তথ্যভিত্তি - সামাজিক ইতিহাসের ধারাঃ বিনয় ঘোষ
মুখবন্ধ
মুখবন্ধ
প্রাথমিকভাবে বলে নেওয়া দরকার আমাদের প্রিয় প্রবন্ধকার বিনয় ঘোষ অন্যান্য ভারতীয় মার্ক্সবাদীর মত মোটামুটি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত নব্যভারত গড়তে বড় কর্পোরেট পুঁজি, নব্য নিয়ন্ত্রণমূলক প্রযুক্তি এবং ইওরোপিয় পরিচালন ব্যবস্থার দায়িত্ব এবং কর্তব্য বিষয়ে যথেষ্ট গুণগ্রাহী এবং যুব মার্ক্সের ব্রিটিশ রাজত্বের প্রথমে বাংলার পরে ভারত জোড়া উৎপাদন ব্যবস্থা ভাঙ্গাকর্মর ঔপনিবেশিক তত্ত্ব আর নিদানের চরমতম সমর্থক-ভক্ত ছিলেন। প্রথম জীবনে নবজাগরণীয় তত্ত্বে মুখ ডুবিয়ে এবং শেষ জীবনে সেই তত্ত্ব থেকে বেরিয়ে এসেও তাঁর মূল অভিযোগ, আক্ষেপ ছিল বাংলায় বড় সম্পদওয়ালা জমিদার থাকা সত্ত্বেও কেন বড় পুঁজির বিনিয়োগ তৈরি হল না – কেন বাংলায় ইওরোপিয় শিল্পবিপ্লব তৈরি হল না। তাঁর আরও বড় অভিযোগ চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত জমিদার আর রায়তদের জন্য আদর্শ পরিকল্পনা ছিল – সেটা বাঙালি জমিদারদের অদূরদর্শিতায় আর অবিমৃশ্যকারিতায় বিফলে যায়। পরিকল্পনাটা ঠিকঠাক রূপায়িত হলে গ্রাম বাংলায় ঘি-মধুর স্রোত বইত – এবিষয়ে তিনি ব্রিটিশ পরিকল্পনার বিন্দুমাত্র গলদ দেখতে পান নি। আমরা যারা পুঁজি বিহীন উৎপাদন ব্যবস্থার অংশিদার, তারা মনে করি শিল্পবিপ্লবীয় কর্পোরেট বড় পুঁজির কাজই হল লুঠ খুন আর দখলদারি।
প্রবন্ধটি তৈরি হয়েছে বিনয়বাবুর বাংলার সামাজিক ইতিহাসের ধারা বইটির গ্রাম্য সমাজের পরিবর্তনের গতি অধ্যায় ভিত্তি করে। আমাদের গোটা প্রবন্ধই তার তত্ত্বের সমালোচনা। সেই বইতে তিনি কোনভাবেই ব্রিটিশ পরিকল্পিত নব্য চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের জমিদারিত্বকে ব্রিটিশ লুঠেরা কর্ম বলে আখ্যা দিচ্ছেন না তার পরবর্তী কালের সাবঅল্টার্ন ঐতিহাসিকদের মতই – বরং বলছেন চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে জমিদারদের এমন কতগুলি ক্ষমতা দেওয়া হল যাতে জমিদারেরা তাঁদের অস্তমিত সুদিন ফিরিয়ে আনতে পারেন। কিন্তু চিরদিনের বিলাসিতার অভ্যাস ও স্বভাবশৈথিল্যের জন্য জমিদারদের অনেকেই নির্দিষ্ট দিনক্ষণে দেয় রাজস্ব মেটাতে পারে নি – তাদের অজুহাত প্রজাদের দুরবস্থা ও খাজনা অনাদায়। তাই শাস্তিস্বরূপ ব্রিটিশেরা সূর্যাস্ত নিয়মে তাদের জমিদারি নিলামে তুলত।
অথচ বিনয়বাবুর আগেই দাদাভাই নৌরোজী বা রমেশ দত্ত চিরস্থায়ী বন্দোবস্তকে প্রগতিশীল নীতি বলেও ব্রিটিশ লুঠের কাছা খুলে দিচ্ছেন। উলটে বিনয়বাবু মন্তব্য করছেন জমিদারি বিষয়ে ব্রিটিশ চর্চার উদ্দেশ্য প্রাথমিকভাবে লুঠকর্মর পথ বাছা নয়, বরং লক্ষ্য ছিল, এদেশের বনেদি জমিদারেরা বাস্তবিক ভূসম্পত্তির কোনো বংশানুক্রমিক স্বত্ত্ব ভোগ করতেন কিনা, এবং যদি করে থাকেন তাহলে তাঁদের সামাজিক আর্থনীতিক সঠিক ভূমিকা বা রূপ কী ছিল, তাই নিয়ে পণ্ডিতি আলোচনা। ...ইংরেজরা যখন বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার দেওয়ানি লাভ করে, তখন থেকে ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রবর্তন পর্যন্ত, প্রায় ২৮ বছর ধরে, শুধু আলোচনা নয়, রাজস্ব-সংগ্রহের নানারকম কৌশলের ভিতর দিয়ে এদেশের জমিদারদের সামাজিক রূপ বিদেশী শাসকদের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ঐতিহাসিক বা প্রথানুগ রূপ যতটা নয়, জমিদার সম্বন্ধে তাঁদের নিজস্ব ধারনাগত রূপই তার চেয়ে অনেক বেশি তাঁদের কাছে বাস্তব সত্যরূপে প্রতিভাত হতে থাকে। এই ধারণাগত রূপ অবশ্য ইংরেজদের প্রশাসনিক স্বার্থগত রূপ। এই প্রশাসনিক স্বার্থ লুঠ না শুদ্ধ প্রশাসন উপহার দেওয়ার উদ্যম, সে সম্বন্ধে তিনি নীরব।
No comments:
Post a Comment