পুনম বালা
খ্রিস্টপূ প্রথম শতক পর্যন্ত ব্রাহ্মণ্যবাদ আর বৌদ্ধদের মধ্যে বিপুল বিবাদ ঘটতে ঘটতে শেষ পর্যন্ত পরস্পরের মধ্যে বিবাদ মিমাংসার উদ্যোগ দেখা দেয়। আমরা এর সঠিক কারণ জানি না। তবে হাতে যতটুকু সূত্র রয়েছে তাতে মনে হয় রাজা এবং অভিজাতরা দুটি ধর্মকেই পৃষ্ঠপোষণা দেওয়া করলেন বলে হয়ে পরস্পরের মিলের সূত্র উদ্ভুত হল।
রাজা অশোক একইসঙ্গে বৌদ্ধ মঠ, এবং শৈব মন্দির একই সঙ্গে স্থাপন করছেন। দুটি ধর্ম এই সময়েই একই সঙ্গে বিকাশলাভ করেছিল, এবং সেসময়ে একজন মানুষ দুটি ধর্মের অনুগামী হয়েছেন, এমনও দেখা গিয়েছে৬১। চিকিতসা শাস্ত্রের ইতিহাসে অশোকের সময় খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। তিনি সারা ভারতে সেবাকেন্দ্র (হাসপাতাল) স্থাপন করেন, যেখানে চিকিতসকেরা অসুস্থদের রেখে চিকিতসা করতেন৬২। আয়ুর্বেদের প্রত্যেকটি ধারা বৌদ্ধ শ্রমনদের মার্ফত বৈদেশিক মাটিতে পা রাখে এবং ভবিষ্যতে সেই দেশগুলিতে মঠ ব্যবস্থা স্থাপিত হয়।
খ্রিষ্ট পাঞ্চাঙ্গের প্রথম সময়েই আয়ুর্বেদ মিশর, গ্রিস, রোম এবং আরবে পৌছিয়ে সেখানকার চিকিতসা ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করে। বৌদ্ধ শ্রমণদের প্রখ্যাতিতেই আয়ুর্বেদের ওপরে বিদেশে আলো পড়তে শুরু করে। বিদেশে আয়ুর্বেদ শুধু যে চিকিতসা শাস্ত্র রূপে প্রতিভাত হয় তাই নয় এটি ভারতীয় সংস্কৃতিরূপেও অভিহিত থাকে। বিদেশ থেকে প্রচুর শিক্ষার্থী ভারতীয় বিজ্ঞান এবং শিল্পকলা শিখতে ভারতে আসতে থাকে। দক্ষিণ ভারতে যে আয়ুর্বেদিয় ব্যবস্থা চালুছিল তার নাম সিদ্ধা – এটি আয়ুর্বেদের তামিল সংস্করণ। তবে আমার আলোচনায় আমি মুলত উত্তর ভারতের চিকিতসা ব্যবস্থা নিয়েই বেশি মনোযোগ দেব।
মৌর্যদের পরে শুঙ্গ আর শকদের সময়ের চিকিতসার ইতিহাস সম্বন্ধে কিছুই আমরা জানি না প্রায়। তারপরে শাসনকর্ম চালানো কুশান বংশ স্তুপ তৈরিতে বিপুল বিনিয়োগ করতে থাকে। কুশানদের শেষ রাজা কনিষ্ক, ব্রাহ্মণ্য ধর্ম অনুগামী হন। তিনি রসায়নাবিদ নাগার্জুনের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তার রাজসভায় চরকও ছিলেন। কুশান রাজত্ব ধর্মীয় এবং সাহিত্যিক কর্মকাণ্ডে পরিপূর্ণ। কণিষ্কর সময়ে খণিজকে আয়ুর্বেদের ওষুধ শাস্ত্রে (ফার্মাকোপিয়া) অন্তর্ভূক্ত করানো হয়। চিকিতসকেরা রাজা এবং রাজসভার পূর্ণ পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছেন এই সময়ে।
গুপ্ত রাজত্বও ব্রাহ্মণত্বের অনুগামী হলেও বৌদ্ধদের প্রতিও তাদের সমদৃষ্টি ছিল। এই সময়ে ভাগবত এবং শৈব শাস্ত্রগুলির উতপত্তি ঘটে। দুটি ধর্মই রাজার পৃষ্ঠপোষণা পেয়ে কাছাকাছি এসেছে। এই সময়ে বেশ কিছু চিকিতসা সংহিতা তৈরি হয়। সম্রাটের নির্দেশে চিকিতসকেরা চিকিতসাবিদ্যা বিষয়ে বিভিন্ন বই লিখেছেন, এবং বিভিন্ন শাস্ত্রে চিকিতসাবিদ্যার প্রয়োগ ঘটিয়েছেন। এই সময়ে চরক এবং সুশ্রুত লিখিত রূপ ধারণ করে। প্রচুর সংহিতা বিকশিত হয়, কিন্তু সংহিতাকারেরা চিকিতসা উপকরণগুলির বিশদ বিবরণ দেন নি। পঞ্চম-ষষ্ঠ শতের চিকিতসক ভগভট্ট চরক সংহিতাকে আটটি অধ্যায়ে সংহত করেন, পরের দিকে এর নাম হয় অষ্টাঙ্গ সংহিতা বা অষ্টাঙ্গ সমগ্র বা অষ্টাঙ্গ আয়ুর্বেদ। বিক্রমাদিত্যের রাজসভায় ধন্বন্তরি নামক চিকিৎসক ছিলেন। ]
আমরা জেনেছি প্রাচীন ভারতীয় সমাজে পুরোহিত এবং ব্রাহ্মণদের ধার্মিক যথেষ্ট প্রভাব ছিল এবং তারা ধর্মের লগুড় ব্যবহার করে জ্ঞান দখল করতেন। এইভাবে তারা সব ধরণের জ্ঞানকে ধর্মীয় ঘোমটা পরাতে চাইলেন। প্রাচীন কাল থেকেই যেহেতু ওষুধের প্রাথমিক লক্ষ্য হল প্রায়োগিক জ্ঞানার্জন, ফলে সবার আগে সেটি ব্রাহ্মণদের কোপে পড়ল। গুপ্ত যুগে যখন আয়ুর্বেদ সম্পাদিত হচ্ছিল, ব্রাহ্মণেরা প্রায়োগিকতার জন্য চিকিতসকেদের আক্রমন করেছেন। ধর্মীয় বিধান হিসেবে আয়ুর্বেদ গুপ্ত যুগেই লিখিত হয়েছে। পরের সময়ে চিকিৎসা সংক্রান্ত শাস্ত্রগুলি ধর্মীয় কুসংস্কারের আখড়া করে তোলা হয়েছে।
সংহিতাকরণের গুরুত্বপূর্ণ কাজটি গুপ্ত-পরবর্তী সময়েই সংহত হয়েছে। এই শাস্ত্রগুলিতে ব্রাহ্মণ্যবাদি ঝোঁক স্পষ্ট। প্রায়োগিক ক্রিয়া ছাড়া চিকিৎসার পুঁথির শুষ্ক জ্ঞানসম্ভারই শিক্ষাদর্শ হল। গোঁড়া পুরোহিততন্ত্রের নীতিগুলি অনুসরণ করতে গিয়ে চিকিৎসাশাস্ত্রে নতুন অধ্যায় যোগ করতে হল। চরক সংহিতায় আত্মাতত্ত্ব এবং তার মুক্তির কথা বলা হল।
(চলবে)
No comments:
Post a Comment