বাঙালির ইতিহাস- আদিপর্বতে নীহাররঞ্জন রায় আনুগামী হয়ে দেখা যাক সরস্বতী নদী বিষয়ে তিনি কী মত পোষণ করছেন-
ভগীরথ কর্তৃক গঙ্গা আনয়ণ গল্প রামায়ণেও আছে এবং সেখানেও গঙ্গা বলিতে রাজমহল-গঙ্গাসাগর প্রবাহকেই যেন বুঝাইতেছে। যুধিষ্ঠির গঙ্গাসাগর-সংগমে তার্থস্নান করিতে আসিয়াছিলেন, এবং সেখান হইতেই গিয়াছিলেন কলিঙ্গদেশে। রাজমহল-গঙ্গাসাগর প্রবাহই যে যথার্থ ভাগীরথী, ইহাই রামায়ণ-মহাভারত-পুরাণের ইঙ্গিত, এবং এই প্রবাহের সঙ্গেই সুদূর অতীতের সূর্যবংশীয় ভগীরথ রাজার স্মৃতি বিজড়িত. উইলায়ম উইলককস সাহেব এই ভগীরথ-ভাগীরথী কাহিনীর যে পৌর্তিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন তাহা ইতিহাস সম্মত বলিয়া মনে হয় না. পদ্মা-প্রবাহ অপেক্ষা ভাগীরথী প্রবাহ যে অনেক প্রাচীণ এ সম্বন্ধে কোন সন্দেহের অবকাশ নাই. যাহা হউক জাও ডি ব্যারোস(১৫৫০) এবং ভন ডান ব্রোকের নকশায়(১৬৬০) পুরাণোক্ত প্রাচীণ প্রবাহ পথের ইঙ্গিত বর্তমান বলিয়া মনে হয়. এই দুই নকশার তিলনামূলক আলোচনা করিলে দেখা যাইবে, সপ্তদশ শতকে জাহানাবাদের নিকট আসিয়া দুইভাগে বিভক্ত হইয়া দামোদরের একটি প্রবাহ(ক্ষমানন্দ কথিত বাঁকা দামোদর) উত্তর-পূর্ববাহিনী হইয়া নদীয়া-নিমতার দক্ষিণে গঙ্গায়, এবং আর একটি প্রবাহ দক্ষিণ বাহিনী হইয়া নারায়ণগড়ে্র নিকট রূপনারায়ণ-পত্রঘাটার সঙ্গে মিলিত হইয়া তম্বোলি বা তমলুকের পাশ দিয়া গিয়া সমুদ্রে পড়িতেছে. আর মধ্য ভূখণ্ডের ত্রিবেণী-সপ্তগ্রামের নিকট হইতে আর একটি প্রবাহ(অর্থাত সরস্বতী) ভাগীরথীর হইতে বিযুক্ত হইয়া পশ্চিম দিকে দক্ষিণবাহিনী হইয়া কলিকাতা-বেতোড়ের দক্ষিণে পুণর্বার ভাগীরথীর সঙ্গে যুক্ত হইয়াছে. এক শতাব্দী আগে, ষোড়শ শতকে জাও ডি ব্যারোসের নকশায় দেখিতেছি, সরস্বতীর একেবারে ভিন্নতর প্রবাহ. সপ্তগ্রামের(Satigam) নিকটেই সরস্বতীর উত্পত্তি, কিন্তু সপ্তগ্রাম হইতে সরস্বতী সোজা পশ্চম বাহিনী হইয়া যুক্ত হইতেছে দামোদর প্রবাহের সঙ্গে, বাঁকা দামোদরের সঙ্গমের নিকটেই. এই বাঁকা দামোদরের কথা বলিয়াছেন সপ্তদশ শতকের কবি ক্ষেমানন্দ(১৬৪০) তাঁহার মনসামঙ্গল কাব্যে. ...যাহাই হউক, দামোদর বর্ধমানের দক্ষিণে যেখানে হইতে দক্ষিণবাহী হইয়াছে, সেখানেই সরস্বতীর সঙ্গে তাহার সংযোগ- ইহাই জাও ডি ব্যারোসের নকশার ইঙ্গিত.আমার অনুমান, এই প্রবাহপথই গঙ্গা-ভাগীরথীর প্রাচীণতর প্রবাহ পথ, এবং সরস্বতীর পথ ইহার নিম্নঅংশ মাত্র. তাম্রলিপ্তি হইতেই বাণিজ্যপোতগুলি পাটলিপুত্র-বারানসী পর্যন্ত যাতায়াত করিত.
সঙ্গের ছবিটি ভ্যান ড্যান ব্রোকের মানচিত্র
No comments:
Post a Comment