বাংলা দেশের ইতিহাস – দ্বিতীয় খণ্ড - রমেশ্চন্দ্র মজুমদার
সুলতানি আমল
রাজ্যের বিশিষ্ট পদাধিকারীর নাম ছিল উজির – সাধারণভাবে মন্ত্রী বোঝাত – কখোনো সেনা নায়ক আবার আঞ্চলিক শাসনকর্তাও বোঝাত। সীমান্ত অঞ্চলে সামরিক শাসনকর্তা লস্করে-উজির বা শুধু লস্কর নিযুক্ত করা হত। প্রধান আমীরের উপাধি ছিল আমীর-উল-উমারা আর প্রধানমন্ত্রীদের কেউ কেউ খান-ই-জাহান উপাধি পেতেন। অমাত্য মন্ত্রী পদস্থ কর্মীরা খান মজলিস, মজলিস-অল-আরা, মজলিস-আলম, মজলিস-অল-মুয়াজ্জম, মজলিস-অল-মজলিস, মজসিস-বারবক উপাধি পেতেন। সুলতানের সচিবের নাম ছিল দবির, প্রধানের উপাধি দবির-খাস।
বঙ্গালহ রাজ্য কতগুলো ইকলিম-এ বিভক্ত ছিল। ইকলিমের উপবিভাগ ছিল অরসহ। বাংলা সাহিত্যে উপবিভাগগুলিকে মুলুক তাদের শাসন-কর্তাদের মুলুক-পতি বলা হয়েছে। বিজয় গুপ্তে আবার তকসিম নাম পাওয়া যাচ্ছে।
দুর্গহীন শহর হল কসবাহ। দুর্গওয়ালা শহর হল খিটটাহ। সীমান্ত রক্ষার ঘাঁটি হল থানা।
কয়েকটি রাজস্ব-অঞ্চলে বঙ্গালাহ রাজ্যটি বিভক্ত ছিল – এগুলি মহাল – কয়েকটি মহাল নিয়ে শিক – শিকএর প্রধান শিকদার। রাজস্ব দুই ধরণের যুদ্ধের লুণ্ঠনের গনীমাহ আর খরজ। যুদ্ধের চারের পাঁচ অংশ সেনাবাহিনীর মধ্যে বেঁটে দেওয়া হত আর যে একপঞ্চমাংশ রাজকোষে যেত তার নাম গনীমাহ। খরজ তোলার জন্য জমিদার/সামন্তদের ভার দেওয়া হত – সপ্তগ্রামের শাসক হিরণ্য আর গোবর্ধন মজুমদারকে বছরে বিশ লক্ষ টাকা খরজ তলার দায়িত্ব দিয়েছিলেন হোসেন শাহ – যার মধ্যে আট লক্ষ প্রাপ্য ছিল সুলতানের। খরজ নিয়ে যারা রাজধানীতে আসত তাদের নাম ছিল আরিন্দা। রাজস্বের প্রধান কর্মচারীর নাম ছিল সর-ই-গুমাশ-তাহ। জলপথের মাল পরিবহনের যে রাজস্ব ঘাট দিয়ে সংগ্রহ করা হত তার নাম কুতঘাট (তাই কি কলকাতার কুদঘাট?)। বাংলায় যে সব পণ্য আসত – যেমন চন্দন, তা অবাধে বাংলার বাইরে নেওয়া যেত না।
রাজনৈতিক আর সামরিক বাহিনীর প্রধান ছিলেন সুলতান। সামরিক অভিযানগুলির প্রধানের নাম ছিল সর-ই-লস্কর। সৈন্য চতুরঙ্গে ভাগ ছিল – গজ, ঘোড়া, পদাতিক আর নৌ বহর। পদাতিকদের বলা হত পাইক। সেনারা তীর ধনুক ছারাও বর্শা, বল্লম আর শূল ব্যবসার করত। শর আর শূল ছোঁড়ার যন্ত্রের নাম ছিল আরাদা আর মঞ্জলিক। ১৫২৯এর কামান চালানোর জন্য বাংলার বাহিনীর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে।
দশজন সেনা নিয়ে একটা বাহিনী তৈরি হত – এদের নায়কের উপাধি ছিল সর-ই-খেল – এটা বাহিনীর ছোটতম একক। প্রত্যেক খানের অধীনে দশজন মালিক, প্রত্যেক মালিকের অধীনে দশজন সিপাহসালার, প্রত্যেক সিপাহসালারের অধীনে দশজন সর-ই-খেল এবং প্রত্যেক সর-ই-খেলের অধীনে দশজন করে আশ্বারোহী থাকত।
নৌবহরের অধিনায়ককে বলা হত মীর বহর। রণবাহিনীর বড় শক্তি ছিল হাতি। বাংলার হাতির মত ভাল যুদ্ধ হাতি দেশে পাওয়া যেত না।
No comments:
Post a Comment