ঘেন্না করি হাওয়াই চটি
মমতার মেগালোম্যানিয়াকি
আরও কিছু কথা
দীপঙ্করদা আমায় দয়া করে ট্যাগ করেছেন একটি প্রকাশনায়।
যে উত্তর তৈরি করা গেল তাতে সেটা সেখানে ধরল না, ফলে বাধ্য হয়ে সেটি এই সময়ক্রমে তুলে দেওয়া গেল।
উনি লিখছেন বঙ্গজশহরকুলতিলক বামপন্থীরা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে মেগানোম্যানিয়াক বলছেন - এর থেকে বড় হাসির তত্ত্ব আর কি হতে পারে!
বামপন্থীদের সমস্যা হল, এত দিন তারা যে ইওরোপকেন্দ্রিকতায় জারিত হয়ে সাংস্কৃতিক, সামাজিক, আর্থিক এবং সাংস্কৃতিক তাত্বিক সৌধ তৈরি করে ছিলেন ভারত এবং এই সাম্যময়তার দ্বীপসম বাংলায়, হঠাতই তা খান খান হয়ে ভেঙে পড়তে চলেছে, বুঝছেন। বাহ্যিকভাবে ধুতিপাঞ্জাবি পরা ভদ্রলোক বামপন্থীরা মানসিকভাবে যে ইওরোপমুখ্য(বর্তমানে আমেরিকা, যা পূর্বের ইওরোপিয় শাসক কড়া চাবুকে চালিত) সেটি একটা ঘোমটা পরা ভদ্রলোকিয় চরম সত্য - যার জন্য পরম্পরার জ্ঞানচর্চায় তারা খুব একটা বিশ্বাসী নন, বিদ্যুতহীন দেশিয় প্রযুক্তির বদলে বড় পুঁজির লুঠেরা, খুনি, ব্যক্তিনিয়ন্ত্রণকারী প্রযুক্তিতে অনেক বেশি স্বচ্ছন্দ। যতদিন মমতা বন্দ্যো বাংলাকে লন্ডন সুইজারল্যান্ড বানাবার পরিকল্পনা দেখিয়েছিলেন, ততদিন তারা ক্ষমাঘেন্না করে তাঁকে কিছুটা হলেও যায়গা দিয়েছিলেন, মেনে নিচ্ছিলেন, কিন্তু এই নির্বাচন এবং তৎউত্তর সময়ে যেভাবে দেশের মাটি আঁকড়ে পড়ে থাকছেন মমতা, তাতে তাদের প্রায় এক শতকব্যাপী সময় ধরে ইওরোপকেন্দ্রিক সাম্রাজ্য-স্বপ্ন যে সত্যই ভেঙে পড়ার মুখে, সেটি শুধু সময়ের অপেক্ষা তা দিন দিন পরিষ্কার হতে চলেছে।
আর বামপন্থীরা কাকে মেগালোম্যানিয়াক বলছেন? ইওরোপিয় এই সমাজতাত্ত্বিক জ্ঞানচর্চা বড় পুঁজির নেতৃত্ব ইংরেজি শিক্ষিত মধ্যবিত্তকে সমাজের কেন্দ্রস্থলে বসিয়েছে আর সবাইকে প্রান্তিক, নিম্নবর্ণ, সাবঅল্টার্ন দেগে দিয়েছে - এর থেকে বড় মেগালোম্যানিয়া আর কি হতে পারে! তাদের সমস্ত তাত্ত্বিক অস্তিত্ব দাঁড়িয়ে রয়েছে এই পিরামিডসুলভ সামাজিক পরিকাঠামো তত্ত্বের ওপরে, যেখানে মধ্যবিত্ত অজ্ঞ, কুসংস্কারাচ্ছন্ন, সভ্যতার ষড়ৈশ্বর্য না দেখা গ্রামীনদের গ্রামের জ্ঞানচর্চা-প্রযুক্তিচর্চা প্রায় ধ্বংস করে মধ্যবিত্তের তৈরি ইওরোপকেন্দ্রিক সমাজে নিয়ে আসার(আর এক ধরণের ঘর ওপসি)পথ প্রদর্শকের ভূমিকা নিচ্ছে। তারা যে সামাজিক, গণতান্ত্রিক, জ্ঞানচার্চিক পরিকাঠামো তৈরি করেছেন ইওরোপিয় তাত্ত্বিকদের অনুসরণে, সেটি তখন পরিপূর্ণ কেন্দ্রিভবনের রূপ পাবে - এবং স্বাভাবিকভাবেই অন্যান্য অইওরোপিয়, গ্রাম-ভারতীয় তাত্ত্বিক জ্ঞানচর্চার পরিকাঠামো ধ্বংস হবে কালের প্রভাবে - ঠিক এই জন্য মেকলিয় জ্ঞানচর্চায় 'এদেশে জন্মে পদাঘাতই শুধু পেলাম' জাতীয় হাহাকার এবং একটু চেষ্টায় ইওরোপ, বর্তমানে আমেরিকা প্রবাস এবং গ্রামীণদের মুখ না দেখা তজ্জনিত শান্তি কেনার দিকে ঝোঁক।
তাই ক্রমশ তাদের দাঁত নখ বেরিয়ে আসছে, কিন্তু দেশজ কালের তত্ত্বের প্রভাবে সেগুলো যে ক্রমশ অকেজো হয়ে পড়ছে তা টেরটি পাচ্ছেন না। মধ্যবিত্ত কেন্দ্রিকতার তাত্ত্বিক কাঠামো ইওরোপে সফল হয়েছিল আড়াই বছর আগে ইওরোপে গ্রাম আর কেন্দ্রিভূত খ্রিষ্টধর্মের বাইরে যা কিছু তাত্ত্বিক পরিকাঠামো যেমন পাগান সহ সমস্ত অ-খ্রিস্টিয় জ্ঞানচর্চা(মূলত গ্রামীন) সব ধ্বংস করে দেওয়ায়। শিল্পবিপ্লবীয় এককেন্দ্রিক মানবতাহীন সামরিক-খ্রিষ্টিয়-সাম্রাজ্যবাদী ধর্মীয় জ্ঞানচর্চাকে ধর্মনিরপেক্ষতার ঘোমটা পরিয়ে সারা বিশ্বের কাছে পরিবেশন করেছে - তার অযুত উদাহরন চন্দ্রকান্ত রাজু অন্তত ইওরোপিয় অঙ্কচর্চা বিশ্লেষণে পেশ করেছেন - এবং চেষ্টা করলে অন্যান্য জ্ঞানচর্চায় সেটিও পাওয়া যেতে পারে।
কিন্তু ভারতে সেই গ্রামীন পাগান জ্ঞানচর্চা প্রযুক্তি ধ্বংস করার আপ্রাণ চেষ্টা করে গিয়েছেন বামপন্থীরা ইওরোপের ভাড়াটে খুনি হিসেবে - কিন্তু তাদের হতাশা বাড়ছে - কেননা তারা যে কাজে দায়িত্বপ্রাপ্ত সে কাজটি এখনও তারা ঠিকঠাক করে উঠতে পারেন নি। বিগত ৩৪ বছর ধরে বাংলার কয়েক হাজার বছরের গ্রামীন জ্ঞানচর্চাকে তারা ভারতে চর্চিত ইওরোপিয় জ্ঞানচর্চার ধারায় আত্তীকরণ করার বহু চেষ্টা করে গিয়েছেন, যে কাজটা মন দিয়ে করেছেন নেহেরু-মহলানবীশ তাদের ইওরোপকেন্দ্রিক পরিকল্পনায়, বিকাশের উদ্যমে। এবং যে জন্য কয়েক কোটি ভারতীয় গ্রামীন উচ্ছেদ করে, তাদের প্রযুক্তি, জ্ঞানচর্চা ধ্বংস করে, শহরের বাড়বাড়ন্ত করে, উছেদ হওয়া গ্রামীনদের শহরে নিয়ে এসে প্রায় দাস বানিয়ে যে উন্নয়নের বার্তা পৌছে দিতে চেয়েছে তার জন্য আজও নেহেরু-মহলানবীশ বামপন্থীদের কাছে অসম্ভব প্রাসঙ্গিক।
আজকে নরেন্দ্র মোদি যে অর্থনৈতিক আদর্শ নিয়ে চলেছেন, তার সঙ্গে নেহেরুর অর্থনৈতিক আদর্শের মোটাদাগের পার্থক্য নেই - শুধু পার্থক্য মোদিভাই পুঁজি ছাড়া মধ্যবিত্তের সরাসরি পুনর্বাসনের জন্য রাষ্ট্রীয় উদ্যম নিয়ে ভাবছেন না - আজ আর মধ্যবিত্তের সেই রাষ্ট্রীয় খুঁটিটার প্রয়োজন নেই - সম্পদ লুঠের কাজে তারা বড় পুঁজিকে সাহায্য করার কাজে নিজেরাই দড় হয়ে উঠেছে।
কিন্তু বাংলায় চেষ্টা করেও সে কাজ করা যাচ্ছে না - গ্রামকে ফোক বা লৌকিক সমাজ দেগে দিয়ে ইওরোপমুখী উন্নয়নের যে চেষ্টা গত ৩৪ বছরে হয়েছে বাংলায়, তাতে ইওরোপিয়কেন্দ্রিকতাকেই মুখ্য ধরে চলার চেষ্টা হয়েছে - কিন্তু কাজের কাজ যে কিছু হয় নি বাংলায় বামেদের ক্ষয়িষ্ণু প্রভাব তার প্রমান। ফলে যুগ পাল্টাচ্ছে - বামপন্থীরা ক্রমশ প্রাসঙ্গিকতা হারাচ্ছেন, তাদের তৈরি সামাজিকতার ঘরেই।
তাই আজ আর গ্রামীন পুনর্বাসন নয় - উল্টে এবারে হবে মধ্যবিত্ত পুনর্বাসন - ইওরোপিকেন্দ্রিক সাদাচামড়াকে ভগবান-ধ্রুব করে এগোনো সাধুরা সাবধান।
সঙ্গে সৌভিকের কিছু প্রশ্নের উত্তরে আমাদের জবাব-
ধন্যবাদ সৌভিক, এই তিনিটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জোড়কলম করার জন্য। প্রযুক্তিকে আমরা দেখি কয়েকটি স্তরে ১) সেটি কার দখলে আছে, ২) উৎপাদনে তার ভূমিকা কি, ৩) সে প্রকৃতিতে কি প্রভাব ফেলছে।
প্রযুক্তির নিয়ন্ত্রণ কার হাতে উৎপাদন প্রক্রিয়ায় নিয়ে আলোচনা এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আজও বিদ্যুৎ ছাড়া তাঁতে সব থেকে ভাল কাপড় হয়। বিদ্যুৎ জুড়ে অন্তত তাঁতিদের ক্ষেত্রে উৎপাদনের গুণমান খুব একটা বাড়ে নি। ১৭৫৭ পর্যন্ত যে পরিমান উৎপাদন হত এবং যে গুণমানে পণ্য ভারতীয় তাঁতি উৎপাদন করতেন, সেখানে সামগ্রিক উৎপাদন ব্যবস্থায় তাতে দক্ষিণ ভারতের তাঁতিদের নিয়ে প্রসন্নন পার্থসারথি বা ডাচেদের বাংলার তাঁত নিয়ে যে কাজ দিল্লি স্কুল অব ইকনমিক্সের ওম প্রকাশ করেছিলেন, তাঁতে পরিষ্কার, ভারতের তাঁতিরা ইওরোপের তাঁতিদের তুলনায় অনেক বেশি রোজগার করতেন এবং উৎপাদন ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণে, এমন কি দাদনও ফেরত দিতে পারতেন তারা, বেশি এবং ইওরোপিয়, এশিয় এবং আফ্রিকিয় দেশগুলির চাহিদা মত তারা নিজেদের উৎপাদনের গুণমান বদলেছেন - এই কাজটি করেছেন প্রযুক্তির কুড় নিজেদের হাতে রেখেই অন্তত ভারতে ১৭৫৭এ পর থেকে ১৮০০ পর্যন্ত বিশিল্পাপায়ন চলার সময় পর্যন্ত। ওম প্রকাশ ১৭৫৭র পরের সময়ে বাংলায় ব্রিটিশেরা যে বাড়াবাড়ি শুরু করে দ্বৈত শাসনে, সেটা নিয়ে শাসক হয়ে বসা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ডাচ আর ফরাসি কোম্পানি অনুযোগ জানালে, একটা ডাচ-ব্রিটিশ-ফরাসী যৌথ পর্যবেক্ষণ কমিটি হয়, সেটার সমীক্ষা লেখেন ডাচ এক ফ্যাক্টর, যিনি কলকাতা থেকে ক্ষীরপাই পর্যন্ত নানান আড়ং ঘুরে দেখেন এবং আড়ংগুলির বিশদ বর্ণনা লেখেন, সেখানে স্পষ্ট যে ক্ষমতায় এসে সরাসরি বিশিল্পায়নের কাজ শুরু করে দিয়েছে ব্রিটিশ, তাদের সাধের মিলগুলি বাঁচাতে - সেটার অনুবাদ আমরা প্রকাশ করি পরমের বস্ত্র সংখ্যায়(The Dutch East India Company and the Economy of Bengal, 1630-1720)।
আজও আমরা যে কাপড়গুলি অন্তত ফুলিয়া সহ বাংলার নানান তাঁতিপাড়ায় তৈরি করি তার গুণমান মিলের কাপড়ের থেকে বহুগুণে ভাল, আজও মিলে ২০০ কাউন্টের বেশি সুতোয় কাপড় হয় না, জটিল নক্সায় কাপড় করতে গেলে হাতের তাঁতের বিকল্প নেই এবং এই প্রযুক্তি তাঁতিদের হাতে - তার জন্য তাঁতিদের পেটেন্ট দিতে হয় না, তাঁত খারাপ হয়েগেলে নিজেরা স্থানীয়ভাবে সারিয়ে নিতে পারে, কোন দূর দেশ থেকে আসা পেশাদারের জন্য হাহুতাশ করে বসে থাকতে হয় না। অতীতে তাঁতিরা দেখিয়ে দিয়েছেন গুণমান আর অতিরিক্ত উৎপাদন এই দুটি পরস্পর প্রতিযোগী ফ্যাক্টরকে সাথে নিয়ে তারা বিশ্ব জয় করতে পারেন। যত চাহিদা বেড়েছে, তত তাঁতি বেড়েছে, বেড়েছে চরকাকাটনির সংখ্যা, একজন মিল মালিকের সমস্ত হাতে সমস্ত উদ্বৃত্তের অর্থ না গিয়ে ছড়িয়ে যাচ্ছে সমাজের বিভিন্ন স্তরের পেশাদারের হাতে।
...এটি গত বছরের ভাবনা
No comments:
Post a Comment