পুনম বালা
চিকিৎসা শিক্ষাবিষয়ক সমীক্ষা – এনএমআইএর বিলুপ্তি
এনএমআইএর কাজকর্ম নিয়ে কোর্ট অব ডায়রেক্টর্স ১৮২৮সালে প্রথম সমীক্ষা করে১৭। সমীক্ষায় চিকিৎসা শিক্ষার সন্তোষজনক অগ্রগতির শংসাপত্র দেওয়া হয়েছিল শিক্ষা কেন্দ্রটিকে। কিন্তু ১৮৩২ আর ১৮৩৩এর সমীক্ষায় এনএমআইএর শিক্ষা প্রদানের পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়।
এনএমআইএর শিক্ষা পদ্ধতির সমীক্ষার প্রস্তাব প্রথম দেয় কোর্ট অব ডায়রেক্টরদের কলমের খোঁচায় নিয়োজিত পলিটিক্যাল এন্ড মিলিটারি কমিটি। তাদের সংশ্লিষ্ট সমীক্ষা পত্র জমা দিতে বলা হল গভর্নর জেনারেল ইন কাউন্সিলকে। এই কমিটিকে ছাত্রদের ভর্তি, চিকিৎসা শিক্ষা, পরীক্ষা, এবং নিয়োগ ইত্যাদি এবং এর সঙ্গে সংগঠনের সংবিধান উন্নত করারও সিদ্ধান্ত গ্রহন করার অধিকার দেওয়া হয়। এনএমআই যে সব বই ব্যবহার করবে, কমিটি সেগুলি এবং মানব দেহের আলাদা আলাদা হাড় এবং কিছু মোমের মডেল কেনার অনুমতি দেয়। এনএমআই দেশিয় চিকিৎসক তৈরিতে পশ্চিমি এবং দেশিয় চিকিৎসাবিদ্যা পড়ানোর যে উদ্যোগ নিয়েছিল, কমিটি তাদের সেই উদ্যোগকে সরকার সমর্থন করল না। সমালোচকেদের মনে হল এনএমআইতে চিকিৎসা শিক্ষা অধপতিত হচ্ছে এবং কোথাও যেন বদ্ধ হয়ে পড়েছে। এই মতের সমর্থকেদের মধ্যে ছিলেন তখনকার সরকার প্রধান উইলিয়ম বেন্টিঙ্ক। এনএমআইএর সমর্থকেরা তার এই মতের বিরুদ্ধে আপত্তি প্রকাশ করেন। সেসময়ে প্রাচ্য-প্রাতিচ্য বিতর্কে এই ঘটনার ছাপ পাওয়া যায়(এ নিয়ে পরে আলোচনা করা যাবে)।
এনএমআইতে ১৮৩৩ সালে সংস্কারের নির্দেশ দিলেন বেন্টিঙ্ক। তিনি পাবলিক ইন্সট্রাকশন কমিটিকে নির্দেশ দিলেন শুরু সময় থেকে এনএমআইএর শিক্ষা ব্যবস্থার সমীক্ষা করে তার অগ্রগতির খতিয়ান ব্যক্ত করা এবং সেই সমীক্ষার আলোকে দেশিয়দের ইওরোপিয় শিল্প এবং বিজ্ঞান পড়ানোর পদ্ধতি কিভাবে নির্নয় করা যায় তা স্থির করা। ১৮৩৪ সালের ২০ নভেম্বর কমিটি সমীক্ষাপত্র প্রকাশ করল। এনএমআইএর জোরের জায়গা নির্দেশ করে ঘাটতিগুলো বিশেদে ব্যাখ্যা করল কমিটি। কমিটি বলল এনএমআই ঠিকভাবে গঠিত এবং পরিকল্পিত হয় নি। তাদের মতে এনএমআইএর শিক্ষাদান, প্রশিক্ষণ দেওয়া আর পরীক্ষা নেওয়ার সময় যথেষ্ট নয় এবং এখানে আনাটমি নিয়ে কোন হাতে কলমে কাজের সুযোগ নেই। শিক্ষালয়ের প্রায়োগিক শ্রেণী কক্ষে নিয়মশৃঙ্খলাহীবভাবে ছাত্রদের শিক্ষা নেওয়ার উপস্থিতি এবং পরীক্ষা উত্তোরণের সঠিক মানদণ্ড না থাকা এনএমআইএর দুর্বলতা রূপে চিহ্নিত হল।
১৮৩৫ সালে কমিটির সদস্যরা শিক্ষার বাহন হিসেবে ইংরেজি না দেশিয় ভাষায় হবে, এই মতবাদে দুভাগ হয়ে গেলেন। যারা দেশিয় ভাষায় শিক্ষা চাইলেন তাদের নাম হল ওরিয়েন্টালিস্ট বা প্রাচ্যবাদী এবং যারা ইংরেজিতে চাইলেন তাদের নাম হল এংলিসিস্ট বা ইংরেজিবাদী। ওরিয়েন্টালিস্টদের মধ্যে অন্যতমরা ছিলেন জন টিটলার, রাম কমল সেন, এইচ এইচ উইলসন, বিপক্ষে রইলেন বেন্টিঙ্ক, মেকলে, শল্য চিকিৎসক জন গ্রান্ট(কোম্পানির ওষুধখানার নির্দেশক)। বিতর্কে জয়ী হলেন এংলিসিস্টরা, বললেন, ইংরেজি ভাষার জ্ঞান প্রাথমিক শর্ত, কেননা এই ভাষার জোরে শিক্ষার্থী নিজেকে বিজ্ঞান এবং অগণিত ছাপার বইতে লেখা এবং ছবি দেখে শেখার সুযোগ পাবে যা প্রাচ্য ভাষা শিক্ষায় সম্ভব নয়, কেননা, সেখানে খুবই অপরিণত বিজ্ঞান বা বিজ্ঞানের নামে অযৌক্তিক বিষয় রয়েছে২২।
এর পাশাপাশি ইংরেজিবাদীরা বললেন পাঠয় হিসেবে শুধুই ইওরোপিয় বিজ্ঞান পড়ানো হবে। ১৮৩৫ সালে প্রাচ্যবাদীদের ওপরে ইংরেজিবাদিদের বিজয় ঘটল, বেন্টিঙ্ক এনএমআইএর বিলয়ের নির্দেশনামা স্বাক্ষর করলেন। ১৮৩৫ সালের ২৮ সংখ্যক নির্দেশনামায় ২৮ জানুয়ারি এনএমআইএর মৃত্যু পরোয়ানা জারি হল। এই পরোয়ানা সূত্রের গৃহীত প্রস্তাবক্রমে বলা হল, পয়লা তারিখ(ফার্স্ট প্রক্সিমো) থেকেই সংস্কৃত কলেজের চিকিৎসা শিক্ষা, মাদ্রাসার চিকিৎসা শিক্ষা এবং এনএমআইকে বন্ধ করতে হবে, এনএমআইএর যে সব শিক্ষার্থীরা পরীক্ষার জন্য তৈরি তারা দেশিয় ডাক্তার হিসেবে চাকরি পাবে, এবং অন্যান্য শিক্ষার্থীরা বর্তমান বেতন কাঠামোয় সেনাবাহিনীতে নিযুক্ত হবে যদি তারা সঠিক গুণমানের চিকিতসকেদের নিয়ে তৈরি কমিটির অনুমোদন পায়, এবং তারা যদি দুবছরের মধ্যে সফল হতে না পারে তাহলে তাদের ছাঁটাই করা হবে।
এই সিদ্ধান্ত ক্রমে এনএমআই তুলে দেওয়া হল, সংস্কৃত এবং মাদ্রাসা কলেজের চিকিৎসা শ্রেণী বন্ধ করে দেওয়া হল, এবং নতুন একটি চিকিৎসা শিক্ষা কেন্দ্র ক্যালকাটা মেডিক্যাল কলেজ স্থাপিত হল। এনএমআই বন্ধ হয়ে যাওয়ার অর্থ নয় যে ভারতীয় ভাষায় চিকিৎসা শিক্ষা বন্ধ হয়ে গেল। দেশিয় চিকিৎসাবিদ্যা বাদ দিয়ে দেশিয় প্রথমে উর্দু এবং পরে বাংলায় ভাষায় চিকিৎসাবিদ্যার পঠনপাঠন শুরু হল ১৮৩৯ সালে। এনএমআইএর মাত্র একজন সদস্য পশ্চিমি চিকিৎসাবিদ্যায় শিক্ষিত আয়ুর্বেদিয় চিকিৎসক মধুসূদন গুপ্তই নতুন চিকিতসাপাঠদানকেন্দ্রে স্থান পেলেন২৫।
(চলবে)
No comments:
Post a Comment