আপনাদের অনেকেরই মনে থাকতে পারে মাস ছয়েক আগে মুঘল রাজত্বের অমুসলমান মুন্সি চন্দ্র ভান ব্রাহ্মণকে নিয়ে লিখেছিলাম, তাঁর জীবন, মুঘল আমলের শুলইকুল নীতি কিভাবে কাজ করত ইত্যাদি। তাঁর একটি বইএর কথা রাজীব কিনরা রাইটিং সেলফ, রাইটিং এম্পায়ার বইতে আলোচনা করছেন, নাম তারিখিরাজাইদিল্লি। বইটির একটামাত্র পাণ্ডুলিপি পাওয়া গিয়েছে। ২০টি পাতার। খুব বেশি আলোচিতও নয়। কেন নয় তার কিছু কারণ পরের দিকে আলোচনা করা যাবে।
বইতে দিল্লিতে পৌরাণিক আমল থেকে শাহজাহান পর্যন্ত যে সব রাজা রাজত্ব করেছেন, তাঁদের বর্ণনা তিনি লিখেছেন। তিনি জানাচ্ছেন, বইটি লিখার গবেষণার কাজে বেশ কিছু হিন্দি এবং অন্যান্য বই(আজ কুতুবই হিন্দি ওয়া দিগর জারাইদিতারিখ) এর সাহায্য নিয়েছেন। বইটির নামের সঙ্গে তারিখ শব্দটা জুড়ে থাকলেও এটি কোনভাবেই দিল্লির ইতিহাস নয়, বরং কিছু ছোট্ট মন্তব্য সহ রাজাদের রাজত্বের সন তারিখ। চন্দ্র ভান প্রত্যেক রাজার রাজত্বকালের সময়ের দিনশুদ্ধ বর্ণনা দিয়েছেন। উদাহরণস্বরূপ, তিনি বলছেন মহাভারতে উল্লিখিত যুধিষ্ঠির হিন্দুস্থানের অন্যতম প্রধান রাজা ছিলেন(আজ বুজুর্গতারিন রাজাহায়ি হিন্দুসথা বুদ), রোজ তিনি দশ হাজার মানুষকে খাইয়ে নিজে খেতে বসতেন, তিনি তেত্রিশ বছর আট মাস এবং পঁচিশ দিন রাজত্ব করেন(হুকুমত কার্দা)। যুধিষ্ঠিরের ভাই অর্জুন, পাণ্ডবদের উত্তরপুরুষ(ওয়াকাতই পাণ্ডবন), জন্মেঞ্জয় চুরাশি বছর, পাঁচ মাস এবং সতের দিন রাজত্ব করেন। তাঁর সময়ে এক লক্ষ শ্লোকওয়ালা মহাভারত রচনা করেন বেদ ব্যাস। ত্রয়োদশ শতকের তোমর বংশের রাজা সুরজ পাল তার সময়ের সব থেকে নামী রাজা ছিলেন এবং তিনি আঠান্ন বছর দুই মাস এবং পাঁচ দিন রাজত্ব(ফারমানডিহি কারদা) করেন এবং তাঁর হাতিশালে ছয় হাজার হাতি ছিল, তার সময়ে তিনি রাজসূয় যজ্ঞ করেন(দার আলমগিরি যজ্ঞয়ি রোজগার বুদ)। ছাব্বিশ বছর নয় মাস এবং সাতাশ দিন রাজত্ব করা রাজা জীবন জিতের গুপ্তবিদ্যায় বিপুল জ্ঞান ছিল(দার মারিফাতি ওয়াজিব সায় মাউফুরা দস্ত)। কিন্তু জ্ঞানটি কি ধরণের সে বিষয়ে তিনি বিশদ কিছু লিখে যান নি। একাদশ শতকে গজনীর মুহম্মদের সঙ্গে বহুবার যুদ্ধ করা দিল্লির রাজা আনন্দ পালের যুদ্ধ হয়। আনন্দ পালের হারেমে সাত হাজার উপপত্নী ছিল এবং তাঁদের সক্কলের সঙ্গে তিনি টানা দুদিন ধরে উপগত হতে পারতেন।
সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ হল তিনি ইতিহাসকে দেখছেন নতুন দৃষ্টিতে। দিল্লি, মধ্যযুগে আধুনিক ঐতিহাসিকদের বর্ণনায় মুসলমান যুগে প্রবেশ করল। আশ্চর্যের চন্দ্র ভান কিন্তু এই যুগ ভাগ করছেন না। তিনি পৌরাণিক কাল থেকে শুরু করে শাহজাহানের আমল পর্যন্ত লিখছেন কিন্তু কোনভাবেই বলছেন না, প্রাচীন কাল থেকে এসে এটি মুসলমানযুগে প্রবেশ করল। তাঁর দৃষ্টিতে আদতে শাসনের ধারাবাহিকতা ধরা পড়েছে – হিন্দু যুগ থেকে মুসলমান যুগে প্রবেশ নয়। যদিও তাঁর লেখায় বোঝা যাচ্ছে তার একটা আবছা ধারণা ছিল যে ভারত ধার্মিক-কৃষ্টির নতুন ধরণের সময়ে প্রবেশ করতে চলেছে। কিন্তু কোথাও তিনি নব্য রাজাদের সময়কে মুসলমান শাসন বা অন্য হিসেবে দেগে দেন নি। রাজাদের উপাধি বর্ণনায় শুধু রাজা থেকে পাদশা হয়েছে, তার বেশি নয়। তিনি বুঝেছিলেন নতুন রাজাদের ধর্ম তাদের নামেই প্রকাশিত। আজ ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক বা হিন্দু জাতীয়তাবাদী ইতিহাস সূত্রে আমাদের মনে গেঁথে গিয়েছে যে মুসলমান শাসন এই উপমহাদেশে সভ্যতায় বিপুল পরিবর্তন এনেছে। চন্দ্র ভান কিন্তু সেই তত্ত্বে বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি মনে করছেন না যে উপমহাদেশে কোথাও রাজত্বের প্রবাহমানতায় ছেদ পড়েছে। পুরোনো নামের বদলে নতুন নাম ব্যবহার করছেন মাত্র, এবং রাজত্ব বোঝাতেও যে শব্দ/ক্রিয়াপদ তিনি তথাকথিত হিন্দু যুগে ব্যবহার করছিলেন ঔপনিবেশিক ইতিহাস যাকে মুসলমান যুগ বলছে, সে সময় বর্ণনাতেও তিনি একই শব্দ/ক্রিয়াপদ(হুকুমত কার্দাঁ, সুলতানত কার্দাঁ, ফারমান-দিল্লি কার্দাঁ) ব্যবহার করছেন।
সূত্রঃ রাইটিং সেলফ, রাইটিং এম্পায়ার, রাজীব কিনরা
No comments:
Post a Comment