Monday, June 5, 2017

ব্রিটিশপূর্ব বাংলায় শূদ্র-বৈশ্য-মুসলমান এবং অন্যান্য পরম্পরার সমাজের উৎপাদন এবং বাণিজ্যচর্চা

***কারোর কি মনে আছে যে মাসতিনেক আগে ব্রিটিশপূর্ব বাংলার উৎপাদন এবং ব্যবসা বিষয় নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়েছিল এবং ওয়াটাগের পক্ষে আমরা প্রস্তাবও পেশ করেছিলাম।
Dipankarদা আর Souvikএর জন্য এই প্রস্তাবটা তুলে দেওয়া গেল। অন্য  বন্ধুরা যদি মনে করেন  এই বিষয়ে কিছু বলার আছে, যোগ করার আছে স্বচ্ছন্দে যোগ দিতে পারেন।
একটা ছোট্ট ব্যখ্যা ছোট পুঁজি বলতে পুঁজি নিরপেক্ষ গ্রামীন উতয়াদন-বিতরণ ব্যবস্থা বুঝিয়েছি। সব যায়গায় সম্পাদনা করা সম্ভব হয় নি ***
---
বাংলা লুঠ বিষয়ে গবেষণার আগে বাংলার উৎপাদন ব্যবসা নিয়ে সার্বিক নথিকরণকর্ম জরুরি
প্রস্তাবকঃ উইভার্স, আর্টিজান, ট্রাডিশনাল পার্ফর্মিং আর্টিস্টস গিল্ড(ওয়াটাগ)
তাত্ত্বিক অবস্থান
গ্রামীন বাংলার শূদ্র-বৈশ্য উতপাদন-বিতরণ ব্যবস্থার একটা সামগ্রিক ছবি দরকার বলে মনে করছে ওয়াটাগ। এই শিক্ষিত বিতর্কে অশিক্ষিত, অজ্ঞ, মুর্খ, কুসংকারাচ্ছন্ন, সভ্যতার ষড়ৈশ্বর্য না দেখে গ্রামের মধ্যে বাস করা কুপমণ্ডুক শূদ্র-বৈশ্যদের সংগঠনের পক্ষ থেকে কিছু কথা - গুছিয়ে বলতে পারব কি না জানি না চেষ্টা করছি। আমাদের মত করে মুখবন্ধ রচনা করা গেল। পছন্দ হলে এগোনো যাবে – তবে সতর্কতা, লেখাটা বড় হবে।
উৎপাদন ব্যবস্থার চরিত্র
বড় পুঁজি-নিরপেক্ষ উৎপাদন ব্যবস্থা খুব বেশি মানুষ/গোষ্ঠীর হাতে লাভ জমতে দেয় না – বিপুল সংখ্যক ছোট উৎপাদক বিক্রেতা থাকলে সেই উতপাদন-বিতরণ ব্যবস্থায় লাভ ছড়িয়ে যায় সমাজের প্রত্যেকের মধ্যে – কারোর একটু বেশি কারোর কম। ঐতিহাসিকভাবে ইওরোপিয় আগ্রাসনের পূর্বে ভারত/এশিয়া/লাতিন আমেরিকা/আফ্রিকা মূলত বড় পুঁজি-নিরপেক্ষ অঞ্চল ছিল – সামাজিক সম্পদ তৈরি করতে সেই উৎপাদন ব্যবস্থা মাহির ছিল – তাঁর জন্য বড় পুঁজির আগ্রাসী চরিত্রের প্রয়োজন হয় নি। বড় পুঁজি কি ছিল না? ছিল। চাঁদ বা শ্রীমন্ত বা ধনপতির মত সওদাগরেরা সপ্তডিঙ্গা মধুকর সাজিয়ে বিদেশে ব্যবসা করতে যেতেন, তাঁরা তো আদতে বড় পুঁজির প্রতিভূ – তাঁরা কিন্তু কর্পোরেট লুঠেরা পুঁজি হয়ে ওঠেন নি – বাণিজ্য করতে বিদেশে গিয়ে বকলমে বা সরাসরি সে দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন নি – সে হয়ত সওদাগর ছিল কিন্তু চরিত্রগতভাবে কর্পোরেট ছিল না। তাঁদের কর্মকাণ্ডের ওপর সামাজিক নিয়ন্ত্রণ প্রবল ছিল। তাকে ঘাড় ধরে সিএসআর করাতে হত না – বাংলাজুড়ে রাস্তা, পুকুর, চিকিতসাব্যবস্থা, সেচ ব্যবস্থা, জ্ঞানচর্চার পরিবেশ, উৎপাদন-বিতরণ ব্যবস্থা, কারিগরদের দক্ষতা, সামাজিক সম্পদ, কারিগরদের হাতে থাকা প্রযুক্তি, সামাজিক নিরাপত্তাবোধ, স্থানীয় বাজার নির্ভর উতপাদন-বিতরণের যে ব্যপ্ত সামাজিক পরিকাঠামো গড়ে উঠেছিল, তা তাঁরা সামাজিক উদ্যমের অংশ হয়েই করতেন, গ্রামীন পরম্পরার উৎপাদন আর বড় পুঁজি যৌথভাবে। বড় পুঁজি ছিল মূলত শহর ভিত্তিক। সে ব্যবসা বাড়াবার জন্য গ্রামের ব্যাপ্ত উপাদন ব্যবস্থার ওপর, বেশিতম উৎপাদনের অনাবশ্যক চাপ দেওয়ার সুযোগ পেত না।
পলাশি চক্রান্তের আগেও বাংলার সমাজে(ভৌগোলিকভাবে বৃহত্তর বাংলা বলতে পূর্বে বার্মা সীমান্ত, উত্তরে অসম, দক্ষিণে ওডিশা, পশ্চিমে দ্বারবঙ্গ=দ্বারভাঙ্গা) বড় পুঁজি সমাজ-রাষ্ট্রের সার্বিক নীতি নির্ধারণ করার অবস্থায় ছিল না। তার চলাচলে কিছু সামাজিক বিধিনিষেধ ছিল। এক উৎপাদক অন্য উতপাদকের উৎপাদন পরিকাঠামো কিনে নিতে পারত না - শিল্পবিপ্লবীয় উৎপাদন ব্যবস্থায় যেমন কোন উৎপাদক না চাইলেও তার ব্যবসা অন্য উৎপাদক কিনে নিতে পারেন হোস্টাইল টেকওভারএর মাধ্যমে - বড় পুঁজি আরও বড়দের আশীর্বাদ নিয়ে তার থেকে পাঁচগুণ বড় কোম্পানি কিনে নিয়ে তা সামলাতে না পেরে ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা হয় - এ তত্ত্ব-তথ্য খুব সম্প্রতির ইতিহাসে প্রমানিত। কৃষককে, গ্রামের বংশ পরম্পরার ছোট উতপাদকেদের যদি পুঁজি-নিরপেক্ষ উতপাদন ব্যবস্থার অংশ ধরি, রাষ্ট্রের মদতে সেই লাভের (কৃষিকে শুধু লাভজনক উতপাদন ব্যবস্থা হিসেবে দেখতে গিয়ে কৃষির কর্পোরেটাইজেশন ঘটছে, সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠছে) উতপাদন-ব্যবসাকে জোর করে সারা বিশ্বজুড়ে দখল করা হচ্ছে, নিশ্চিহ্ন করা হচ্ছে বুকে বন্দুকের নল ঠেকিয়ে। সেটা পুঁজি-নিরপেক্ষ উৎপাদন ব্যবস্থার নীতি ছিল না, আজও নেই। কোন আর্থিক সঙ্গতিসম্পন্ন ফেরিওয়ালা তার পাশের কয়েকটা দোকান, বা ছোট উৎপাদক তার গ্রামের অন্যান্যদের উৎপাদন পরিকাঠামো অবলীলায় আজও কিনে নিয়ে বড় পুঁজি, কর্পোরেট পুঁজি হয়ে উঠতে পারেন না।
উৎপাদন, বিতরণ আর সাংস্কৃতিক বৈচিত্র বড় পুঁজির চিরন্তন শত্রু – তাই তাঁর উদ্যম বিশাল বৈচিত্রময় স্থানীয় উতপাদন-বিতরণ ব্যবস্থা ধ্বংস করে কেন্দ্রীভূত উতপাদন-বিতরণ ব্যবস্থা তৈরি করা। এই বৈচিত্রময় উতপাদন-বিবরণ পুঁজি-নিরপেক্ষ উৎপাদন ব্যবস্থার জোরের জায়গা। সে যথাসম্ভব স্থানীয় সম্পদ, শ্রম, জ্ঞান, দক্ষতা, প্রযুক্তি, বাজার নির্ভর করে উতপাদন-বিতরণ ব্যবস্থা তৈরি করে। তাঁর জোর নিজ সমাজ বিকশিত জ্ঞান, দক্ষতা আর বংশপরম্পরায় তৈরি করা পরিকাঠামো। তার জোর ধারের জ্ঞান, প্রযুক্তি বা দক্ষতার নয়, নিজস্বতার।
ভারত বহুকাল ধরে বহু কৃষি ও শিল্প উৎপাদন সারা বিশ্বে একচেটিয়া ব্যবসা করে এসেছে - নীল থেকে ইস্পাতের মণ্ড পর্যন্ত - তখন জ্ঞানচর্চা, প্রযুক্তি তার নিজস্ব ছিল। তার জোরে ১৮০০ পর্যন্ত সে ছিল ব্যবসায় উতবৃত্ত দেশ। বড় পুঁজির(এমন কি ছোট্ট পুঁজিও খুব বড় করে – ফেরিওয়ালার প্রথম লিখিত বিবরণ পাই জাতকে সেরিবা-সেরিবান গল্পে – সে অন্তত ২০০০ বছরের ইতিহাস) বিতরণ ব্যবস্থা সে উৎপাদনগুলি নিয়ে বিদেশে গিয়েছে, কিন্তু সামগ্রিক উৎপাদন ব্যবস্থায় দাঁত ফোটাতে পারে নি। প্রসন্নন পার্থসারথি বা ওম প্রকাশজী বা পেড্রো মাচাডো তাঁতি আর তাঁত বস্ত্র বিষয় গবেষণা বলছে, পলাশীর আগে পর্যন্ত তাঁতিরা ব্যবসায়ীদের দাদন ফিরিয়ে দিতে পারতেন - তাঁদের রোজগার ছিল ইওরোপের তাঁতিদের তুলনায় অনেক বেশি – তাঁরা সারাবিশ্বজুড়েই ব্যবসা করতেন। নীল উতপাদন-বিতরণ ব্যবস্থাই ধরা যাক, ২০০০ বছর আগে রোমে ভারতীয় নীল যেত - নাম ইন্ডিগো – উৎপাদনের ভৌগোলিকতার সূত্র ধরে - নীল লাতিন আমেরিকা থেকেও সে সময়ের ইওরোপে আসত - তারও নাম ছিল কিন্তু ইন্ডিগো – এই প্রায় একচেটিয়াসম ব্যবসাকে ১৮০০ সালের পর রাষ্ট্রের মদতে, বড় কর্পোরেট পুঁজি, উতপাদ-বিতরকদের বুকে বন্দুক ঠেকিয়ে দখল - ধ্বংস করল। অথচ অন্তত ২০০০ বছর ধরে নানান ধরণের কৃষি বা শিল্প উতপাদনের একচেটিয়া ব্যবসা করেও কেন্দ্রিয় দখলদারির, চাষীদের নিংড়ে লাভের শেষ কপর্দক তুলে নেওয়ার নীলকর তৈরি হয় নি। ম্যাঞ্চেষ্টারের অতিরিক্ত উতপাদনের কাপড় মিলগুলি লাভ করতে ততদিন পারে নি, যতদিন না বন্দুকের মুখে দাঁড় করিয়ে ভারতের আড়ংগুলি ধ্বংস করা হয় নি, নীল চাষ-ব্যবসা দখল করা হয় নি, ইওরোপে বাংলার কাপড়ের ওপর ১০০% শুল্ক বসে নি, ইওরোপে ইস্পাতের (ধাতুর) কারখানা চলে নি যতদিননা ভারত ব্যপ্ত ৩০০০০ চলন্তিকা ছোট্ট গলনচুল্লির ধারক-বাহক, দেশের ছোট সামাজিক উৎপাদন ব্যবস্থার অংশ ডোকরা উতপাদকেদের ধ্বংস করা হয় নি - এই ইস্পাত মণ্ড দিয়ে এক সময় বিশ্ববিখ্যাত দামাস্কাস তরোয়াল তৈরি হত বা বাংলার ব্রিটিশপূর্ব সময়ে বানানো প্রচুর লোহা/ধাতু সামগ্রী আজও আকাশের তলায় পড়ে থাকে মরচে বিহীন হয়েই।
আর্যভটের হাত ধরে আরও হাজারো গুনীর চেষ্টায় যে নিয়ন্ত্রণমুক্ত কলন বিদ্যার জ্ঞানচর্চা তাঁতিদের, নাবিকদের, চাষীদের হাতে প্রতিকূলতা জয় করার করার সুযোগ করে দিয়েছি্ল, বাংলা তথা ভারতের বিশিল্পিয়ায়নের ব্রিটিশ উদ্যমে সেই ব্যপ্ত কেন্দ্রবিহীন ভারতজোড়া বিদ্যাচর্চাকে উদ্দেশ্যপূর্ণভাবে ধ্বংস করা হল, ইওরোপে গিয়ে সেই মুক্ত প্রাথমিক জ্ঞানচর্চা হয়ে উঠল উচ্চতম শিক্ষাব্যবস্থার অংশ – যারা সেই জ্ঞানচর্চাকে দখল করলেন তাঁরা তখন সেটির ওপরে পেটেন্টের ঘোমটা পরাতে ব্যস্ত ছিলেন। বাংলা তথা ভারতের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অন্যতম ধারক বসন্তের টিকাকারদের নিষিদ্ধ করে জেনারের উদ্ভাবিত টিকা ব্যবস্থাকেই চালাতে হয়েছে।
দেশজ প্রযুক্তির চরিত্র
ছোট্ট উৎপাদন ব্যবস্থায় উতপাদকের নিয়ন্ত্রণে থাকে প্রযুক্তির প্রয়োগ। বাংলার বাণিজ্য প্রচেষ্টা জানার ক্ষেত্রে প্রযুক্তি একটা বড় উপাদান। প্রযুক্তি কার নিয়ন্ত্রণে, এই তত্ত্ব-তথ্য আলোচনা ব্যতিরেকে, ব্রিটিশপূর্ব বাংলার বাণিজ্য প্রচেষ্টার আলোচনা ব্যর্থ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। বাণিজ্য আলোচনায় প্রথমে বোঝা প্রয়োজন প্রযুক্তির নিয়ন্ত্রণ আদৌ উতপাদকের হাতে রয়েছে কি না। অর্থাৎ যে প্রযুক্তি প্রয়োগ করে সে উৎপাদন করছে, তা বড় পুঁজির কেন্দ্রিয় নিয়ন্ত্রণ মুক্ত কি না – মোটা ভাষায় বলা যায়, কাজ করতে করতে প্রযুক্তির হাতিয়ারগুলি বিকল হলে সে নিজে বা স্থনীয়ভাবেই সেটা সারিয়ে নিতে পারে কিনা, না তাঁকে সমাজের বাইরের ওপর নির্ভর করতে হয়। একটা ছোট উদাহরণ দেওয়া যাক – বাংলার শাঁখারিদের শাঁখের করাত উপহার দিয়েছিলেন বর্ধমানের কামারেরা। তাঁরা এমনভাবে সেই করাত তৈরি করেছিলেন যাতে সেটি বংশপরম্পরায় ব্যবহার করা যায়, নিজেরাই সেই করাত ধার করে নিতে পারেন – কামারদের ওপর যাতে নির্ভর না করতে হয়। অশ্লীল সাম্রাজ্যবাদী লুঠেরা দখলদারি পেটেন্ট নেওয়ার কথা তুলছিই না।
শিল্পবিপ্লবের আগে থেকেই কেন্দ্রিয় নিয়ন্ত্রণযুক্ত বড় পুঁজি চেষ্টা করেই যাচ্ছে প্রযুক্তি, জ্ঞানচর্চা পেটেন্ট, কপিরাইট ইত্যাদি ব্যবস্থা প্রয়োগ করে দখলে নিয়ে আসতে।উদ্দেশ্য সামগ্রিক উৎপাদন ব্যবস্থায় দখলদারি নিশ্চিত করা। উৎপাদন ব্যবস্থার চরিত্র বিচারে আমাদের প্রাথমিক প্রশ্ন প্রযুক্তির নিয়ন্ত্রণ কার হাতে, পুঁজির চরিত্র কি - সে অন্য উৎপাদন ব্যবস্থাকে কন্সোলিডেশনের নাম করে, উন্নয়নের নাম করে সমাজের সম্পদ দখল করার ছাড়পত্র পায় কি না।
অন্য সভ্যতার কথা জানি না, ভারত মূলত শূদ্র বৈশ্য মুসলমান এবং অন্যান্য পরম্পরার সমাজের তৈরি সভ্যতা - জ্ঞানচর্চা, উতপাদন বিতরণ ব্যবস্থায় তাদের নিয়ন্ত্রণহীন পকড় নতুন ভাবে ভারতকে বসিয়েছিল বিশ্ব উতপাদন ব্যবস্থায়। ইতর, ছোটলোকেদের হাতে ছিল দেশের মূল উতপাদন বিতরণ ব্যবস্থা - তাঁরাই তৈরি করেছিলেন এই ব্যবস্থার দর্শন। কয়েক হাজার বছর ধরে শূদ্ররা, বৈশ্যরা, মুসলমানেরা নিজেদের বিকেন্দ্রিভূত উৎপাদন দর্শন তৈরি করেছিলেন - যে দর্শনকে ধ্বংস করার চেষ্টা করে গিয়েছে ইওরোপ ৫০০ বছর ধরে। পলাশির পর রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে বিশিল্পিয়ায়ন, জ্ঞানচর্চা ধ্বংস, লুঠ, খুন ব্যবস্থা নামিয়ে এনে সেই দর্শন ধ্বংস বাস্তবে রূপ পায়, তা চরম রূপ ধারণ করেছে স্বাধীনতার পর - তার জন্য কয়েক কোটি গ্রামীন শূদ্র বৈশ্য মুসলমানকে উচ্ছেদ করতে হয়েছে - সে লড়াই চলছে আজও। তবুও রক্তবীজের বংশধরেরা তাদের মত করে দেশের গ্রাম উতপাদন ব্যবস্থা ধারণ করে রয়েছেন বলেই বিশ্ব মন্দা ভারতে প্রভাব ফেলে না, নোট বন্দীর মত গ্রামীণ উৎপাদন ব্যবস্থা্ধ্বংসমূলক পরিকল্পনাও শেষ অবধি ধ্বংস হয়ে যায়।
তাই আজকের বাংলার ব্রিটিশপূর্ব বাণিজ্য চর্চা আলোচনার কাজে প্রাথমিকতা হওয়া দরকার পুঁজির চরিত্র আর প্রযুক্তির চরিত্র বিশ্লেষণ করা। শিল্পবিপ্লবীয়(যে উদ্যম আদতে নব্য দাস ব্যবস্থা তৈরি করেছে - যার সঙ্গে বিপ্লবনামক বহুব্যাপ্ত ব্যঞ্জনাযুক্ত শব্দটির কোন সম্পর্ক নেই) সময়ে যে প্রযুক্তির বিকাশ ঘটল, চরিত্রের দিক থেকে সেগুলি কেন্দ্রিয়ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। প্রযুক্তির চরিত্র এমন, শুধু প্রযুক্তির জ্ঞানচর্চা বিক্রি করে অনন্ত লাভ করা যায়। পশ্চিমে বিকশিত প্রযুক্তির বড় প্রযোগবাদিতা ছিল সামরিক বিদ্যা বিকাশে - আর্কিমিদিস থেকে গ্যালিলিও থেকে নিউটন থেকে ওপেনহাইমার, বোর পর্যন্ত পশ্চিমি প্রযুক্তি বিকাশের ইতিহাস তাই বলে। জনগনের অর্থে নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে গবেষণাগারে বিকশিত সামরিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে মূলত বিশ্বজোড়া সম্পদ লুঠের কাজে, মানুষের মন নিয়ন্ত্রণের কাজে। কেন্দ্রিভূতভাবে নিয়ন্ত্রণযোগ্য পশ্চিমি প্রযুক্তির মূল চরিত্র লুঠেরার। শ্রমের যাতায়াত কোথায় উন্মুক্ত হল? ইওরোপ/আমেরিকার অভিবাসন আইন দেখলেই বোঝা যাবে। বিশ্বায়নের যুগে বড় পুঁজির বাজার উন্মুক্ত হয়েছে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপে - যেখানে সে পারে নি, সেখানে অস্ত্রের ব্যবহার করেছে।
তাত্ত্বিক, ব্যবহারিক প্রতিজ্ঞা
ক। তত্ত্ব - প্রাথমিকভাবে বাংলা তথা ভারত তথা এশিয়ার উৎপাদন ব্যবস্থা শিল্পবিপ্লবীয় উৎপাদন দর্শনের থেকে আলাদা ছিল। এই উৎপাদন ব্যবস্থা মূলত বড় পুঁজির প্রতিস্পর্ধী অবস্থান। সামাজিক সাম্যের দিকে অনেক বেশি নজর দেওয়া। একে সামাজিক ব্যবসাও বলা যায়। আজকে লুঠেরা কর্পোরেট পুঁজিকে ঠেলেঠুলে যে কাজ করানো যাচ্ছে না – সেই আদ্যিকালের যুগে - যে যুগকে অন্ধকারাচ্ছন্ন যুগ বলে দাগিয়ে দিতে পশ্চিমি জ্ঞানচর্চকদের বিন্দুমাত্র দ্বিধা হয় না - বণিকেরা বাংলায় সব থেকে বেশি জনপূর্তির পরিকাঠামো তৈরির জন্য বিনিয়োগ করেছিলেন। তাঁরা হয়ত জানতেন সেই বিনিয়োগ উতপাদন-ব্যবসার কাজে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করবে।
অ। প্রাথমিকভাবে ছোট পুঁজি, পুঁজি নিরপেক্ষ উতপাদন-বিতরণ ব্যবস্থার সংজ্ঞা নির্ধারণ করতে হবে। বড় এবং কর্পোরেট পুঁজি থেকে পুঁজি নিরপেক্ষ ন্যন্সথা কেন আলাদা, সেই তাত্ত্বিক অবস্থান নির্ণয় করতে হবে।
খ। ব্রিটিশপূর্ব বাংলার শিল্প-ব্যবসার বিষয়ে খুব বেশি কাজ হয়েছে কি না বলা যাবে না। আন্তভারতীয় বা আন্তএশিয়া ব্যবসা নিয়ে কিছু কিছু কাজ হয়েছে – কিছুটা গিল্ড নিয়ে হয়েছে - কিন্তু সে প্রচুর পুরনো সময়ের - সেখানে বাংলা ভিত্তিক আলাদা করে কোন কাজ হয়েছে বলে জানা নেই – নরেন্দ্র কৃষ্ণ সিংহ বা তপনবাবুর আকবরের সময়ের কাজ বা অঞ্জলী চ্যাটার্জীর ঔরঙ্গজেবের সময়ের বাংলা বইতে বিদেশিদের চোখে বাংলার ব্যবসার কিছু ওপর ওপর কাজ ছাড়া বিশেষ কিছু কাজ হয় নি। যা হয়েছে ইওরোপিয়দের সঙ্গে বাংলা/ভারতের যোগাযোগের দিন নিয়ে – প্রচুর ঐতিহাসিক কাজ করেছেন। সমস্যা হল, যারা ঔপনিবেশিক ইতিহাস লিখলেন তাঁরা যেমন উপনিবেশের, তার অর্থনীতি্র গুণ গাইতে তার মাহাত্ম্য তৈরি করলেন, আবার বিরোধীরা – যেমন ঔপনিবেশিক তত্ত্বের বিরোধীরা - নরেন্দ্রকৃষ্ণ সিংহ বা দাদাভাই নৌরজী বা রমেশ দত্ত (সঠিকভাবেই) লুঠের তত্ত্ব খাড়া করতে ঔপনিবেশিক সময়কেই ধরলেন - আজকের বাংলার বাইরে পটানা - বৃহত্তর বাংলা নিয়ে কাজ করেছেন কুমকুম চ্যাটার্জী তাঁর মার্চেন্টস পলিটিক্স অ্যান্ড সোসাইটি ইন আর্লি মডার্ন ইন্ডিয়ায়। যদিও ইওরোপের সঙ্গে ভারত/বাংলার ব্যবসার পরিমান ছিল মাত্র ১০% - বাকি ৯০% এশিয় এবং দেশিয়। আর ইওরোপ বলতে ব্রিটিশ বুঝলাম। পর্তুগিজেরা যে ভারতে মুঘলদের আগে এসেছিল সেই হার্মাদদের ব্যবসা ব্রাত্য হয়ে গেল - তাদের সঙ্গে ব্যবসার ইতিহাস ধরতে পারলে কিন্তু ১৪০০ সালের শেষের দিকের বাংলা্র ব্যবসার একটা দিক পাওয়া যেত। ব্রিটিশবাবাদের নিয়ে কাজের বাইরে দারুণ গবেষণা করেছেন ওম প্রকাশজী - ডাচেদের ব্যবসা নিয়ে। ভারতে যেহেতু প্রাথমিকভাবে তারা বাংলাতেই ঘাঁটি গেড়েছিলেন, তাই ব্রিটিশ ছাড়া ডাচেদের ব্যবসার কথা পাই - বিশেষ করে পলাশীর আগে তাঁরা কিভাবে কাজ করতেন, কিভাবে স্বাধীনভাবে তাঁতিরা কাজ করতে পারতেন, দাদন ফিরিয়ে দিতে পারতেন তা অসম্ভব নতুনত্বের সঙ্গে তুলে ধরেছেন তিনি। বা শ্রীলা ত্রিপাঠি বলছেন হিপ্পালাসের মৌসুমী বায়ু 'আবিষ্কার'এর আগে থেকেই বাংলার নাবিকেরা দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় যেত - যার রেশ আজও থেকে গিয়েছে ওডিশার বালি যাত্রা উতসবে, বাংলার নানান ব্রতে, উতসব মেলায় - গুজরাটের নাবিকেরা লোহিত সাগর এবং আফ্রিকায় - প্রসন্নন পার্থসারথি, জর্জিও রিয়েলো বা পেড্রো মাচাডোরা দেখিয়েছেন গুজরাটি ৩০০০ বছরের পুরনো বস্ত্র ব্যবসার কুড়।
আ। ব্রিটিশপূর্ব পূর্ব ভারতের অভ্যন্তরের বা ভারত এশিয়ার মধ্যে ব্যবসা কি ছিল তা নজর খুব একটা পড়ে না – ইওরোপ-ভারত ব্যবসার পরিমান ছিল মূল উৎপাদনের ১০% মাত্র, বাকি এশিয় আর দেশজ বাণিজ্য– আফ্রিক বিশেষ করে গ্রিস আর মিশরের সঙ্গে বিপুল বাণিজ্য হত – তা নিয়ে আলোচনা কোথায়? ইওরোপিয় গবেষণা নিবদ্ধ হয়েছে মূলত জামাকাপড় আর মশলা ব্যবসায়। এমন এমন একটা ধারণা তৈরি হয়ে গিয়েছে, এই বাণিজ্যের বাইরে আর কিছু খুব একটা লাভজনক পণ্য ছিল না। কিন্তু সোরা থেকে নুন থেকে তামাক থেকে সুপুরি থেকে লোহা থেকে চাল, আরও কি না কি ছিল বিশাল রপ্তানির পণ্য – একদা বাংলা থেকে গুজরাটের বন্দর হয়ে যে এত সুপুরি আরব দেশ বা লেভন্ট এলাকায় যেত যে সেই পণ্যের নাম থেকে বন্দরের নামই হয়ে গেল সোপারা। হেস্টিংস সে তিনিটি পণ্য প্রথম একচেটিয়া ব্যবসার অধীনে আনেন সেগুলি হল তামাক, সুপুরি আর নুন – বস্ত্র বা আফিম বা মশলা নয়।
গবেষকেদের সমস্যা বুঝি। তাঁরা যে জ্ঞানচর্চায় বেড়ে উঠেছেন, সেই জ্ঞানচর্চা মূলত লেখ্য জ্ঞানচর্চার ধারা, ইওরোপমুখ্যতাভিত্তিক, তার বাইরে কিছুই চোখে পড়ে না, পড়লে মনে ধরে না, মনে ধরলে কাজের সুযোগ হয় না। ফলে এই শ্রুতির দেশে, যেখানে খুব সহজে মনে রাখা্র ক্ষমতা তৈরি করা হয় ছোটবেলা থেকেই নানান সহজতম জ্ঞানচর্চার প্রক্রিয়ায়, বা এই গরম, জলীয়বাষ্প-মধুর দেশে, যেখানে খুব কঠিন কাগজ বা কোনোকিছু লেখ্য তথ্য সংরক্ষণ করা, সেখানে কি করে পূর্বজদের কাজ মূল্যায়ণ করা যাবে, তথ্য নিষ্কাশন করা যাবে তার তাত্বিকতা ভেবে বার করতে হবে। নইলে সামগ্রিক উদ্যম নষ্ট হয়ে যেতে পারে – কেননা, তাহলে আবার সেই অন্য দর্শনের জ্ঞানচর্চার ওপর নির্ভর করতে হবে।
এ নিয়ে যোগ্য আলোচনা দরকার। সমস্যা হল পদ্ধতি নিয়ে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তেলেভাজার অর্থনীতি নিয়ে বলে জোর গাল খাচ্ছেন অথচ এই বাংলার অর্থনীতিটা ছিল ছোট উৎপাদন ব্যবস্থাভিত্তিক। গবেষকেরা, অধ্যাপকেরা মনে করেন বড় কারখানা না হলে তা অর্থনীতি নয়, যেমন বাংলাদেশে আমাদের এক অধ্যাপক বন্ধু মাটির বাড়ি,মাটির মসজিদ নিয়ে কাজ করতে গিয়ে শুনেছেন মাটির বাড়ি/মসজিদকে কবে থেকে স্থাপত্য ধরা হল? সেই শিক্ষা তাঁরা পেয়েছেন ইওরোপের শিল্পবিপ্লবীয় উৎপাদন ব্যবস্থা থেকে। অথচ যতদিন নিজেদের অর্থনীতি, নিজেদের প্রযুক্তি, নিজেদের শিক্ষা ব্যবস্থা ছিল ততদিন বাংলা ছিল বাণিজ্যে উদবৃত্তের দেশ। সেটা যেন মনে রাখি।

No comments: