তথ্যভিত্তি - সামাজিক ইতিহাসের ধারাঃ বিনয় ঘোষ
১৭৯৩এর চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের লুঠ কর্মের হাতিয়ার। পলাশির পরে পরেই ক্লাইভের গাধা মিরজাফরের ঘাড় ভেঙ্গে বাংলা লুঠের প্রবর্তনা শুরু ক’রে সাম্রাজ্যের পক্ষে এদেশে শাসনভার চালানো ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। ক্লাইভের পর হেস্টিংস এসেছেন লুঠের কাজে দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে – ইতোমধ্যে ঘটে গিয়েছে ছিয়াত্তরের গণহত্যা – বাংলা ও পূর্ব ভারত জুড়ে পলাশীর পাঁচ বছর পর থেকেই ফকির-সন্ন্যাসীদের নেতৃত্বে গ্রামীনদের লড়াই শুরু হয়েছে। থরথর করে কাঁপছে বাংলা। ব্রিটেনে শুরু হয়েছে কেন্দ্রিভূত প্রযুক্তি, পরিচালনা এবং সাম্রাজ্য লুঠের সম্পদভিত্তিক শিল্পবিপ্লব নামক এক লুঠেরা উৎপাদন ব্যবস্থা – যার স্থায়িত্ব এবং বেড়ে ওঠা সে দিন থেকে আজও নির্ভর করছে বৈদেশিক সাম্রাজ্য লুঠের সম্পদের ওপর। ফলে ব্রিটেনে নব্য উৎপাদন ব্যবস্থাকে চালিয়ে যেতে বাংলায় লুঠেরা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ব্যবস্থার প্রাথমিক কাজ হল স্থানীয়দের ব্রিটিশ লুঠের কাজে জুড়ে নেওয়া – যা শুরু হয়েছিল পলাশী পরবর্তী সময়ে দেবীসিংহ, কাশিনাথ, নন্দকুমার, রেজা খাঁ, নবকৃষ্ণ, কান্তবাবু, গঙ্গাগোবিন্দ সিঙ্গি মার্ফত। কলিকাতার কথায় রায়বাহাদুর প্রমথনাথ মল্লিক লিখছেন (লুঠের আর অত্যাচারে) দেবীসিংহ, কাশিনাথ, নবকৃষ্ণ, কান্তবাবু ও গঙ্গাগোবিন্দ পঞ্চপান্ডব ও ওয়ারেন হেস্টিংস শ্রীকৃষ্ণ ছিলেন। বাংলায় সেই লুঠকর্মটি কত ভাল ও সুচারুভাবে হতে পারে, সেটি নিয়ে তাত্ত্বিক আলোচনা করেন হেস্টিংস, গ্রান্ট, শোর, কোলব্রুক, হ্যারিংটন, ফিলিপ ফ্রান্সিস সহ বহু সাম্রাজ্য বিশেষজ্ঞ – যে কর্মকে ব্রিটিশমুগ্ধ বিনয়বাবু বলছেন জমিদারি বিষয়ে তাত্ত্বিক আলোচনা।
জমিদারদের স্বরূপ নির্নয়
বিনয়বাবু ব্রিটিশপূর্ব জমিদারদের বুঝতে হ্যারিংটনের তত্ত্ব টেনেছেন। ১৭৮০ থেকে ১৮২৩ পর্যন্ত চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের লুঠের স্বর্ণযুগে হ্যারিংটন কোম্পানির বড় আমলা হিসেবে কাজ করেছেন। ফলে তার মতকে গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা করেছেন বিনয় ঘোষ – এবং উল্লেখযোগ্য হ্যারিংটন চাকরিতে ঢোকার মাত্র তিন দশক আগেই সুলতানি প্রশাসন বাংলায় রীতিমত বর্তমান ছিল। তিনি ব্রিটিশপূর্ব জমিদারির চরিত্র সম্বন্ধে বলছেন, এদেশে জমিদারেরা এমন এক শ্রেণীর জীব যাঁদের এক কথায় ইংরেজি ভাষায় কোন পরিচয় দেওয়া যায় না। রাষ্ট্রের পক্ষে রায়ত ও জমির উপসত্ত্বভোগীদের কাছ থেকে আঞ্চলিক রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব পালন করেন জমিদার। জমিদারির উত্তরাধিকার তিনি লাভ করেন বটে, কিন্তু নতুন করে দেশের সম্রাটের কাছ থেকে তার জন্য সনদ নিতে হয় এবং সম্রাটকে পেশকাশ ও প্রাদেশিক নাজিমকে নজরানা দিতে হয়। জমিদারি তিনি কিনতে পারেন, তবে তার জন্য সম্রাট ও নাজিমের কাছ থেকে অনুমতি নেওয়া বিধেয়। এক দিক থেকে তাঁকে তাঁর জমিদারির নির্দিষ্ট রাজস্বের বাৎসরিক কন্ট্রাক্টার বা ইজারাদার বলা যায়। অন্য কোন কর্মচারী বা ইজারাদার দিয়ে গভর্নমেন্ট যদি, বিশেষ কোন কারণে, সেই রাজস্ব আদায়ের ব্যবস্থা করেন, তাহলে জমিদারকে তার জন্য উচ্ছেদ করা হয় না, আলাদা ও কিছু সম্পত্তি দিয়ে তাঁকে পোষণ করা হয়। অষ্টাদশ শতকের গোড়ায় দেখা যায় নিজস্ব এলাকার মধ্যে জমিদার ‘আওবাব’ ও ‘কর’ আদায়ের আধিকার ভোগ করছেন। এই অধিকারও নিরঙ্কুশ নয়, দেশিয় সরকার যখন খুশি হস্তক্ষেপ করতে পারেন। নিজের জমিদারির কাজকর্মের সুবিধার জন্য প্রজাদের কাছ থেকে জমিদার নানারকমের উপঢৌকনও আদায় করতে পারেন। তাঁর নিজস্ব অঞ্চলে শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষার প্রাথমিক দায়িত্ব তাঁর উপর ন্যস্ত থাকে, অথচ এক্ষেত্রে তাঁর সম্পূর্ণ দায়িত্ব স্বীকার করা হয় না।
বিনয়বাবু ব্রিটিশপূর্ব জমিদারদের বুঝতে হ্যারিংটনের তত্ত্ব টেনেছেন। ১৭৮০ থেকে ১৮২৩ পর্যন্ত চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের লুঠের স্বর্ণযুগে হ্যারিংটন কোম্পানির বড় আমলা হিসেবে কাজ করেছেন। ফলে তার মতকে গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা করেছেন বিনয় ঘোষ – এবং উল্লেখযোগ্য হ্যারিংটন চাকরিতে ঢোকার মাত্র তিন দশক আগেই সুলতানি প্রশাসন বাংলায় রীতিমত বর্তমান ছিল। তিনি ব্রিটিশপূর্ব জমিদারির চরিত্র সম্বন্ধে বলছেন, এদেশে জমিদারেরা এমন এক শ্রেণীর জীব যাঁদের এক কথায় ইংরেজি ভাষায় কোন পরিচয় দেওয়া যায় না। রাষ্ট্রের পক্ষে রায়ত ও জমির উপসত্ত্বভোগীদের কাছ থেকে আঞ্চলিক রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব পালন করেন জমিদার। জমিদারির উত্তরাধিকার তিনি লাভ করেন বটে, কিন্তু নতুন করে দেশের সম্রাটের কাছ থেকে তার জন্য সনদ নিতে হয় এবং সম্রাটকে পেশকাশ ও প্রাদেশিক নাজিমকে নজরানা দিতে হয়। জমিদারি তিনি কিনতে পারেন, তবে তার জন্য সম্রাট ও নাজিমের কাছ থেকে অনুমতি নেওয়া বিধেয়। এক দিক থেকে তাঁকে তাঁর জমিদারির নির্দিষ্ট রাজস্বের বাৎসরিক কন্ট্রাক্টার বা ইজারাদার বলা যায়। অন্য কোন কর্মচারী বা ইজারাদার দিয়ে গভর্নমেন্ট যদি, বিশেষ কোন কারণে, সেই রাজস্ব আদায়ের ব্যবস্থা করেন, তাহলে জমিদারকে তার জন্য উচ্ছেদ করা হয় না, আলাদা ও কিছু সম্পত্তি দিয়ে তাঁকে পোষণ করা হয়। অষ্টাদশ শতকের গোড়ায় দেখা যায় নিজস্ব এলাকার মধ্যে জমিদার ‘আওবাব’ ও ‘কর’ আদায়ের আধিকার ভোগ করছেন। এই অধিকারও নিরঙ্কুশ নয়, দেশিয় সরকার যখন খুশি হস্তক্ষেপ করতে পারেন। নিজের জমিদারির কাজকর্মের সুবিধার জন্য প্রজাদের কাছ থেকে জমিদার নানারকমের উপঢৌকনও আদায় করতে পারেন। তাঁর নিজস্ব অঞ্চলে শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষার প্রাথমিক দায়িত্ব তাঁর উপর ন্যস্ত থাকে, অথচ এক্ষেত্রে তাঁর সম্পূর্ণ দায়িত্ব স্বীকার করা হয় না।
বিনয় ঘোষ বলছেন, জমিদারির স্বরূপ-নির্ণয়ের এই প্রকাশভঙ্গী থেকে বোঝা যায় যে এই প্রথা বুঝতে ব্রিটিশদের কি বেগ পেতে হয়েছে। রাষ্ট্রীয় নিয়মের বাঁধা সড়কে নয় সামাজিক প্রথার বেড়াজালেতেই ব্রিটিশপূর্ব জমিদারিত্বের বিকাশ ঘটেছে। ফলে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে এমন একটা কাঠামো তৈরি করতে হল তা তাদের রাজত্বের পূর্বসূরীদের পরিকল্পনার তুলনায় সহজবোধ্য – আমাদের ভাষায় লুঠকর্মে কার্যকরী এবং সামগ্রিকভাবে সাম্রাজ্য এবং ব্রিটিশ বিকাশপন্থী। হ্যারিংটন তাই বন্দোবস্তের পরবর্তী জমিদারদের সংজ্ঞা দিচ্ছেন জমিদার তাঁর জমিদারির মালিক – উত্তরাধিকার, দান বা কেনাবেচা থেকে তিনি এই মালিকানাসত্ত্ব লাভ করতে পারেন – তার দায়িত্ব হল – তার জমিদারির নির্দিষ্ট স্থায়ী রাজস্ব যথাসময়ে গভর্মেন্টকে পরিশোধ করা। তাঁর দেয় রাজস্ব চুকিয়ে দিয়ে তিনি আইনসঙ্গতভাবে উপসত্ত্বভোগী ও প্রজাদের কাছ থেকে অতিরিক্ত মুনাফা ও খাজনা যতটা সম্ভব আদায় করতে পারেন এবং তা ভোগও করতে পারেন। পতিত জমি বা বনজঙ্গল হাসিল করা জমি প্রজাদের বিলি করতে পারলে তার খাজনা তাঁর প্রাপ্য ও ভোগ্য হবে।
তবে ব্রিটিশমুখী জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকার লিখছেন, ইংরেজদের ভূমিরাজস্বনীতির প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলির আসল উৎস হল মুর্শিদকুলি খাঁ। সেই বৈশিষ্ট্যগুলির পরিচ্ছন্ন ও কঠোর রূপ দিয়েছিলেন কর্নওয়ালিস চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বিষয়ে আলোচনার প্রবেশের আগে বোঝা যাক মুর্শিদিকুলি খাঁর প্রণীত রাজস্ব নীতি কি ছিল। কেননা আলিবর্দি খানও তার পূর্বসূরীর রাজস্ববন্দোবস্ত পাল্টান নি। এই ব্যবস্থার ওপর দাঁড়িয়ে ব্রিটিশদের পলাশী পরবর্তী লুঠ কর্মের পরিকল্পনা তৈরি করতে হয়েছে।
No comments:
Post a Comment