ইমান ও নিশান থেকে এই পর্বে শেষ কিছু কথা...
কীসে থেকে কীসে রূপান্তর? নিছক 'ধর্মীয়' আন্দোলন থেকে রাজনৈতিক আন্দোলন? অথচ এর মধ্যে বীরসার পরিচিতিই বিপরীত মুখে পালটে গেল। নিছক রাজনৈতিক নেতা থেকে তিনি হলেন ধর্মীয় নেতায়, অলৌকিক পুরুষে। আন্দোলনের চরিত্র রূপান্তরিত হল ধর্মীয় থেকে রাজনৈতিক এবং নেতা রূপান্তরিত হলেন রাজনৈতিক থেকে অলৌকিক পুরুষে।
আসলে এই স্ববিরোধিতার উৎস হচ্ছে যে পূর্ব ভারতের কৃষক আন্দোলনের অন্যতম অগ্রগণ্য ঐতিহাসিক এখনও কোন কোন পর্যায়ে ধর্ম ও রাজনীতির মধ্যে ফারাক টানেন, বিশ্বাস করেন যে কতগুলি বিশেষ ক্ষেত্রেই ধর্ম ও রাজনীতি অঙ্গাঙ্গীভাবে মিলেমিশে যায়। যেমন মুণ্ডাদের ক্ষেত্রে, যেমন উপজাতিদের সমাজে। ধর্ম আর রাজনীতির সম্পর্কে কোন অনিবার্যতা নেই। তার মধ্যে ভেদ আছে, ছেদ আছে; ঐতিহাসিক পরিস্থিতিতে একটা আরেকটায় রূপান্তরিত হয়।
এ কথা অনস্বীকার্য যে ধর্মবিশ্বাস অনড় নয়, তাতে অভিযোজন হয়, আন্দোলন মাফিক ধর্মের নিজস্ব রূপ থাকে, রূপের অন্তরও হয়। কিন্তু ক্ষমতা বিন্যাস যদি রাজনীতির মর্মবস্তু হয় তবে প্রাক-ঔপনিবেশিক বা ঔপনিবেশিক সমাজে এমন কোন ধর্ম বিশ্বাস নেই যা রাজনীতি রহিত। আসলে রাষ্ট্রকেন্দ্রিকতা অথবা রাজনীতি সম্পর্কে এক বিশেষ ধারণা নিম্নবর্গের আন্দোলন আমাদের রাজনীতির কতগুলি লক্ষ্মণ খুঁজতে প্রণোদিত করে; যেমন সঙ্গঠনের নেতা, প্রচারক, অনুগামীদের কার্যবিধি আর কার্যক্রমের ছককে। সেই সব লক্ষ্মণের ব্যতিরেকে আমরা ক্ষমতাকে চিনতে পারি না, সেই সব লক্ষ্মণের ভিত্তিতে আমরা কতকগুলি আন্দোলনকে ধর্মীয়, কতকগুলি আন্দোলনকে রাজনৈতিক বলি। অবশ্যই নিম্নবর্গের কতকগুলি আন্দোলন তুলনামূলমকভাবে আপসকামী ও কতকগুলি তুলনামূলকভাবে প্রতিবাদী। ফলে তাদের রাজনীতিও আলাদা। কিন্তু নিম্নবর্গের চৈতন্যে এমন কোন ধর্মবোধ নেই যা ক্ষমতা রহিত অথবা রাজনীতি বিবর্জিত। নিম্নবর্গের নিম্নতম আন্দোলনও যে আদর্শ থাকে তা দীন বা আদাব দ্বারা পরিষিক্ত, তা শুধু সংহতি বা জমায়েতের সূত্র নয়। আদর্শ ছাড়া, রাজনীতি ছাড়া নিম্নবর্গের আন্দোলন হয় না এবং সেই রাজনীতির মূলে থাকে কোন না কোন ইমান বা বিশ্বাস।
ধার্মিক ঐতিহ্যের পুনর্নির্মিতির ধারণার পাশাপাশি আরেকতি প্রতীতি সম্পর্কে আমাদের সচেতন থাকা দরকার। দূরদর্শন বা ইতিহাসের পাঠ্যপুস্তকের মাধ্যমে বর্তমান ভারতীয় শাসকশ্রেণী বার বার সেই প্রতীতিই লোকেদের কাছে পেশ করছেন। তা হল এক সমস্বর অতীতের ধারণা। এর তাগিদ আসে বুর্জোয়ার ক্ষমতার ইচ্ছা থেকে, নানা সময়, নানা চৈতন্যকে বুর্জোয়ারা একটি সমীকরণের মধ্যে আনতে চেষ্টা করে। যেরকম বাজারে একীকরণ দরকার, সেরকম দরকার ভাষার একীকরণ, অতীতের একীকরণ, তা না হলে বুর্জৈয়া জাতীয় রাষ্ট্রের ইতিহাস লিখতে পারে না।
এই দর্শনের নান্দীমুখ পাঠ করেছেন জওহরলাল নেহরু তাঁর 'ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া'য়। নিজের জবানীতে স্বীকার করেছেন যে ত্রিশের দশকের দিনগুলিতে রাজনৈতিক প্রচারের সময় তিনি বার বার চেষ্টা করেছেন অগণিত কৃষকের কাছে প্রশ্ন করতে ভারতমাতা বলতে তারা কী বোঝে। জাঠ কৃষকদের কাছে ভারতমাতার অর্থ তার জমি, তার চষা মাঠ। নেহরু তাদের কাছে তুলে ধরে ছিলেন এমন এক ছবি যা তাদের গ্রাম জমিকে ছাড়িয়ে অনাদি অনন্ত ভারতের ধারণা হাজির করেছিল। distinctively Indian, with the same national heritage and the same set of moral and mental qualities.
নেহেরুর এই ভারত আবিষ্কার প্রকৃতপক্ষে জাঠ কৃষকের ভারতমাতার ধারণা থেকে বহু দূরে, তাদের দেশ আর সময়ের ধারণাকে আত্মসাৎ করে এমন এক ভারতের দর্শন তৈরি করেন যার সাহায্যে শাসকশ্রেণী র স্বার্থে এক পরম কেন্দ্র গড়ে তোলা যায়, যেখানে ভারতীয় ঐতিহ্য আর ঐক্যকে বিজায় রাখার দাবিতে কেন্দ্রের নিঃশর্ত সর্বময় গুরুত্বে আস্থা রাখা যায়। কিন্তু অতিআধুনিক কালেও আমাদের অভিজ্ঞতা দেখায় যে রাষ্ট্রীয় আধিপত্যের ব্যাপকতা সত্ত্বেও বুর্জোয়ার সর্বেশ্বরতা আজও অসম্পূর্ণ। বিহারের সশস্ত্র প্রাঙ্গণে বুর্জোয়া রাষ্ট্রের সশস্ত্র ফৌজ আজও লোরিক সেনা, ভূমি সেনা, কুঁয়র সেনার সঙ্গে হাত মেলায়।
ঐ অর্থে ভারতীয় ইতিহাস আজও অসমস্বর। ...আজও নিম্নকোটির মানুষেরা বুর্জোয়া রাষ্ট্র ও দর্শনের নতুন ভাষা সেভাবে আত্মস্থ করে নি যাতে করে সে ধার্মিক ঐতিহ্যকে সম্পূর্ণ পরিত্যাগ করে তার চেতনা ও সত্ত্বাকে সম্পূর্ণভাবে নতুন ভাষায় বলতে পারবে। জাতীয়তাবাদী যোজকদের হাজারো চেষ্টা সত্ত্বেও উত্তোরণের সেই কাজ অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে। এই অসমতার যন্ত্রণা আর সমস্যা কারুরই চোখ এড়িয়ে যাবার কথা নয়।
No comments:
Post a Comment