১) বিপিনবাবু ১৮০০ সালের প্রথম দিকে লুসিংটন নামে এক আমলার শিক্ষা সমীক্ষার কথা বলেছেন, সে সম্বন্ধে কেউ কিছু জানেন?
২) বিপিনবাবু শুধু হেমলতার কথা বলেছেন বৈষ্ণব জগতে মা-গোঁসাইরা ছিলেন প্রভূত ক্ষমতাবান। তিরিশ বছর আগে ননীবালা নাম্নী এক মা গোঁসাই দেখেছি। Bidhan Biswas Somnath Roy আরও ভাল বলতে পারবে।
৩) কাশীতে বিজয় কৃষ্ণ গোস্বামী সূত্রে যে মহিলার নাম করেছেন, তিনি যতদূর সম্ভব হটী বিদ্যালঙ্কার, বা রূপমঞ্জরী, নারায়ণ সান্যালের উপন্যাস, এনাকে আর হটুকে বিদ্যালঙ্কারকে নিয়ে।
বাংলায় মহিলা শিক্ষা বিষয়ে অসাধারণ লিখেছেন দীনেশ সেন মশাই।)
বিপিনবাবুর লেখা থেকে তুলে দিলাম...
...মা লেখাপড়া জানিতেন না, সেকালে হিন্দু স্ত্রীলোকদিগের লেখাপড়ার রীতি ছিল না। অন্ততঃ আমাদের অঞ্চলে মেয়েরা লেখাপড়া শিখিতেন না। লোকের সংস্কার ছিল যে, বালিকারা লেখাপড়া শিখিলে বিধবা হয়। এ সংস্কারের উতপত্তি কিসে পরে জানিয়াছি; বাল্যকালে বা প্রথম যৌবনে জানি নাই।
সেকালে বাংলা দেশে দুই শ্রেণীর স্ত্রীলোকেরা লেখাপড়া শিখিতেন। এক শ্রীশ্রীমৎ চৈতন্য মহাপ্রভুর অনুগত বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের মহিলারা। গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের ধর্ম্মগ্রন্থ বাংলাতেই রচিত। চৈতন্য-ভাগবত, চৈতন্য-মঙ্গল ও চৈতন্য-চরিতামৃত এই তিনখানিই বাংলার বৈষ্ণবদিগের প্রধান ধর্ম্মপুস্তক। অন্যান্য হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্ম্মপুস্তক সংস্কৃততে লেখা। সংস্কৃত শিক্ষা করা অতিশয় কষ্টসাধ্য। সুতরাং ধর্ম্ম প্রয়োজনে অন্যান্য সম্প্রদায়ের সাধারণ লোককে লেখাপড়া শিখিতে হইত না।
কিন্তু বৈষ্ণবদের প্রধান ধর্ম্মগ্রন্থগুলি বাংলায় রচিত বলিয়া বর্ণজ্ঞান লাভ করিলে বাঙ্গালী মাত্রই এইগুলি পড়িতে পারেন। এই কারণে মহাপ্রভুর অনুগত বৈষ্ণব মণ্ডলে স্ত্রীপুরুষ সকলেই প্রায় বাংলা বর্ণজ্ঞান লাভ করিতেন। মহিলারা মহাপ্রভুর অনুগত বৈষ্ণবদিগের একজন গুরু ছিলেন। আচার্য্য প্রভুর কন্যা হেমলতা বৈষ্ণবদিগের এওকজন গুরু ছিলেন। বৃন্দাবনে বাঙ্গালী বৈষ্ণব মহিলাদের মধ্যে প্রায় সকলেই লেখাপড়া জানিতেন। ৫০।৬০ বৎসর পূর্ব্বে একজন বাঙ্গালী মহিলা বৃন্দাবনে ভাগবত ব্যাখ্যা করিতেন। তাঁহার ব্যাখ্যা শুনিবার জন্য স্ত্রীপুরুষ মিলিয়া জনতা করিতেন, পূজ্যপাদ বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী মহাশয়ের মুখে এই কথা শুনিয়াছি। গোস্বামী মহাশয় বাঙ্গালী ভদ্রমহিলার ব্যাখ্যা শুনিয়াছিলেন। বাংলার বৈষ্ণব সম্প্রদায়ে স্ত্রী পুরুষ প্রায় সকলেই যে লেখাপড়া জানিতেন অপরেও ইহার সাক্ষ্য দিয়া গিয়াছেন। বিগত খৃষ্ট শতাব্দীত প্রথম দিকে ইংরাজ রাজকর্মচারী লুসিংটন বাংলাদেশের লোকের মধ্যে কতটা পরিমাণে লেখাপড়ার প্রচার আছে ইহার তদন্ত করিয়াছিলেন। বাংলার বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের মধ্যে সাধারণ শিক্ষার বহুল প্রচার ছিল, তাঁহার রিপোর্টে এইরূপ প্রকাশ পাইয়াছিল। খৃষ্টিয়ান পাদ্রীরা যখন এদেশে বালিকা বিদ্যালয় খুলিতে আরম্ভ করেন তখন বৈষ্ণব সম্প্রদায় হইতেই বিদ্যালয়ের শিক্ষয়িত্রী নিযুক্ত হইতেন।
আর এক শ্রেণীর মহিলারা বা বালিকারা লেখাপড়া শিখিতেন। উত্তরবঙ্গে বা বারেন্দ্রভূমিতে মুসলমান আমল হইতেই অনেক হিন্দু জমিদার আছেন। যে সকল পরিবারের সংগে ইহাদের বিবাহ সম্বন্ধ হইত তাঁহাদের মধ্যেও স্ত্রীশিক্ষা বহুল পরিমানে প্রচলিত ছিল। ইহার কারণ এই যে, কি জানি যদি দুর্ভাগ্যক্রমে অকাল বৈধব্য উপস্থিত হয় তাহা হইলে জমিদারির তত্ত্বাবধানের ভার ইঁহাদের উপরে পড়িতে পারে; আর সে অবস্থায় লেখাপড়া জানা না থকিলে বিষয় রক্ষা করা কঠিন হইয়া পড়িবে। এইজন্য উত্তর-বঙ্গে বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ ও কায়স্থদিগের মধ্যে মেয়েরা লেখাপড়া শিখিতেন।
সূত্রঃ সত্তর বৎসর - বিপিন চন্দ্র পাল
No comments:
Post a Comment