"বাখতিন আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন উচ্চতম মার্গ সংস্কৃতিতে শব্দ আর অর্থএর রকমফের থাকলেও তা সীমার মধ্যে আবদ্ধ, প্রত্যাশিত এবং ব্যকরণ-সম্মত। সব কিছুই সেখানে সূত্রে এবং নিয়মে বেঁধে ফেলা হয়। সংস্কৃত আর আরবী ব্যাকরণের সঙ্গে পরিচিত যে কোন লোকই এই কথার যথার্থ্য স্বীকার করবেন। অন্যদিকে নিম্নকোটির সংস্কৃতিতে শব্দ আর অর্থের সীমা নিয়ত পরিবর্তনশীল, অপ্রত্যাশিতের আর 'আকস্মিকতার' চমক সেখানে অনেক বেশি। কারণ নানা সূত্রে আহৃত রসদ সম্পূর্ণ ভিন্ন অর্থে সেখানে ব্যবহার হতে পারে, উৎসের আর সূত্রের সমত্ব থাকে না, নিয়মের নিগড়ও সেখানে হালকা হয়ে যায়, অর্থের সীমারেখা হয়ে পড়ে দুর্নিরীক্ষ্য।
মধ্যযুগের ইতিহাসে উতসব বা কার্নিভ্যালের সময় কী করে চিরাচরিত প্রথাগুলোর আনুষ্ঠানিক বিপরীত আচরণ বাস্তবে বিদ্রোহের জন্ম দিত, তার নানা সুন্দর বিবরণ আছে। যা 'স্বাভাবিক' তা হঠাৎ বদলে যেত, হত 'অস্বাভাবিক' সময় সময় শাসক শ্রেণীর হাতের বাইরে সামগ্রিক পরিস্থিতি চলে যেত। ব্যবহারিক ক্ষেত্রে অর্থ আর শব্দ, প্রথা আর রীতির উৎসে অসমত্ব থাকে। তার ফলে পরিবর্তনশীলতা, রঙ বদলানোর ক্ষমতা, 'আকস্মিকতা' নিম্নকোটির সংস্কৃতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হয়ে পড়ে। সেই ক্ষেত্রে কোন কাঠামোয় ধারা আর বোঝাও দুরুহ। নিম্নকোটির শব্দের অর্থের তার নানান চিহ্নের এই রূপান্তর, পরিবর্তনশীলতা আর নমনীয়তা নানান ঐতিহাসিক উপাদানের ওপর নির্ভরশীল। কার মার্ফতে শব্দ আর তত্ত্ব প্রচারিত হচ্ছে? ঐতিহ্য পরম্পরাতেই ভগবতের কথক ঠাকুর এবং মঙ্গলকাব্যের গায়ক বা জারিগানের গায়েন গভীর ধর্মতত্ত্বের কথা বলবেন কিন্তু ঘরানা আলাদা, বিষয় আলাদা, অর্থেরও নানা প্রতিসরণ ঘটবার সম্ভাবনা আছে।
আবার জুলুমের বিরুদ্ধে ইমানের জেহাদ কোম্পানির আমলে আর রঞ্জিৎ সিংহের রাজত্বে যে অর্থ আনবে, অন্য জালিম মুসলমান শাসকের বাদসাহিতে তার অর্থ সেরকম হবে না। সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিস্থতি সেক্ষেত্রে ভিন্ন। ঠিক একই কারেওণে সাঁওতাল বিদ্রোহের(১৮৫৫) সময় সুভো ঠাকুরের আবির্ভাব আর বাণী এবং বিদ্রোহের চরম পরাজয়ের অভিজ্ঞতার প্রেক্ষিতে ভগীরথ মাঝি(১৮৭৪) ও দুবিয়া গোঁসাইয়ের আবির্ভাব(১৮৮০) আর প্রচার সাঁওতালি সমাজে সম অর্থ বহন করে না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ঠাকুর বনাম মারাং বুরুর ধারণাও বদলে যায়।
আবার কৌম আর জনসংস্কৃতির আঞ্চলিক জোর ও ক্ষমত কেন্দ্রও ক্ষেত্র বিশেষ বিবেচ্য হতে পারে। ফুরফুরা শরিফের সনাতনী ইসলামি পথে যাত্রা এবং ঘুটিয়ারি শরীফের নানান অনুষ্ঠানে সহজিয়া আচার ভক্তের মনে 'উরসকে' দুই জায়গায় দুই ভিন্ন মাত্রায় চিহ্নিত করেছে। তাই যে কোন ভাষায় তথা সংস্কৃতিতে চালু শব্দের আভিধানিক অর্থ জানান দরকার ব্যকরণও পড়া প্রয়োজন। কিন্তু শুধু সেটাই যথেষ্ট নয়। শব্দের অর্থ জানা যায় কাব্য বিন্যাসের মধ্যে, নানা অন্বয়ের প্রেক্ষিতে, বাচকের কথার সুরে, লেখার ভঙ্গীতে। নিম্নকোটির সংস্কৃতি তথা রাজনীতিতে হিন্দু আর মুসলমান ধর্মের নানা রূপের প্রকাশ বোঝার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।"
No comments:
Post a Comment