Tuesday, February 21, 2017

উপনিবেশ বিরোধী চর্চা১৬ - উনবিংশ এবং বিংশ শতে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র এবং দেশজ চিকিৎসা ব্যবস্থা ১৮০০-১৯৪৭

পুনম বালা

১৮২৭ থেকে টেটলর পশ্চিমি রীতি অনুসারে সংস্কৃত কলেজ এবং কলকাতা মাদ্রাসায় অঙ্ক আর শারীরবিদ্যা নিয়ে ধারাবাহিক বক্তৃতা দেওয়া শুরু করেন। সংখ্যা না জানাগেলেও এনএমআইর শারীরবিদ্যা বিষয়ে কিছু দক্ষ ছাত্র হাসপাতালগুলিতে বা সিভিল সার্জনদের অধীনে কাজ শুরু করে। ১৮৩২ সালের ২৫ মে, সংস্কৃত কলেজ সঙ্গে জুড়ে ছোট একটি হাসপাতাল তৈরি করা হল১০। ১৮৩৩ সালে সংস্কৃত কলেজের সুপারিন্টেন্ডেন্ট এবং লেকচারার ড জে গ্রান্ট হাসপাতালের প্রথম বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করলেন। সেখানে বলা হল হাসপাতালে স্থায়ী রোগীর ৩০টি শয্যা রয়েছে, ১৮৩২ সালের শেষ আট মাসে ১৫৮ জন অস্থায়ী রোগীর চিকিৎসা করা হয়েছে। ভারতীয় ভাষায় ইংরেজি থেকে বিভিন্ন পুস্তক অনুবাদ করা হয়, এই অনুদিত বইগুলির পাশাপাশি দেশিয় চিকিৎসা বিষয়ক পাঠাদান চলতে থাকে। সংস্কৃততে চরক, সুশ্রুত আর ভগভট্ট প্রণোদিত আয়ুর্বেদ শাস্ত্র পাঠদান করার জন্য আরও শিক্ষক নিয়োগ করা হয়। মাদ্রাসায় য়ুনানি এবং আরবি চিকিতসদকেদের জ্ঞান প্রদান করা হত, তবে শুরুহ আসবাব, আকসুরেস, সুদিদি বা আনিসুল মুশারাহিন ছাড়া আর কি কি পুঁথি পড়ানো হত তা আর জানা যায় না।

ভারতীয় ভাষায় অনুবাদ কর্ম চালিয়ে যেতে থাকেন টেটলর যাতে বহু মানুষ তা পড়তে পারেন। তিনি মনে করতেন, যদি সম্ভব নয়, ভারতীয়দের শিক্ষা দিতে হবে ভারতীয় ভাষায়। সংস্কৃতের মত ইংরেজি মাধ্যমে পাড়ানোয় কাজের কাজ হবে না১২।

দেখলাম পশ্চিমি চিকিৎসাবিদ্যা শিক্ষার সঙ্গে দেশজ ভাষায় চিকিৎসাবিদ্যা শিক্ষার সমান্তরাল ব্যবস্থা চলতে লাগল। তবে এই শ্রেণিগুলিতে শব্যবচ্ছেদের উদ্যোগ নেওয়া হয় নি১৩। ১৮৩৫ সালে শব ব্যবচ্ছেদ ডাক্তারি শিক্ষার অঙ্গাঙ্গী নীতি হিসেবে গৃহীত হলে এনএমআইএর বিলয় সুনিশ্চিত হয়। সেই ঘটনা পরের অধ্যায়ে বিশদে আলোচনা করা যাবে।

পাঠ্য পুস্তক সরকারি উদ্যোগে ছাপা হতে শুরু করল। হুপারের এনাটমিস্টস ভেদে-মেকাম অনুবাদের জন্য পণ্ডিত মুধুসুদন গুপ্তকে ১০০০ টাকা সাম্মানিক দেওয়া হয়েছিল১৪। সরকারি উদ্যোগে যেগুলি অনুদিত এবং লিখোগ্রাফি হয় সেগুলির তালিকা দেওয়া গেল-
১। হুপারের এনাটমিস্টস ভেদে-মেকাম
২। ফিজিসিয়ানস ভেদে-মেকাম
৩। সার্জেনস ভেদে-মেকাম
৪। থমসনস কনস্পেকটাস অব দ্য ফার্মাকোপিয়া
৫। ফিফে’র ম্যানুয়াল অব কেমিস্ট্রি এবং কঙ্কুয়েস্টের আউটলাইন অব মিডওয়াইফারি
৬। টুইনিং এবং স্মিথের ট্রপিক্যাল ডিজিজেস
৭। ড থমাসের প্লেগ
৮। টিকাকরণ নিয়ে বই
এনএমআইতে পাঠ্যক্রমে পড়ানো হত এই বইগুলি।

চিকিৎসা পাঠ্যক্রমের অবধি ছিল তিন বছরের। পাঠ্যক্রমে ছিল ফার্মেসি, মেটিরিয়া মেডিকা, ফিজিওলজি এনাটমি। এছাড়াও হাতে কলমে অভিজ্ঞতার জন্য ছাত্রদের নেটিভ হাসপাতাল, সাধারণ হাসপাতাল, কোম্পানি ডিসপেনসারি, আই ইনফার্মারি এবং ডিপার্টমেন্ট অব দ্য সুপারিন্টেরন্ডেন্ট অব ভ্যাকসিনেশনে শিক্ষানবিশী করতে হত।

এনএমআই থেকে সফলভাবে বেরোনো চিকিতসকেদের সম্মান বাড়াতে সাধারণ ভাবে দেশি ডাক্তারদের যে ধরনের মাইনের স্তর নির্দ্ধারিত হয়, তার থেকে বেশি বেতন দেওয়ার সিদ্ধান্ত করে সরকার। সোনাউতে(???) ১৫ থেকে ২০ হল, আর গ্যারিসনে হল ২০ থেকে ২৫। আর ঠিক হল দেশি ডাক্তারদের সাত বছরের চাকরির পরে গ্যারিসনে মাইনে হবে ২৫ টাকা আর ফল্ডে হবে ৩০টাকা(টাকার পরিমানটা কত ছিল তার একটা আন্দাজ দেওয়া যেতে পারে, বিদ্যাসাগ মহাশয়ের পিতা ঠাকুরদাস ১৮২০ সালে মাসিক ২ টাকা রোজগার করে, তার কলকাতায় থাকার মাসিক খরচ এবং তার পরে উদ্বৃত্ত দেশে পাঠাবার তোড়জোড় করছেন, এবং নিজেকে স্বচ্ছচল ভাবছেন - অনুবাদক)। এর সঙ্গে একটা শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছিল, তাকে ন্যুনতম ১৫ বছর চাকরি করতে হবে, যদি না কোন রোগ বা প্রতিবন্ধকতা হয়১৫। মাইনে বাড়িয়ে সরকারি সেবায় নেওয়ার টোপ দেওয়া হল দেশি ডাক্তারদের। এনএমআই বন্ধ করে দেওয়ার ঠিক আগে আগে, ৪ জানুয়ারি ১৮৩১ সালে পলিটিক্যাল এন্ড মিলিটারি কমিটির সিদ্ধান্ত অনুসারে কোম্পানির বাংলার কোর্ট অব ডায়রেক্টর্স এনএমআইর সব সফল চিকিৎসককে পেনসন পাওয়ার অধিকারী ঘোষণা করে।

১৮৩৫ সালে এনএমআইএর দিন শেষ হয়ে গেল। এই বছরে এতদিনের যৌথভাবে দুই চিকিৎসা শিক্ষা পাশাপাশি চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত রদ করা হয়। সেই সিদ্ধান্তটি কি এবং সেটি কি করে বাস্তবায়িত হল সেটি নিয়ে এবারের আলোচনা।
(চলবে)

No comments: