জগদীশ নারায়ণ সরকার
দ্বিতীয় পর্ব
ক। মুঘল কামরূপ উদ্ধার
অসমের দিকে যুদ্ধ জয়ের পথে
১। অহোমদের বিরুদ্ধে উদ্দীপ্ত অভিযানে মীর জুমলা
১৬৬১ সালে রশিদ খানের অভিযানের সংবাদে অহোমেরা হাতিশালা এবং ধুবড়ি ছেড়ে মানস নদী পার করে পশ্চাদপসরণ করে। রশিদ অহোমদ পশ্চিমি অসম থেকে রাঙ্গামাটি পর্যন্ত এলাকা দখলে নিলেন। রাস্তায় চোরাগোপ্তা আক্রমণের ফাঁদ পাতা রয়েছে অশংকা করে মীর জুমলার আসার প্রতিক্ষায় শিবির ফেললেন। অহোম সেনা পিছিয়ে আসার জন্য রাজা দুজন ফুকনকে(দিহিঙ্গিয়া এবং লাহুয়ি) দায়ি করে গ্রেপ্তার কজরলেন এবং দক্ষিণ অসম রক্ষা এবং সেনাবাহিনীর দায়িত্ব দিলেন বরদলোই পরিবারের হিন্দু কায়স্থ ভাণ্ডারী(স্টোরকিপার)মানথির ভরালী বড়ুয়াকে। মানসের মুখে যোগীগুপার নিরাপত্তা জোরদার করা হল। অহোম সেনাপতি আহাতুগুড়িয়া লাহন ফুকন এবং কান্ডু খামনের নেতৃত্বে ব্রহমপুত্রের উল্টো দিকের তীরে পঞ্চরতনে একটি দুর্গ তৈরি করা হল। সেনা অভিযানের কারণ জানতে চেয়ে কামরূপের রাজা অহোম প্রধানকে রশিদ খানের উদ্দেশ্যে দূত হিসেবে পাঠালেন। দুর্বিনীত দূতকে ঢাকায় মীর জুমলার উদ্দেশ্যে পাঠিয়ে দেওয়া হল। তাকে মীর জুমলা জানালেন, রাজা যদি তাদের অধিকারের মুঘল কামরূপ অঞ্চলটি, আর দখলি সম্পত্তি ফিরিয়ে দেন, তাহলে আর মুঘল বাহিনীর আক্রমণের যাবে না বরং তিনি উপযুক্ত উপঢৌকন আর তার মেয়েকে উপহার হিসেবে পাঠাবেন। কামরূপ দখলে না রাখতে পারা ঘিলা বিজয়পুরের জয়নারায়ন অহোম রাজার শাস্তি এড়াতে মীর জুমলার সঙ্গে যোগ দিলে মীর জুমলা বুঝলেন অসম দখলের সুবর্ণ সুযোগ উপস্থিত এবং পরিকল্পিত আরাকান আক্রমন পরের বছরের জন্য আপাতত স্থগিত রেখে কোচবিহার এবং অসম আক্রমনে যাওয়ার প্রস্তাব পাঠান পাদশাহের কাছে। তিনি আওরঙ্গজেবকে লিখলেন অহোমেরা কামরূপ দখল করে এবং আমাদের আক্রমণের পরিকল্পনা করছে। আমার মনে হয় এত কম সময়ে মগ দেশ দখল করা যাবে না, ইতোমধ্যে আমার প্রস্তাব কোচবিহার এবং অসম আক্রমন করা হোক। আওরঙ্গজেব তার সেনানায়কের পরিকল্পনা অনুমোদন করলেন। আহোম রাজা ফুকনদের নির্দেশ দিলেন মুঘলদের কাছে কামরূপ আত্মসমর্পন না করতে, যেহেতু এটি মুঘলদের থেকে নয়, কোচেদের থেকে দখল করা হয়েছে। মীর জুমলা কোচবিহার দখল করার পরে যে প্রস্তাবটি অহোমদের পাঠান, তারা তা উপেক্ষা করলেন।
২। মীর জুমলার আরম্ভিক সমস্যা
৪ জানুয়ারি ১৬৬২ সালে মীর জুমলা বিহার থেকে অসমের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেলেন। রাঙ্গামাটিতে রশিদের ছাউনিতে যোগ দেওয়ার জন্য কুন্তাঘাটের জঙ্গলের পথ ধরলেন। পদাতিক বাহিনীর সুরক্ষায় নাওয়ারা(নৌবাহিনী) ব্রহ্মপুত্র দিয়ে এগিয়ে গেল। স্থানীয় এলাকার ভূমিরূপ না জানা থাকায় মীর জুমলাদের প্রাথমিকভাবে খুব সমস্যা হল। মীর জুমলার নেতৃত্বগুণে এবং বাধানা মানার উদগ্রবাসনায় প্রকৃতি আর মানুষের সমস্ত বাধা তুচ্ছ করে স্থানীয় জমিদারদের থেকে ঠিক খবর সংগ্রহ করে সিদ্ধান্ত নিলেন ব্রহ্মপুত্রর পাড় ধরেই এগোবেন যাতে তার বাহিনীকে সহজে ব্যবহার করা যায়। তিনি তার বাহিনীর নির্দেশক দিলির খান এবং গোলাগুলির ভাণ্ডারের দারোগা মীর মুর্তাজাকে নির্দেশ দিলেন জঙ্গলের কঠিন পথ ছেড়ে ব্রহ্মপুত্রের দিকে এগিয়ে যেতে। তালিশের ভাষায় ‘মানুষের নেতা’ বৃদ্ধ কিন্তু হার না মানা সেনা নায়ক সুর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত রাস্তা তৈরির কাজে নিজে হাত লাগালেন, একমাত্র ছুটি নামাজের সময়টুকু। নানান বাধা অতিক্রম করে রাস্তা তৈরি হল। পদাতিক আর হাতিদের দিয়ে খাগড়া গাছগুলি মাড়ানো হল, হ্রদ আর জলাভূমিগুলি বোজানো হল ঘাস আর গাছের কাণ্ড দিয়ে, নালাগুলি পায়ে হেঁটে পেরোবার উপযুক্ত করে তোলা হল।
যে অমানুষিক পরিশ্রম সেনানায়কদের সঙ্গে সাধারণতম সেনাটি করেছিল তার চোখে দেখা বিবরণ রয়েছে তালিশের লেখায়। বিপুল পরিশ্রমে জঙ্গল পরিষ্কার করে বিশ্রাম নেওয়ার সময় সেনারা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ত, ভুল যায়গায় পা ফেলে কত সেনা মৃত্যুর মুখে পড়েছে, খাগড়ার ছুঁচোল ডগা বহু সেনানীর পায়ে ঢুকে গিয়েছে, বাঁশের আঘাতে রিসালা বাহিনীর সেনানী মৃত্যুমুখে পড়েছে, বন্দুকধারী আর পা দিয়ে তীরছোঁড়ার বাহিনী ভার বইতে বইতে ক্লান্ত অসুস্থ হয়ে পড়েছে। রাস্তার কাদা আর জলাভূমি সেনাবাহিনীর অগ্রগতি প্রায় থামিয়েই দিল। বিপুল সেনাবাহিনীর জন্য শুধুই একটা ছোট রাস্তা বানানো গেল। পশুমানুষ পরস্পরের সঙ্গে গায়ে গা লাগিয়ে সরু রাস্তায় বাধ্য হয়ে কষ্ট করে চলতে লাগল। পরিশ্রান্ত, উদ্ভ্রান্ত হাতির হকি লাঠির মত শূঁড়ের আতর্কিত আক্রমনে, ঘোড়ার চাঁটে, উটের ধাক্কায়, ষাঁড়ের পা আর শিঙের চোটে বহু সেনানী মৃত্যুবরণ করেছে।
ঘন জঙ্গল, নালা, জলাভূমির জন্য সেনাবাহিনী দৈনন্দিন ৪-৫ মাইলের বেশি এগোতে পারল না।
৩। গুয়াহাটি পৌঁছলেন মীর জুমলা
১৭ জানুয়ারি মীর জুমলা মানস এবং ব্রহ্মপুত্রের সংযোগস্থলের উঁচু জমি যোগীগুপার ৫ মাইল পশ্চিমে পোঁছলেন। নদী আর পাহাড়ি উঁচু জমিতে দুর্গ। সেখানে পশ্চিম থেকে অতর্কিতে আক্রমন করা অসম্ভব। অহোমি রণনীতি অনুসরণ করে এই মাটির দুর্গে অহোমরা বাদুলি ফুকনের নির্দেশে দুর্গের পশ্চিম দিকটি ছুঁচল বাঁশের ডগা – ফাঞ্জি, পুঁতে সুরক্ষিত করেছিল এছাড়াও প্রচুর লুকোনো গর্তও তৈরি করে রাখা ছিল। দূর্গের উত্তরটায় লুকোনো গর্ত, জঙ্গল আর পাহাড়ের নিরাপত্তা ছিল। ডাঙ্গারি অহোমেরা এই দুর্গটি পাহারা দিতে দিতে দাস্ত(কলেরা) রোগের প্রাদুর্ভাব হওয়ায় ছেড়ে চলে যায়। ২০ জানুয়ারি যুদ্ধ ব্যতিরেকে এটি দখল করে মীর জুমলার বাহিনী।
দুরন্ত এবং গভীর মানস নদী পার করে মীর জুমলা তার বাহিনীকে দুটি ভাগে ভাগ করেন। তিনি মূল সেনা নিয়ে ব্রহ্মপুত্রের উত্তরপাড় দিয়ে আর দক্ষিণ পাড় দিয়ে সৈয়দ নাসিরুদ্দিন খান এগোলেন। মাঝে ব্রহ্মপুত্রে নৌবাহিনীর সারি, ভূমিতলের বাহিনীর সঙ্গে তাল রেখে চলতে শুরু করে।
মীর জুমলার ত্রিফলা আক্রমন সফল হল। যোগীগুপার পতনের খবর পেয়ে রাজা শ্রীঘাট(সরাইঘাট, রাজার শ্বশুর রাজসাউর)এ বাহিনী পাঠালেন যাতে শত্রুর ওপরে জোরদার আক্রমন চালানো যায়। যোগীগুপার থেকে এই দুর্গটি আরেকটু উঁচু এবং রক্ষণটি বেশ মজবুত, সারসার পাঞ্জি, লুকোনো গর্ত আর বল্লার পাঁচিলে ঘেরা। অহোম বাহিনী আসার আগেই মীর জুমলা শ্রীঘাটে পৌঁছে ‘খাট্টার চৌকি’ এবং এই দুর্গটি দখল নেন। ৪ ফেব্রুয়ারি তিনি শ্রীঘাট এড়িয়ে গিয়ে গুয়াহাটি অবরোধ করেন। খবর পেয়ে রাতের বেলায় আতঙ্কিত অহোম বাহিনী নৌকো করে কাজলির দিকে পালিয়ে যায়। ৫ তারিখে হাজি মহম্মদ বাকর ইস্পাহানিকে নির্দেশ দিয়ে শ্রীঘাটের শালবল্লার পাঁচিল হাতি দিয়ে ভেঙ্গে দেন। দুমাইল দূরে ব্রহ্মপুত্রের উত্তরপাড়ের মুঘল কামরূপের রাজিধানী গুয়াহাটি দখল করেন।
দক্ষিণের বাহিনীটি ফুলবড়ুয়াকে হারিয়ে পঞ্চরত্ন দুর্গটি দখল করে, ফুলবড়ুয়া হেরে সমধারায় পালিয়ে যায়। শ্রীঘাটের উল্টোদিকে শ্রীঘাটের মতই সুরক্ষিত পাণ্ডু দুর্গটি বিনা যুদ্ধে মুঘলেরা দখল করে। পালিয়ে যাওয়া বহু অহোমকে ইয়াগধর খান উজবেগ হত্যা করেন। পাণ্ডুর পূর্বে বেলতলা দুর্গও রাতের আক্রমনে দখল করে রক্ষীদের গণহারে হত্যা করা হয়। পাণ্ডুত ১৪ মাইল কলং নদীর মুখে দূরে শ্রীঘাটের মত গুরুত্বপূর্ণ দুর্গ কাজলিও দখলে আসে। অহোমেরা জাম্বুর্কা, বন্দুক, বারুদ ইত্যাদি ফেলে রেখে কাঁঠালবাড়িতে পশ্চাদপদসদরণ করে।
(চলবে)
No comments:
Post a Comment