জেমস হোলজম্যান(১৯২৫)
{হোলজম্যান ভারত থেকে হেস্টিংসএর খুব বেশি অর্থ না নিয়ে আসার তত্ত্ব সমর্থন করেছেন। ভারতে হেস্টিংস আর তার বন্ধুরা ১১৭৭৬এর গণহত্যাতেও বিপুল লুঠ চালিয়েছিলেন, ফলে অন্যসময়ে যে কিভাবে লুঠেছেন তা আন্দাজ করা শক্ত নয়। "দ্বিতীয় ইতিহাসঃ লুঠেরা ইংরেজ, সাথী মধ্যবিত্ত, সাংস্কৃতিক গণহত্যা আর গ্রামীন স্বাধীণতা সংগ্রাম" নামক খোঁজে পার্থ পঞ্চাধ্যায়ী, বিশ্বেন্দু নন্দ, এবং কলাবতী মুদ্রার নথিকরণ দল দেখিয়েছে কি ধরণের লুঠের কাজ চলত বাংলায় হেস্টিংসের নেতৃত্বে। সেখান থেকে কয়েকটি স্তবক তুলে দেওয়া গেল -
ব্যবসার নামে লুঠ ছাড়াও সরকারের সঙ্গে লাভের চুক্তিতে চাকুরে ইংরেজরা রোজগার করত। বাঙালা সুবায় ব্যবসার আধিপত্য চালাবার জন্য বোর্ড অব ট্রেড তৈরি করেছিলেন হেস্টিংস। সদস্যরা নিজেদের মধ্যে গোপন চুক্তি করত, উত্পাদকদের সঙ্গে সঙ্গে কোম্পানিকে পর্যন্ত ঠকিয়ে টাকা বানাত – ঠকচাচা হেস্টিংস সব জানত শুধু নয়, নিজে এই পরিকল্পনাটির জন্মদাতাও বটে। ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধবসহ ওয়ারেন হেস্টিংসএর উপবৃত্তে ঘোরাফেরা করা বন্ধুরাই এই ধরনের পড়ে পাওয়া চৌদ্দ আনা লাভের সুযোগ পেত। ১৭৬৩ থেকে দাউদাউ জ্বলতে থাকা গ্রামীণ বাঙলার দ্বাধীনতা সংগ্রাম দমন করার সাথীরূপে, সক্রিয়ভাবে দেশিয় শূদ্র-বৈশ্য-মুসলমান ব্যবসায়ীদের মাজা ভেঙে সম্রাজ্যের ভিত শক্ত করার প্রতিক্রিয়ায়, গ্রাম বাঙলা ছেড়ে কলকাতা শহরে চলে আসা বাঙালি গোমস্তা, বেনিয়ান, দালাল, সেরেস্তাদার আর পাইকারেরা, এই লাভের লুঠের বখরা পেয়েছেন। এঁরা আর এঁদের উত্তরসূরীরা আগামীদিনে বাঙলার নবজাগরণের উদিতসূর্য অভিধা অর্জন করবেন, সর্বজনমান্য হয়ে রইবেন আজও।
বোর্ড অব ট্রেডএ বন্ধু-ব্যবসায়ীদের(বন্ধুরা সবসময়ে ব্যবসায়ীই যে হতেন এমন নয়) সঙ্গে বাঁধ দেওয়া, রাস্তা চওড়া করা, রাস্তা তৈরি করা, কোম্পানিকে ঘোড়া, ষাঁড়, আফিম, নানান উচ্চলাভের অসামরিক-সামরিক দ্রব্য যোগান দেওয়ারমত লোভনীয় সরকারি চুক্তি হত। স্টিফেন সুলিভান, চার্লস ক্রফটস, চার্লস ব্লান্ট, জন বেলি প্রভৃতিরা এই সমস্ত উচ্চ মুনাফাদার সরকারি ব্যবসার সুযোগ পেতেন। মাটিতে দাঁড়িয়ে ব্যবসা পরিচালনা করতেন কিন্তু ইংরেজ অনুগামী বাঙালি গোমস্তা, বেনিয়ান, দালাল, সেরেস্তাদার, পাইকার আর ব্যবসায়ীরা। বোর্ড অব ট্রেডএর ব্যবসার আকাশ ছোঁয়া লাভের অধিকাংশ যেত ইংরেজদের সিন্দুকে, ছিটেফোঁটাতেই খুশি থাকতে শিখেছিলেন এদেশিয় দালালেরা।
বোর্ড অব ট্রেডএর চুক্তিতে ক্ষুব্ধ কোম্পানির ডিরেক্টর সভা কর্মচারীদের দেশে ফেরার পর কয়েকজনের নামে মামলা দায়ের করে – যাদের মধ্যে প্রভাবশালী হেস্টিংসও ছিলেন। ভারতে কোম্পানির আমলাদের ব্যবসায় বাস্তবিক যে ইতরবিশেষ ঘটেনি তার প্রমাণ ব্যবসায়ীদের থেকে হেস্টিংসের বেনিয়ান কান্তবাবু, আরও পরে রামমোহন, দ্বারকানাথদেরমত মানুষদের অবাধে বেড়ে চলা দস্তুরি নেওয়ার প্রবণতা থেকে। দেশিয়দের খুঁটি ইংরেজ বড় আমলারা, যাঁরা বাঙালি গোমস্তা, বেনিয়ান, দালাল, সেরেস্তাদার আর পাইকারদের মাধ্যমে বাঙলায় অবৈধ ব্যক্তিগত ব্যবসা করত। পণ্য কেনার সময় বাঙালি কর্মচারীরা দস্তুরি নিত, প্রতি টাকায় পাঁচ গণ্ডা থেকে ৩০ গণ্ডা দরে। কোম্পানি কর্মচারীদের লুঠের কাজে সরাসরি সাহায্য করত বাঙালি গোমস্তা, বেনিয়ান আর দেওয়ানরা দুহাত ভরে। এরাই বেনিয়ান রামমোহন রায় অথবা ব্যবসায়ী দ্বারকানাথ ঠাকুরের পূর্বসূরী।
ইংরেজেদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায়রত দেশিয় ব্যবসায়ী আর রায়তদের অসীম দুর্দশায় ইংরেজ কর্মচারীরা আর ইংরেজমুখী বাঙালি কর্মচারী, দালালেরা রোজগার করতেন। বাঙলায় মুক্তিসূর্য রামমোহন-দ্বারকানাথসহ কলকাতার অমিততেজেরা, অথবা রেনেসাঁজাত খ্যাত অখ্যাত নানান ব্যক্তিত্ব কোথা থেকে তাদের ব্যবসা শুরুর অর্থ অথবা নিজেদের ঠাটবাট বজায় রাখার সম্পদ পেতেন, তার রহস্য বাঙালি গোমস্তা, বেনিয়ান, দালাল, সেরেস্তাদার আর পাইকারদের অবৈধ দস্তুরির রোজগার আর ব্রিটিশদের সঙ্গে লুঠের অবৈধ ব্যবসার সাথী হওয়া থেকে পরিস্কার।
মুর্শিদাবাদের দরবারে রেসিডেন্ট কমিশনার সাইক্স সোরা, রেশম আর কাঠের ব্যবসার সেলামি থেকে একা রোজগার করেছেন বার থেকে তের লক্ষ টাকা, তার দেওয়ান অথবা বেনিয়ান কত রোজগার করেছে তা অনুমানযোগ্য এবং তার কর্তা হেস্টিংস কত রোজগার করেছেন এই প্রশ্ন সকলের জন্য পেশ করা গেল।}
কোম্পানির কেন্দ্রিয় দপ্তর লিনডেলহন স্ট্রিট স্কটের যেন ঘরবাড়ি ছিল। কিন্তু
সেখানেও তিনি কান পেতে রইতেন তার বাবু সম্বন্ধে কোন বিপরীত মন্তব্যের। কোর্ট অব
ডিরেক্টর্সের চেয়ারম্যান রবার্ট গ্রেগরি সম্বন্ধে তিনি ১৭৮২ সালের ৩ মার্চের
চিঠিতে লিখছেন, প্রায় সব কিছুতেই গ্রেগরি আপনার বিপক্ষতা করেন। ২৫ মের চিঠিতে দেখা
যায় গ্রেগরির মনের পরিবর্তন আসছে আবার ২০ জুনের চিঠিতে তিনি আবার আপনার
বদ্ধপরিকরভাবে শত্রু হয়ে উঠেছেন। ১২ তারিখের চিঠির পুনশ্চতে লিখছেন, আমরা নিশ্চিত
গ্রেগরি নিজেই তার পদত্যাগপত্র পেশ করবেন। আমরা যেভাবে তাকে ব্যঙ্গ করতাম তা তিনি
হয়ত সহ্য করতে পারেন নি। সে আধা হতচ্ছাড়া লোক ছিল।
তার চিঠি প্রচুর জোরালো মানবিক উপাদানে ভরপুর থাকত। ঠিক যে জন্য হেস্টিংস তাকে
পছন্দ করেছিলেন এবং এই জন্যই তার রাজনৈতিকভাবে পরাজয় ঘটেছিল। ফ্রান্সিস নামক
জাহাজে তার চিঠি পাঠাবার প্রসঙ্গে মন্তব্য করছেন এই নামটা আমি সবচেয়ে ঘৃণা করি।
হাউসের একটি কমিটির সামনে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে তিনি বলেন, মিস্টার ফ্রান্সিস আজ
আপনাকে ভদ্র তো লাগছেই তার সঙ্গে মনে হচ্ছে আপনি ভেড়াবেচা ছোটলোক। একটা চিঠিতে
মিসেস সিডনসের একটা ছবি দিয়ে তিনি লিখলেন, তিনি লন্ডনের যে কোন দুর্ঘটনাকে ম্লান
করে দিতে পারেন, সুদূর লন্ডনে তিনি মিসেস হেস্টিংসের পরিপূরক হয়েই থাকবেন। কখোনো
তিনি মিসেস হেস্টিংসকেও লিখতেন। মেরি বারওয়েল(বারওয়েলের উৎকেন্দ্রিক অবিবাহিত বোন)
এক হপ্তার জন্য তার সঙ্গে প্রায় রাতে দেখা করতে আসতেন এক থলে মন্তব্য নিয়ে; তিনি
আপনার উদ্দেশ্যে বলতে বলতেন যে বাংলার মিস উইলিয়ামস এখনও স্বামী জোটাতে পারে
নি(যদিও পরে তিনি হেস্টিংস ঘনিষ্ঠ চার্লস চ্যাপম্যানকে বিয়ে করেন)।
অনুগামী মেজর স্কট হেস্টিংসকে বার বার বলতেন ইংলন্ডে ফেরার আগে নিজের ভাগ্য
ফেরাতে। লর্ড নর্থ, লর্ড ম্যানসফিল্ড, এমন কি তার শত্রু গ্রেগরি বলতেন বাংলার মত
গুরুত্বপূর্ণ সাম্রাজ্যে গিয়ে এত দিন থেকে ২ লক্ষ পাউন্ড এবং বছরে পাঁচ হাজার
মাসোহারার বন্দোবস্ত করার ব্যবস্থা করে তার এদেশে আসা উচিৎ। হয়ত হেস্টিংসের এর
অর্ধেক সম্পদ ছিল না। ১৭৮২ সালে তার অন্যতম উকিল স্যর ফ্রান্সিস সাইকস স্কটকে
লিখছেন, হেস্টিংস যদি আমার ১ লক্ষ পাউন্ড দেয় তাহলে তাকে আমি একটি গোটা বরোর দুটি
আসন দিতে পারি। এ ছাড়া তার পক্ষে এ দেশে প্রাধান্য পাওয়া খুব কঠিন।
স্কট নিজের জন্য খুব বেশি খরচ করতেন না। এবং তিনি টাকা অযথাও খরচ করতেন না।
আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে আমি একজন সম্পাদককে আপনার পক্ষে লেখার জন্য ১ হাজার
পাউন্ড দিয়েছি, এবং এর চল্লিশগুণ একজন দুর্নীতিগ্রস্ত পার্লামেন্টেরিয়ানকে দেওয়া
অযুক্তিযুক্ত কেননা, সেই ঘুষ দিয়ে প্রবন্ধ প্রকাশ করা কাগজটা ট্যাভার্নে রাকাহ
আথাকে এবং আমি আনন্দের সঙ্গে সেই সংবাদটি নিয়ে ট্যাভার্নে আপনার বন্ধুদের সঙ্গেও
আলোচনা করতে পারব। ১৭৮৪ সালের জুলাইতে ১৭০০ পাউন্ড খরচ হয়েছে প্রবন্ধ ছাপার জন্য
আর ৪০০০ পাউন্ড পার্লামেন্টে বসার জন্য।
(তৃতীয় অধ্যায় শেষ)
No comments:
Post a Comment