সময়ের একজনও মেকলের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে দাঁড়ান না।
শেকড়ে আছি বলেই লুঠেরা পরমুখাপেক্ষী ইওরোপমন্য হই নি।এটাই আমাদের জোর। উপমহাদেশের মানুষের জোর।
সেই জন্যে অসামান্য বিদ্যাসাগর শেষ পর্যন্ত ঔপনিবেশিক ভদ্রলোকেদের আইকন হয়েই থেকে যান, চৈতন্য হতে পারেন না।
প্রায় দেড় হাজার বছর ধরে ইংলন্ডে কিভাবে ভদ্রলোকেরা পাগান জীবনযাত্রা, আসলে যা ইওরোপের দীর্ঘ গ্রামীন পরম্পরা, ধ্বংস করে লুঠ খুন অত্যাচারের নবজাগরনীয় আধুনিকতা নিয়ে এলেন, তা নিয়ে প্রচুর কাজ হয়েছে - এই ছোটলোক ধ্বংসকারী ভদ্রলোকিয় পথটা যুক্তিবাদী অক্ষয় দত্ত মহেন্দ্র সরকার ইত্যাদিরা অনুসরণ করেছেন কোন প্রশ্ন না করেই। তারা আধুনিক লুঠেরা প্রযুক্তির গুরু বেকনিয় মানসিকতার লোক চাইলেন অর্থাৎ ইওরোপ যেভাবে গত ৩০০ বছর ধরে প্রকৃতির ওপর প্রভুত্ব করেছে, প্রকৃতির সন্তানদের ওপর লুঠ, খুন অত্যাচার চালিয়েছে সেটাই তারা বাঙ্গালিদের কাছে চাইলেন। মিলের দর্শন তো তাই। বাবা-ছেলে উভয়েই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির তাত্ত্বিক এবং গোয়েন্দা বাহিনীর পরামর্শদাতা। ফলে লুঠেরাদের নিয়ে তার এবং নবজাগরনীয়দের উৎসাহ যে ছিল এটা হয়ত উপমহাদেশের গাঁইয়ারা টের পেয়েছেন। তাঁরা বিদ্যাসাগরের এত ভালকরার চেষ্টা সত্ত্বেও তাঁর ভালত্বের দিকে পা মাড়ান নি ছোটলোকেরা ।
তিনি শেষ করলেন
আধুনিক ভদ্রতা যে গ্রামীণ মানুষের মূল চরিত্রকে ভ্রষ্ট করেছে,তা নিয়ে দ্বিধার অবকাশ নেই।
যে ভারতবর্ষ নিজেই প্রচুর প্রস্থানে সত্যকে দেখতে,পরীক্ষা করতে অভ্যস্ত ছিল,তা আপনার থেকে বেশি কেউ জানে না।
এমনকী আপিনিই যেভাবে মধ্যকালীন ভারতের বিজ্ঞানচর্চার দিগদর্শন করেন,তা খুবই প্রশংসনীয়।
ইউরোপীয় তত্ত্বপ্রস্থানে,এক বা দুয়েকজন ছাড়া কেউই যে নির্দ্বিধায় ভারতে প্রযুক্ত নন,তা আজকাল অনেকেই আলোচনা করেছেন।
পোস্টমডার্নিস্ম ও বিদেশ থেকে আমাদের শেখার কথা নয়।আর সবাইকে পোস্টমডার্ণিস্ট হতে হবে তাও নয়।
No comments:
Post a Comment