ইমান ও নিশান থেকে আরও কিছু
প্রথমত, এই এলাকাভিত্তিক ছোট ছোট বিদ্রোহগুলি সমাজের নানান ক্ষেত্রে আধিপত্য ও পরবশ্যতার সংঘাতকে চিহ্নিত করে। ঐ সব বিন্দুগুলিকে না চিনলে আমরা ক্ষমতার পুরো ইতিহাস ধরতেই পারব না। বুঝতেই পারবনা কী করে প্রাক-ধনতান্ত্রিক বা ঔপনিবেশিক সমাজে নানা ক্ষেত্রে গ্রামে ও গঞ্জে ক্ষমতা বিন্যাসের ছক কীভাবে বিন্যস্ত আছে। বৃহত্তর কাঠামোর ভিত সেই ক্ষেত্রেই প্রোথিত আছে।
দ্বিতীয়ত মার্ক্স নিজে সচেতন ছিলেন এই বলে যে সামন্ততান্ত্রিক সমাজে আধিপত্য ও পরবশ্যতার সম্পর্ক কীভাবে সরাসরি রাজনৈতিক(directly political) ও ঘনিষ্ঠভাবে মানবিক (human, intimate) রূপেই প্রকাশিত হয়। ওয়াতন দাঁড়ায় এক ধরণের সীমিত জাতীয় পরিচয়(a constricted sort of nationality)। তাই প্রাক ধনতান্ত্রিক সমাজে কৃষকের রাজনৈতিক সত্তাকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারি।
তৃতীয়ত ক্ষমতার সব কেন্দ্রই, আধিপত্যের সব ভাবাদর্শই কোন না কোন বিপরীতের সঙ্গে বন্ধনে ও সংঘাতে আবদ্ধ। আদর্শ বা কার্যক্ষেত্রে যে কোন কায়েমি ক্ষমতার নির্ধারক নীতি বিপরীতের অবস্থানকে স্বীকার করতে বাধ্য। সত্যযুগ/কলিযুগ, লক্ষ্মী/অলক্ষ্মী, ধর্ম/অধর্ম/আপদ্ধর্ম-এর ধারণা আমাদের অজানা নয়। বিপরীতের সব রূপকে না বুঝে, ক্ষুদ্রকে না ধরে বিক্ষিপ্তকে চিহ্নিত না করে কেউ বৃহত্তর ক্ষমতা কেন্দ্র বা একাধিপত্য নির্মাণ বা বিনির্মাণ করার কোন কাজে হাত দেয় না। বিক্ষিপ্ত বিদ্রোহ বা প্রতিবাদী আদর্শের প্রভাবকে বৃহত্তর কাঠামো কখোনোই অস্বীকার করতে পারে না। সেই জন্যই ত লেখা হয় নানা চিঠি-চাপাটি, ঢাউস প্রতিবেদন, ব্যর্থ বিদ্রোহের অভিজ্ঞতার আলোকেই সাজান হয় নূতন করের ক্ষমতার খুঁটি, তৈরি করা হয় রাজধর্ম/প্রজাতত্ত্বের তত্ত্ব। নিজস্ব ভাবমূর্তিতে আত্মবিশ্বাস ছাড়া কোন ক্ষমতাই টিকে থাকতে পারে না। নানাভাবে নিম্নকোটির রাজনীতি বা চৈতন্যকে আত্মসাৎ করার চেষ্টা উচ্চকোটি সবসময় করে চলে। নিম্নকোটিরপরবশ্যতা ও আনুগত্যের সক্রিয় অভিজ্ঞতা ব্যতিরেকে শোষণ শ্রেণীর রাজনীতি গঠিত হতে পারে না।
চতুর্থত, হবসবম বা নরেন্দ্রকৃষ্ণ সিংহ মহাশয়ের চিন্তাধারার মধ্যে পরম কেন্দ্রিকতা বা রাষ্ট্রীয়তার ঝোঁক আছে। রাজনৈতিক ইতিহাসের সর্বোত্তম প্রকাশ কেন্দ্রিয় রাষ্ট্রের ইতিবৃত্ত, এই ধারনায় তাঁরা যেন বিশ্বাসী। তারই মাপকাঠিতে তাঁরা অন্যান্য সামাজিক ক্ষমতার চাহিদাকে দেখেন। কিন্তু রাষ্ট্রের সার্বিকতার বাইরে ক্ষমতা সম্পর্ক যে অন্যভাবে আবর্তিত হতে পারে এবং ক্রমে তা রাষ্ট্রকেই মোকাবিলা করতে পারে, সেই ইতিহাসের মাত্রা যে আলাদা সেটাকে বোঝা ও তার মধ্যে হাজারো নিহিত সম্ভাবনাকে তুলে ধরা হয়ত জরুরি। তা না হলে রাষ্ট্রের ইতিহাসের মধ্যেই সমাজের যাবতীয় অভিজ্ঞতাকে আমরা ধরব, বিচার করব, ভুলে যাব আমাদের স্বপ্ন যে রাষ্ট্র একদিন থাকবে না, কিন্তু রাষ্ট্রহীন সমাজ থাকবে।
No comments:
Post a Comment