তথ্যভিত্তি - সামাজিক ইতিহাসের ধারাঃ বিনয় ঘোষ
বাংলা ১১শত শতের প্রথম পর্বে ১১০৭-১১৩৪, মুর্শিদকুলিখাঁর দেওয়ানি সুবাদারির সময়। এটিকে জাফরখানি বন্দোবস্ত বলছেন ব্রিটিশেরা – জাফর খাঁএর উপাধি ছিল মুর্শিদ কুলি। মুর্শিদাবাদ স্থাপন করে তার লক্ষ্য পড়ল রাষ্ট্রীয় আয়ের একমাত্র উৎস বাণিজ্য শুল্ক। তাই তিনি রাজস্ব বৃদ্ধির দুটি উপায় স্থির করলেন। প্রথমত বাংলার জায়গিরগুলি খালসা জমিতে রূপান্তর করা, জায়গিরদারদের বাংলার বদলে ওডিসার বনাঞ্চল জায়গির দেওয়া। দ্বিতীয় উপায় হল রাজস্ব আদায়ে ইজারা বা কন্ট্রাক্ট দেওয়া। হিন্দু রাজত্ব এবং সুলতানি আমলে যে সব মুসলমান জমিদার তৈরি হয়েছিল, তারা কলেবরে আর ক্ষমতায় অনেক বড় হয়ে উঠেছিল। তাদের কাছে রাজস্ব আদায় মুশকিল ছিল। তাদের থেকে রাজস্ব আদায়ের মাল-জমিনি ব্যবস্থা চালানোর জন্য ইজারাদার নিয়োগ করেন মুর্শিদ কুলি। জমিদার রইলেন কিন্তু ইজারাদারদের অধীনে।
বেশ কিছু পুরোনো জমিদারেরা লুপ্ত হয়ে গেলেন – নব্য ইজারাদারেরা রাজা মহারাজা নাম নিয়ে জমিদার হয়ে বসলেন। এদের অধিকাংশ হিন্দু। যেমন উত্তরবঙ্গের বারেন্দ্রে রঘুনন্দন। মুর্শিদকুলি খাঁর পৃষ্ঠপোষণায় বহু জমিদারি ভাই রামজীবনের নামে হস্তান্তর করেন। ১১২১এ সীতারামের পতনের পরে ভূষণা তাঁর হস্তগত হয়। রামজীবনের মৃত্যুর পর পোষ্যপুত্র রামকান্ত জমিদারি সনদ পান ১১৪০ সনে। রামকান্তের স্ত্রী ভবানী। বিপুল চেহারা নিয়ে উত্তরবঙ্গের নাটোর বর্ধমান রাজের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে। পুরোনো ১৩০০০ মাইল বিস্তৃত রাজশাহী জমিদারি(যা পরে তৈরি হওয়া রাজশাহী জেলার তিনগুণ ছিল) এবং রাজস্ব ছিল ২৭ লক্ষ টাকা – মুর্শিদ কুলির আমলে খণ্ড খণ্ড হয়ে নাটোর রাজের সূচনা হয়।
রঘুনন্দনের বিস্বস্ত কর্মচারী দয়ারাম রায়, বঙ্কিম চ্যাটুজ্যের হিন্দু নায়ক সীতারামকে ক্ষমতাচ্যুত করার চক্রান্তের প্রধান পাণ্ডা। দয়ারাম পুরষ্কৃত হলেন। রাজশাহীর দিঘাপাতিয়া বংশ প্রতিষ্ঠিত হল। নাটোরের জমিদারি ইংরেজদের চক্রান্তে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়, তখন এক দক্ষিণ রাঢী কায়স্থ যশোরের নড়াইল রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করেন। অবশ্য রাজসাহির তাহিরপুর পুঁটিয়া নাটোরের চেয়ে পুরাতন জমিদারি। কিন্তু তখন তাদের অবস্থা পড়ন্ত। দুজন বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ মুর্শদকুলির অনুগ্রহ পায় - বগুড়ার শ্রীকৃষ্ণ হালদার আর মুক্তাগাছার(ময়মনসিংহ) শ্রীকৃষ্ণ আচার্য চৌধুরী। সুলতানের আগের জমিদারিগুলির মধ্যে বিষ্ণুপুরের মল্লবংশ, বীরভূমের আসাদৌল্লার বংশ, পঞ্চকোটের রাজবংশ হাত বদল হয় নি।
১১৯৫ সালের মিনিটে জন শোর বলছেন বাংলার বড় জমিদারদের শেকড় খুঁজে পাওয়া যায় শেষ দেড় শত বছরের ইতিহাসে। জেমস গ্রান্ট বলছেন অতীতের জমিদারিগুলি তাদের স্বাতন্ত্র্য হারিয়ে জাফর খাঁএর করদে পরিনত হয়। যদিও বিনয় ঘোষ ব্রিটিশদের তথ্য উল্লেখ করে বলছেন, মুর্শিদ কুলি খাঁ যে সব ইজারাদারদের জমিদারে রূপান্তরিত করেছিলেন, ইংরেজ শাসকেরা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করে তাঁদের পদমর্যাদা ও বংশানুক্রমিক উত্তরাধিকার ভিত্তি পোক্ত করেন। কিন্তু মনে রাখতে হবে জাফর খানি বন্দোবস্তের আগের সব জমিদারি কিন্তু সবকটা ছত্রভঙ্গও হয় নি মর্যাদাচ্যুতও হন নি – যেমন দিনাজপুর, বর্ধমান, নদিয়া, নলডাঙ্গা ইত্যাদি। এগুলি মুর্শিদ কুলির আগের সময়ের। কিন্তু ব্রিটিশ আমলে এদের পতন দ্রুত হতে থাকে। জমিদারি খণ্ড খণ্ড হয়ে যায়।
No comments:
Post a Comment