জেমস হোলজম্যান(১৯২৫)
{সেসময়
পৃথিবীর চারটে শহর ছিল বিশ্ব হিরে ব্যবসার কেন্দ্র – গোয়া, আমস্টার্ডাম, লিসবন আর
লন্ডন। হিরে ব্যবসা কোম্পানির একচেটিয়া সনদের বাইরে ছিল। আমলা আর ইন্টারলোপার্সদের
লন্ডনে তাঁদের ব্যবসা উদ্বৃত্ত লাভ পাঠাবার একটা সাধারণ পদ্ধতি ছিল গোয়ার হিরের
বাজার থেকে হিরে কিনে লন্ডনে পাঠানো – সেটি কোম্পানির ভারতে ব্যবসার প্রথম যুগ
থেকেই ঘটত – মোগল যুগে হিরের বিপুল ব্যবসায়ী ছিলেন ঔরঙ্গজেবের সেনাপতি মীর জুমলা –
তার নিজেরই ২২টা খনি ছিল। কিন্তু পলাশীর পরে গোয়া থেকে এই ব্যবসা অচিরেই মাদ্রাজে
সরে আসে।
কোম্পানির বড় আমলারা যেমন টমাস
পিট(প্রধানমন্ত্রী উইলয়ম পিটের ঠাকুর্দা) ১৭০২ সালে মাদ্রাজ থেকে তাঁর ব্যবসা
উদ্বৃত্ত অর্থ ২৪ হাজার পাউন্ড - তখনকার দিনের ২০ লক্ষা টাকা তিনি রোজগার করেন
গভর্নরগিরি করে। সেই পরিমান কত ছিল একটা অনুমান করা যাক - তার ১০০ বছরেরও বেশি পর ১৮২০ সালে
মূল্যবৃদ্ধির কলকাতায় মাসে ২ টাকা রোজগার করে নিজেকে স্বচ্ছল ভাববেন ঠাকুরদাস,
বিদ্যাসাগরের বাবা - হিরে কিনে লন্ডনে পাঠান। তার পর থেকেই লন্ডনে তাঁর ডাক নাম হয়ে
যায় ডায়মন্ড পিট। কিন্তু হিরে বা কোম্পানির ব্যবসার বাইরে থাকা অন্যান্য লাক্সারি
দ্রব্য কিনে পাঠানো খুব ঝুঁকির কাজ হয়ে যেত কেননা এই বাজারটা নিয়ত্রণ করত রত্ন
ব্যবসায়ী ইহুদিরা। এই লাক্সারি পণ্যগুলির দামও সবসময় ঠিক পাওয়া যেত না। তাই সরাসরি
লন্ডনে নগদী অর্থ পাঠানোই কাম্য ছিল। সেই পথ খুঁজছিলেন ব্যক্তিগত ব্যবসায়ীরা)}
নবোবেরা এত বেশি হিরে কিনে লন্ডনে পাঠাতে থাকে যে লন্ডনে এর মূল্য পড়তে শুরু
করে। টুনব্রিজে আমোদ-প্রমোদ করার সময় মিসেস হেস্টিংস ২০০০০ পাউন্ডের গয়নায় নানান
ধরণের মণি মুক্তো দামি ধাতু পরেছেন, এই তথ্য অস্বীকার করলেন। আরেক ক্ষতিকর
সম্পত্তি হল আমদানি হল নবোবদের সঙ্গে ভারত থেকে আনা গয়নাগাঁটি। রাজার একমাত্র
অতিরিক্ততম ‘দুর্বলতা’ ছিল হীরের প্রতি এবং ক্লাইভ এবং হেস্টিংস উভয়েই রাজার এই
দুর্বলতাটুকু সুন্দরভাবে তাদের স্বার্থের পক্ষে কাজে লাগিয়েছেন।
নবোবদের মধ্যে লর্ড পিগোর সিন্দুকে থাকা সব থেকে আকর্ষণীয় হিরেটি ছিল। এটি তার
নামে বিখ্যাত হয়। সেটি ইওরোপে সুন্দরতম হিরেগুলির মধ্যে অন্যতম না বলে বলা দরকার
সুন্দরতম ছিল। পিগো হিরেটির ওজন ছিল ৪৭ থেকে ৮২ ক্যারাটের মধ্যে। ১৮০০ সালে লটারির
মধ্যে দিয়ে ২৪০০০ পাউন্ডে এটি হাত বদল হয়। চার বছর পর এটি রানী জোসেফাইনের
গলবন্ধনীর জন্য ক্রীত হয়। শেষতম মালিক ছিলেন মিশরের আলি পাশা। তিনি এর জন্য ৩০০০০
পাউন্ড দাম দেন। এবং ১৮৮২ সালে মৃত্যুর সময় এটিকে ধ্বংস করে ধুলোয় করে দেওয়ার
নির্দেশ দিয়ে যান।
নবোবেরা ভারতীয় পরিবেশকে নিজেদের মত করে সাজিয়ে নিয়ে আপন মাধুরী মিশিয়ে একটি
ইঙ্গ-ভারতীয় জীবনযাত্রা তৈরি করেছিলেন। সেই জীবনযাত্রা সেই সময়কার ইংলন্ডে কিছুটা
হলেও প্রভাব ফেলেছিল। ব্রিটিশ খাদ্য তালিকায় কারি নামক একটা পদ জুড়ল তখন থেকেই। ১৭৭৩
সালেই নরিস স্ট্রিটের কফি হাউস, হেমার্কেট এলাকার রেস্তোঁরায় প্রতিষ্ঠিত এবং বিশেষ
পদ হয়ে উঠেছে। এগারো বছর পরেও তার সুগন্ধ
বিন্দুমাত্র হ্রাস হয় নি। ১৭৮৪ সালের এয়ার স্ট্রিটের ২৩ পিকাডেলির বিজ্ঞাপনের বয়ান
বলছে, কারি ...আপনার পাকস্থলীকে খাদ্য জীর্ণ করতে সাহায্য করে, ফলে রক্ত মুক্ত হয়ে
সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে, মন খুশিতে ভরপুর হয়, মানবজাতির যে কোন খাদ্যকে সে উচ্চাঙ্গে
তুলে নিয়ে যায়।
১৭৮৫ সালের হেনরি ম্যাকেঞ্জির ইনফ্লুয়েন্স অব দ্য নেবারহুড অব দ্য রিচ
এশিয়াটিক-এ জন হোমসপান দুঃখ করে বলছেন, আমাদের বার্ণ ডোর মুরগিগুলি এত চর্বিওয়ালা,
এত স্বাদু অথচ এখন আমরা রসুন আর গোলমরিচ ঠেসে তাকে কারি আর পিলাও(পোলাও)এ পরিণত
করে ফেলছি; যতদিন না ব্রিটিশেরা মিস্টার মাশরুমের ইন্ডিয়া মদিরা খায় নি তত দিন
অক্টোবর মাসে প্রতিবেশীদের দেখিয়ে দেখিয়ে আমার পরিবার জাঁক করে মুর্গীর স্বর্গস্বাদ
অনুভব করেছি।
মদিরা ছিল এক্কেবারে নবোবদের জন্য মদ্য, কেননা ভারতের মত গ্রীষ্ম দেশে মদিরাই
তাদের দেহ ঠাণ্ডা রাখতে পারত। ফলে ভারতে এটি তাদের অবশ্য পানীয় ছিল। মাদ্রাজের
প্রাক্তন প্রয়াত গভর্নর চার্লস স্মিথ এস্কোয়ারের শবদেহ কবর দেওয়া মানুষটি বলছে বহু
বছর ধরে রেখে দেওয়া তিন হাজার ডজন উচ্চশ্রেণীর মদিরা ফেলে দিতে হয়েছে।
নবোবেরা যে সব দেশি চাকরদের আনতেন তারা প্রভুদের মতই স্থানীয় এলাকাতে অজনপ্রিয়
ছিল। যাকে কেউ ফরাসী ভেবে ভুল করা হচ্ছে আদতে হয়ত সে একজন কোঁকড়ানো চুলের বাঙালি
ভৃত্য। এই কিন্তু ভৃত্যদের চাহিদা কিন্তু চূড়ান্ত পর্যায়ে পোঁছে যায়, বিভিন্ন
খবরের কাগজে বিজ্ঞাপনে এদের চাহিদা ক্রমাগত বাড়তে থাকে। বহুসময় পূর্ব ভারতের চাকর
আর গাড়ির পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা ভৃত্যের জন্য মাঝে মধ্যেই বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হত।
No comments:
Post a Comment