পুনম বালা
তৃতীয় অধ্যায়
বাংলায় দেশিয় চিকিৎসা বিষয়ক নীতি
মধ্য যুগের শাসকেরা যেভাবে আয়ুর্বেদকে বৈজ্ঞানিক কর্মের সঙ্গে জুড়ে নেন, ব্রিটিশ ভারতেও উনবিংশ শতকে দেশজ চিকিৎসা ব্যবস্থা ঠিক একই ধরনের নীতি অনুসরণ করে। প্রত্যেক শাসকের শাসনকালে ভারতীয় চিকিৎসাবিদ্যা নতুন রূপ ধারণ করেছে।
দেশজ চিকিৎসাব্যবস্থা সংক্রান্ত ব্রিটশদের অনুসৃত নীতি সমূহকে আমরা তিন ভাগে ভাগ করতে পারি। প্রাথমিক স্তরটি চলে ১৮৬০ পর্যন্ত দুটি চিকিৎসা ব্যবস্থারই শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান চলছিল এবং পশ্চিমি চিকিৎসা ব্যবস্থা দেশজ চিকিৎসা ব্যবস্থাকে আত্মীকরণ করছিল। এটা সম্ভব হয়েছিল চিকিৎসা আর ফার্মাকোপিয়ার তাত্ত্বিক মিলের ফলে।
দ্বিতীয় স্তরে ব্রিটেনে চিকিতসা ব্যবস্থায় পেশাদারিত্ব এবং ওষুধ তৈরিতে স্ট্যান্ডার্ডাইজেশনের মাত্রা বাড়তে থাকায় দুটি চিকিৎসা ব্যবস্থায় দ্বন্দ্ব শুরু হয়। প্রথম দুটি অবস্থায় রাষ্ট্র অর্থনৈতিক কারণেই দুই ধরণের চিকিৎসা ব্যবস্থা প্রচার করার উদ্যম গ্রহন করে, বিশেষ করে দেশজ চিকিৎসা ব্যবস্থা প্রচারে উদ্যমী হয়। এর ফলে দুটি চিকিৎসা বিদ্যা বাধ্য হয় পরস্পরের সঙ্গে হাত মেলিয়ে চলতে।
উনবিংশ শতের শেষের দিকে তৃতীয় এবং শেষ স্তরে ইওরোপে রসায়ন শিল্প এবং চিকিৎসকেদের পেশাদারিত্বের বিকাশ ঘটতে থাকে। এই স্তরে পশ্চিমি চিকিৎসাবিদ্যা দেশজ চিকিতসাবিদ্যা থেকে বহুদূর সরে যেতে থাকে এবং পূর্বের তুলনায় পশ্চিমি চিকিৎসাবিদ্যা দেশজ চিকতসাবিদ্যার সামনে কালান্তক যমের মত হয়ে দাঁড়ায়। এই হুমকির সামনে পড়ে জাতিয়তাবাদী আন্দোলন দেশজ চিকিৎসা ব্যবস্থার বিকাশ আর প্রচারের ডাক দেয়।
নিচের লেখায় আমি দেখাতে চেষ্টা করব দেশজ চিকিৎসা সংক্রান্ত সংগঠনে দুটি চিকিৎসা ব্যবস্থা ভারতে বিজ্ঞান শিক্ষায় ইংরেজবাদীদের হস্তক্ষেপে ইংরেজিমাধ্যমে পড়াশোনা চালু হওয়ার আগে কিভাবে হাত ধরাধরি করে চলেছিল। তবুও দেশজ চিকিতসাবিদ্যায় উতসাহ থেকেই যায় পরের দিকেও। এটির দুটি রূপ দেখা যায়, প্রথমত দেশজ ওষুধ নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা এবং দ্বিতীয়ত দেশিয় মানুষের ত্রাণের কাজে দেশজ চিকিতসকেদের নিয়োগ করা।
দেশিয় চিকিৎসা শিক্ষাকেন্দ্রে চিকিৎসা শিক্ষা
উনবিংশ শতকের শুরুতে ব্রিটিশ চিকিতসকেরা দেশিয় চিকিতসা ব্যবস্থা নিয়ে গবেষণার উদ্যম নিয়েছিলেন। ১৮১৩ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কোর্ট অব ডায়রেক্টর্স জানান, আমাদের মনে হয়েছে (এই চিকিৎসা ব্যবস্থার) ভেষজ এবং ওষুধে ভাল কিছু রয়েছে এবং সেইগুলি আমাদের চিকিতসাব্যবস্থায় প্রয়োগ করা যায়, এবং সেই জ্ঞান চিকিতসকেদের পক্ষে উপযোগী হতে পারে। এই আদানপ্রদানে দেশের চিকিৎসাবিদ্যা এবং অন্যন্য বিজ্ঞান আধুনিক সুযোগসুবিধেগুলি গ্রহন করার উদ্যম দেখাবে১।
দেশজ চিকিৎসাবিদ্যায় গুরুত্ব নিয়ে এই প্রথম সরকারিভাবে উতসাহ দেখানো হল। আদতে এর পূর্বপ্রেক্ষা হল, ১৭৯০-১৮০০ সালে উইলিয়াম জোন্সএর স্মৃতিকথা বোটানিক্যাল অবজারভেশনস অন সিলেক্ট প্ল্যান্টস এবং ১৮১৩ সালে এইনসলির মেটিরিয়া মেডিকা ইন হিন্দোস্তান প্রকাশ।
দেশজ চিকিৎসা ব্যবস্থায় উতসাহের প্রমান পাওয়া গেল কলকাতা সংস্কৃত কলেজ এবং কলকাতা মাদ্রাসা তৈরির পর নেটিভ মেডিক্যাল ইন্সস্টিটিউশন(এখন থেকে এনএমআই) প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। এর ভিত্তপ্রস্তরটি স্থাপিত হল ১৮২২ সালের ৯ মে এবং সরকারি নির্দেশনামাটি প্রকাশিত হল ২১ জুন২। নির্দিষ্ট নীতিমালা এনএমআইএর জন্য তৈরি করার পরিকল্পনা হল। বেঙ্গল মেডিক্যাল বোর্ডকে এই কাজের বিশদ দায়িত্ব দেওয়া হল। ছাত্র ভর্তি এবং নির্দিষ্ট শিক্ষার প্রেক্ষিতে দেশজ চিকিতসকেদের কিভাবে এনএমআইতে নেওয়া হবে সেই নীতিমালার মূল সূত্রগুলি আমাদের জানা জরুরি। এনএমআইএর আরেকটি নাম হল স্কুল অব নেটিভ ডক্টরস, এবং এই ধরণের শিক্ষা কেন্দ্র ব্রিটিশ ভারতে প্রথম তৈরি হল।
শিক্ষার্থীদের সংখ্যা ২০তে বেঁধে রাখার সিদ্ধান্ত হল। এই শিক্ষালয়ে প্রবেশের জন্য হিন্দুস্তানি অথবা পার্সি ভাষা জানান বাধ্যতামূলক হল। পরিকল্পনার তৈরি সময় ধার্মিক বৈষম্য করা হয় নি, এর অর্থ হল এই শিক্ষা গ্রহনে জাতিগত বৈষম্যও করা হল না। পাঠগ্রহনের পরীক্ষায় সফল হওয়ার পর আর্থিক সাহায্য এবং চাকরির আশ্বাস দেওয়া হল। শিক্ষা গ্রহনের সময় বাতসরিক ৮টাকা জলপানি দেওয়ার প্রস্তাব ছিল। এনএমআই শিক্ষান্তে ছাত্রদের সেনাবাহিনিতে ভর্তির নির্দেশ জারি হল গভর্নরের নির্দেশে৪। প্রধান শিক্ষকদের পদমর্যাদা হল সিভিল এসিস্ট্যান্ট সার্জেন এবং তাকে সহায়তা করার নিয়োগের প্রস্তাব হল জন্য দুজন দেশিয় চিকিৎসকের। বহুজ্ঞানী প্রাচ্যবিদ ড জন টেইলর এনএমআইএর প্রধান(সুপারিনটেন্ডেন্ট) মনোনীত হলেন।
দেশিয় ভাষায় শিক্ষা দানের ব্যবস্থা করা হল। দেশিয় ছাত্রদের অসুবিধের কথা ভেবে মানবের শবদেহ নয়, পশুর শব নিয়ে কাটাছেঁড়ার ব্যবস্থা হল। শারীরবিদ্যা, ঔষধ বিদ্যা এবং শল্য চিকিৎসা নিয়ে একটি পাঠ্যক্রম তৈরি হল এবং শিক্ষার জন্য অনুবাদেরও ব্যবস্থা হল। এই পুস্তকগুলির মাধ্যমে ছাত্ররা বাংলায় এই প্রথম ইওরোপিয় চিকিতসাবিদ্যার মূল তত্ত্বগুলি সম্বন্ধে পরিচিত হল। হাতে কলমে কাজের জন্য পশুর দেহ ব্যবচ্ছেদ এবং হাসপাতালে মারা যাওয়া রোগীদের শবদেহের ময়না তদন্তের কার্যপ্রনালী অনুসরণ করত। মেডিক্যাল বোর্ডের নির্দেশে এবং সুপারিন্টেনডেন্টের দেখাশোনায় ছাত্রদের বিভিন্ন হাসতাপাল এবং কেন্দ্রে পাঠান হত। যারা ইওরোপিয় হাসপাতালে অতিরিক্ত শিক্ষা বা প্রশিক্ষণের জন্য যেত তাদের ওষুধ তৈরির দপ্তরে কাজে লাগানো হত, বিভিন্ন ওয়ার্ডে এবং ওষুধখানায় পাঠানো হত যাতে তারা বাঁধাছাঁদা আর ওষুধ তৈরিতে দক্ষ হতে পারে। আর যারা বাংলার নেটিভ হস্পিটালের সঙ্গে যুক্ত, হাসপাতালের কাজের জন্য পাঠালে তাদের মেডিক্যাল আধিকারিকদের অধীনে দেওয়া হত যাতে তারা হাসপাতালের কাজ করতে পারে।
এনএমআইকে আরও সংগঠিত করতে উদ্যমী হয় বাংলা সরকার। ১৮২৪ সালে সরকারি নির্দেশে ডাক্তারির সঙ্গে জোড়া শব্দসমূহগুলিকে নাগরি ও পার্সি ভাষায় রূপান্তরিত করে ছাপার ব্যবস্থা করা হল। মেসার্স বাথগেট এন্ড কোম্পানির থেকে ৭০৯টাকা দিয়ে দুটি কঙ্কাল কেনার নির্দেশ জারি হল ১০ জুন ১৮২৪ সালে। ১৮২৬ সালে কলকাতা সংস্কৃত কলেজে আর কলকাতা মাদ্রাসয় চিকিৎসাবিদ্যা শেখাবার প্রশিক্ষণ শুরু হয়। ঠিক হল কলকাতা সংস্কৃত কলেজে শেখানো হবে আয়ুর্বেদ এবং কলকাতা মাদ্রাসয় শেখানোর ব্যবস্থা হবে য়ুনানি। এই দুটি শিক্ষা কেন্দ্রই সুরকারি অনুদানে পোষিত৮। এনএমআইতে এই বছর ছাত্র সংখ্যা বাড়িয়ে ৫০ করার এবং ৪ জন সহকারী – দুজন হিন্দু, দুজন মুসলমান নিযুক্ত করার নির্দেশিকা জারি হয়। প্রত্যেক দেশি ডাক্তার তৈরিতে সরকারের খরচ পড়ত মোটামুটি ১০০০ টাকা।
(চলবে)
No comments:
Post a Comment