বাংলা দেশের ইতিহাস – দ্বিতীয় খণ্ড - রমেশ্চন্দ্র মজুমদার
থেকে
ব্রিটিশ-পূর্ব অর্থনৈতিক অবস্থা
১৬৮০-১৬৮৪র এই ৪ বছরে ইংরেজরা ১৬ লক্ষ টাকার পণ্য কিনেছিল।
ওলান্দাজেরা এর কাছাকাছি একটু বেশিই কিনত। দুই বিদেশি কোম্পানি বাংলায় ৪ বছরে ৮
লক্ষ টাকার জিনিস কিনেছে। ১৯৩৮এর হিসেবে প্রতি বছর ১ কোটি ৬০ লক্ষ টাকা দুটো
ইওরোপিয় কোম্পানি বাংলাকে দিত। এছাড়া আভ্যন্তরীণ এবং অন্য দেশ আর অন্যন্য
কোম্পানির বাণিজ্য তো ছিলই।
বছরে বাংলা থেকে গড়ে ১ কোটি টাকা দিল্লিতে যেত। শুজার ১২
বছরের রাজত্বে মোট ১৪৬২৭৮৫৩৮টাকা দিল্লি গিয়েছে। শায়েস্তা খাঁ ২২বছরে ৩৮ কোটি টাকা
সঞ্চয় করেন। আজিমুসসান ন বছরে ৮ কোটি টাকা নিয়ে যান। অন্যান্য সুবাদারও একইভাবে
বাংলা লুঠেছে।
মালদহের মসলিন মির্জা নাথান কেনেন ৪০০০ টাকায়। নৌকো ছিল বড়
শিল্প। শুধু ঢাকার নদীপাড়ে দুই ক্রোশ জুড়ে নৌকো তৈরি করার সূত্রধরেরা বাস করত।
অলঙ্কার নির্মানও প্রচুর হত। শাঁখ বড় শিল্প ছিল। বীরভূমে লোহার খণি ছিল। রেনেল
বলছেন সিউড়ি থেকে ১৬ মাইল দূরে লোহা পিণ্ড তৈরি করে দামারা আর ময়সারাতে লোহার পণ্য
তৈরি হত। মুল্লারপুর পরগণা আর কৃষ্ণনগরে ডেউচ্যা আর মহম্মদবাজারে কারখানা ছিল।
কলকাতা কাশিমবাজারে দেশিয়রা কামান তৈরি হত, বারুদও তৈরি হত। শীতে বরফ তৈরি হত। গরম
জল মাটিখুঁড়ে রেখে বরফ তৈরি করা হত।
চিনেরা লিখেছেন গাছের বাকল দিয়ে কাগজ তৈরি হত। সাদা রঙ আর
হরিণের চামড়ার মত মসৃণ। লাক্ষা আর রেশমও প্রচুর হত।
ইবন বতুতা আর বার্নিয়ে বিপুল পরিমান ধান ফলার কথা বলেছেন –
তাদের মতে মিশর নয় বিশ্বের সেরা উৎপাদনশীল দেশ বাংলা। তা জলপথে মছলিপত্তনম, লঙ্কা
আর মালদ্বীপে যেত। চিনি যেত গোলকূণ্ডা, কর্ণাটক, আরব আর পারস্য আর মেসোপটেমিয়ায়।
গম প্রচুর হত। তা দিয়ে বিস্কুট হত বিদেশে যাওয়া নাবিকদের জন্য। সুতো আর রেশম জাপান
আর ইওরোপে যেত। লাক্ষা, আফিম, মৃগনাভি, লঙ্কা, ঘি বিদেশে যেত।
বাংলায় এসেছে আমেরিকা থেকে তামাক আর আলু। পাট নীল আর চাও
বাণিজ্য পণ্য ছিল। গুড়, সুপারি, তামাক, তেল, আদা, পাট, মরিচ, তাড়ি প্রদেশ ও বিদেশে
চালান যেত। ১৭৫৬র আগে ৫০ জাহার মণ চিনি রপ্তানি হত। নুন, গালা, আফিম, মশলা, ওষুধ,
খোজা, ক্রীতদাস এশিয়ার নানা দেশে যেত।
চিন ছাড়া ম্যানিলা, খোরসান, পারস্য, তুরস্ক, আফ্রিকায়
বাংগালী ব্যবসা করত। মঙ্গল কাব্যে এর প্রচুর নিদর্শন আছে। বাঙালি বঙ্গোপসাগর পার
হয়ে ব্রহ্মদেশ, ইন্দোচিন, ইন্দোনেশিয়ায় যেত। ইবন বতুতা সোনারগাঁও থেকে চল্লিশ দিনে
সুমাত্রায় গিয়েছিলেন। সমুদ্র যাত্রার মধ্যে যে বন্দরগুলোর নাম পাওয়া যায় – পুরী,
কলিঙ্গপত্তন, চিল্কাচুলি(চিকাকোল), বাণপুর, সেতুবন্ধরামেশ্বরম, লঙ্কা, বিজয়নগর।
নৌকো নির্মানে বাংলা বিখ্যাত ছিল – নিকলো কন্টি বলছেন
ইওরোপের তুলনায় বাংলার নৌকো মজবুত আর বড় এবং দ্রুতগামী। প্রধান মাঝির নাম ছিল
কাণ্ডারী – আজকের কাঁড়ার উপাধিধারীরা। সাবরেরা সারিগান গেয়ে দাঁড় টানত। থাকত
সূত্রধর, ডুবুরি আর কর্মকার। আর ছিল পাইক।
ভারথেমা বলেছেন বাংলার মত ধনী বণিক কোন দেশে দেখেন নি।
জাঁয়া দা বারোজ বলছেন গৌড় বাংলার প্রধানতম রাজধানী ছিল, ৯ মাইল দীর্ঘ এই শহরে কুড়ি
লক্ষ মানুষ বাস করত, সুলতানি আমলে তিনটে টাঁকসাল চলত একটা শহরে।
বাংলায় ব্যবসা করতে আসত কাশ্মীরী, মুলতানি, আফগান বা পাঠান,
শেখ, পগেয়া, ভুটিয়া, সন্ন্যাসীরা। পগেয়া কি মাথায় পাগড়ি পরা উত্তরভারতীয় – সেখান
থেকে কলকাতার পগেয়াপট্টি? সন্নাসীরা হিমালয় থেকে আনত চন্দন, ভুর্জপত্র, রুদ্রাক্ষ,
লতাগুল্ম। হলওয়েল বর্ধমান সম্বন্ধে বলছেন দিল্লি ও আগ্রার পগেয়া ব্যবসায়ীরা সীসে,
তামা, টিন, লঙ্কা, কাপড় কিনত বিনিময়ে নগদ টাকা, আফিম, সোরা বা ঘোড়া বিনিময় করত।
কাশ্মীরীরা দাদন দিয়ে সুন্দরবনে নুন তৈরি করাত। কাশ্মীরী আর আর্মেনিয়ানেরা বাংলা
থেকে নেপালে ও তিব্বতে চামড়া, নিল, মণিমুক্তা, তামাক, চিনি, মালদহের সাটিন নিয়ে
যেত।
১৭৭২ সালের জয় নারায়নের হরিলীলায় লিখিত আছে একজন বৈশ্য
হস্তিনাপুর, কর্ণাট, বঙ্গ, কলিঙ্গ, গুর্জর, বারাণসী, মহারাষ্ট্র, কাশ্মীর,
পাঞ্চাল, কাম্বোজ, ভোজ, মগধ, জয়ন্তী, দ্রাবিড়,
নেপাল, কাঞ্চী, অযোধ্যা, আবন্তী, মথুরা, কাম্পিল্য, মায়াপুরী, দ্বারাবতী,
চীন, মহাচীন, কামরূপে ব্যবসা করত। চন্দ্রকান্ত নামে এই সময়ের আরেকটি গ্রন্থে লেখা
আছে – চন্দকান্ত নামী এক মল্লভূম নিবাসী গন্ধবণিক সাতটি নৌকো নিয়ে গুজরাট
গিয়েছিলেন।
বাংলাদেশের ঐশ্বর্য অতুলনীয় ছিল – চিনা রাজদূতদের বর্ণনায়
আছে ভোজের পরে সোনার বাটি, পিকদানি, সুরাপাত্র ও কোমরবন্ধ ও তার সহকারীদের ঐ সব
রূপোর দেওয়া হয়েছিল। তারিখ-ই-ফিরিস্তা আর রিয়াজ-উস-সালাতিনে আছে গৌড় আর
পুর্ববঙ্গের ধনীরা সোনার থালায় খেতেন। আলাউদ্দিন হোসেন সাহ গৌড় লুঠ করে ১৩০০ সোনার
থালা আর বহু রত্ন পেয়েছিলেন। চৈতন্য চরিতামৃতে আছে হিরণ্য-গোবর্ধন নাম দুই সহোদর।/
সপ্তগ্রামে বার লক্ষ মুদ্রার ঈশ্বর।।
সিজার ফ্রেড্রিক লিখছেন সপ্তগ্রাম থেকে প্রতি বছর ৩০-৩৫টা
বড় জাহাজ মাল নিয়ে আসত আর পণ্য বোঝাই করে ফিরে যেত।
ইবন বতুতা পণ্যের দামের তালিকা দিয়েছেন – মজুমদার মশায়ের বই
লেখার সময়ের পয়সায় মূল্য(কবে? বইতে এই সময় বলে ১৯৩৮ একবার বলা আছে)
১ মন চাল ১২ পয়সা, ১ মন ঘি ১৪৫ পয়সা, ১ মন চিনি ১৪৫, ১ মন
তিল তেল ৭৩, ১৫ গজ ভাল কাপড় ২০০, ১টা দুধ দেওয়া গরু ৩০০, ১২টা বড় মুরগী২০, ১টা
ভেড়া ২৫ পয়সা। এক বৃদ্ধ মুসলমান তাঁকে বলেছিলেন তিনি তার স্ত্রী আর তার এক ভৃত্যের
সারা বছরের খাওয়া খরচ ১টাকা ছিল।
কবিকঙ্কণ চণ্ডীতে দুর্বলার বেসাতিতেও দামের ধারণা পাওয়া
যায়।
মুর্শিদাবাদের ১৭২৯ সালের দাম প্রতি টাকায়
বাঁশফুল ভাল ১ মন ১০ সের, ঐ মাঝারি, ১মন ২৩ সের, ঐ তৃতীয় ১
মন ৩৫ সের, মোটা দানা দেশনা ও পূরররবী চাল ৪ মন ২৫ সের, মোটা মুশসারা ৫ মন ২৫ সের,
মোটা কুরাশালী ৭ মন ২০ সের, ভাল গম ৩ মণ, দ্বিতীয় ৩ মন ৩০ সের, তেল প্রথম ২১ সের,
ঐ দ্বিতীয় ২৪ সের, ঘি প্রথম সাড়ে দশ সের, ঐ দ্বিতীয় সোয়া ১১ সের, কাপাস তুলো মণ
প্রতি ২ থেকে আড়াই টাকা।
No comments:
Post a Comment