পুনম বালা
বাবরের সময়ের জনৈক চিকিৎসক, হাকিম য়ুসুফ বিন মহম্মদ, আয়ুর্বেদ আর য়ুনানির মূল কাঠামো সংহত করে একটি চিকিৎসা শাস্ত্র প্রণয়ন করেন। তিনি আয়ুর্বেদ আর য়ুনানি দুটিরই স্বাস্থ্যবিধি, রোগ নির্নয় পদ্ধতি এবং চিকিৎসাকর্মরমত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি সংগ্রহ করেন। বাবরের সেনাবাহিনীতে বহু দক্ষ চিকিৎসক এবং শল্য চিকিৎসক ছিলেন।
হুমায়ুনের দরকারের দার্শনিক-চিকিতসক, মৌলানা মহম্মদ ফজল প্রণীত করেন পার্ল অব সায়েন্স – ১২টি বিভিন্ন জ্ঞানের একটি রত্নপেটিকা, এর মধ্যে চিকিৎসা শাস্ত্রও রয়েছে। তার পুত্র আকবর সংহিতাকর্মে জ্ঞানীদের উতসাহিত করতেন। তার রাজত্বকাল বিজ্ঞান, সাহিত্য এবং সামাজিক বিষয়ে বিকাশেরে জন্য চিহ্নিত হয়ে থাকবে। তিনি চিকিৎসাশাস্ত্রের বিকাশে অনুবাদকর্মকে এতই গুরুত্ব দিতেন, যে তার রাজত্বে তিনি কটি অনুবাদ এবং সংহিতাকর্ম বিভাগই খুলে দেন। এটা স্বাভাবিক যে রাজা/সম্রাট যদি উতসাহিত হন তাহলে তার সময়ে বিপুল কাজের সুযোগ তৈরি হয়ে যায়। সেই সময়ে ফাওয়াইদ অল ইনসান নামক একটি সংহিতা তৈরি হয়। এটিতে ভারত আর ইরানের খাদ্যাভ্যাস, ওষুধ ব্যবহার এবং চিকিতসায় তার প্রভাব নির্নয় করা হয়। মুঘল সাম্রাজ্যে তা বলে আয়ুর্বেদিয় চিকিৎসাব্যবস্থা কিন্তু উপেক্ষিত হয় নি৭৯। পারসিক চিকিসক৭৯ ছাড়াও আকবর হিন্দু চিকিৎসকও৮০ নিয়োগ করেছিলেন। আকবরের সময়ের আরেকটি চিকিতসা সংক্রান্ত পুঁথি তাবাকত-ই-আকবরিতে দরবারের বেশ কিছু হিন্দু চিকিৎসকের নাম উল্লেখ করেছে। তারা আকবরের সময়ে খাজঞ্চিখানা থেকে সরাসরি মাইনে পেতেন। আমরা দেখলাম আকবরের রাজত্বে য়ুনানি এবং আয়ুর্বেদ সব থেকে বেশি পৃষ্ঠপোষকতা পায়।
জাহাঙ্গীরের সময়ে হাকিম রুহুল্লা আয়ুর্বেদে স্বাস্থ্যবিধি নিয়ে একটি অনুবাদ কর্ম করেন, এছাড়াও তিনি দুধরণের চিকিৎসা ব্যবস্থায় চিকিৎসকেরা কি ধরণের পদ্ধতি এবং রীতিনীতি অনুসরণ করেন সে বিষয় নিয়েও পুস্তক রচনা করেন। জাহাঙ্গীর চিকিৎসা শাস্ত্রে এতই পটু ছিলেন যে নিজে সফলভাবে রোগের দাওয়াই নিদান দিতে পারতেন৮৩।
জাগগি বলছেন, জাহাঙ্গীরের পরে শাহজাহানের সময় মধ্যযুগে ভারতীয় চিকিৎসাবিদ্যা উন্নতির চরম শৃঙ্গে আরোহন করে। সারা দেশ জুড়ে তিনি হাসপাতাল তৈরি করান। জনৈক শল্য চিকিৎসক, মাসিউজ্জামানহাকিম নুরুদ্দিন মহম্মদ আবদাল্লা, আকবর, জাহাঙ্গীর আর শাহজাহানের সময়ে য়ুনানি এবং ভারতীয় শল্য চিকিৎসা এবং চিকিতসকেদের নিয়ে নানান পুঁথির সংহিতা প্রণয়ণ করেন। শাহজাহান দিল্লিতে একটি বড় হাসপাতাল তৈরি করেন, যেখানে বিনা মূল্যে চিকিৎসা করা হত। জাহাঙ্গীরের পুত্র আমানুল্লা খান বা হাকিম নুর আল বিন মহম্মদের মত কিছু চিকিৎসক খ্যাতির চরম শিখরে ওঠেন। আকবর শাহজাহানের সময় সম্রাট এবং অভিজাতদের নানান পুস্তকে দরবারি চিকিতসকেদের সঙ্খ্যার যে সব বর্ণনা পাওয়া যাচ্ছে সেগুলি হল, আকবরের সময় পার্সি চিকিৎসক ছিল ১৪, ভারতীয় ১২, অন্যান্য ১৩ মোট ৩৯, শাহজাহানের সময় এই সংখ্যাটি ছিল যথ্যাক্রমে ৭, ৩, ১, মোট ১১।
এরপরে চিকিতসকেদের পৃষ্ঠপোষণা ক্রমাগত কমেছে। তবে আমরা এটা স্পষ্ট জানি যে মুঘল রাজত্বে চিকিৎসা এবং আরোগ্য কেন্দ্র তৈরি করার উতসাহ দেওয়া হত এবং সেখানে অসুস্থদের সুস্থ করে তোলা হত। এটাও হতে পারে সম্রাটেরা বুঝতে পারলেন চিকিতসকেদের বেশি দরবারে না রেখে বিভিন্ন সংগঠনে তাদের চিকিৎসা করতে দেওয়া উচিত যাতে সাধারণ মানুষ উপকৃত হতে পারে। পরের দিকে আমরা দেখেছি এই কেন্দ্রগুলি, চিকিতসক আর অন্যান্য কর্মীর জন্য বিশেষ অর্থ সাহায্য হত।
আওরংজেবের সময়ে য়ুনানি চিকিৎসাবিদ্যায় বিপুল সংখ্যক প্রকাশনা হয়েছে। এই সময়টা য়ুনানি চিকিৎসা বিদ্যার জন্য খুব অনুগ্রাহী ছিল। তবে আয়ুর্বেদকে তিনি যে বর্জন করে নির্বাসনে দিয়েছিলেন, এমন কোন নিদর্শন পাওয়া যায় না। এধরণের পদক্ষেপ নিলে কোন না কোন চিহ্ন থেকেই যেতই এবং তার সিংহাসনে বসার সময়ে আমরা দেখেছি, দুটি চিকিতসা ব্যবস্থাই মুঘল রাজত্বে একইভাবে বিকশিত হয়ে এসেছে। আওরঙ্গজেব মফস্বল, ছোট শহর এবং এমন কি গ্রামেও চিকিৎসা কেন্দ্র(হাসপাতাল) তৈরি করে ছিলেন। নবাব খায়ের আন্দেশ খান, প্রখ্যাত লেখক-চিকিৎসক, এমন একটা চিকিৎসাকেন্দ্র তৈরি করেছিলেন, যেখানে হাকিম এবং বৈদ্যরা চিকিৎসা করতেন একসঙ্গে এবং রোগীদের বিনামূল্যে ওষুধ দেওয়া হত।
এটাও পরিষ্কার যে স্থানীয় মুসলমান শাসকেরাও হাকিম এবং বৈদ্যদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। মুঘল সম্রাটেরা চিকিৎসা কেন্দ্র স্থাপনের জন্য “আকুয়াফ” নামক বিশেষ অনুদান বরাদ্দ করতেন, যে বরাদ্দ কেন্দ্র, তার চিকিৎসক এবং কর্মচারীর জন্য ব্যয় হত। মাদ্রাসাগুলি যাতে ঠিকমত চলে, তার জন্য মুঘল সাম্রাজ্য বিপুল বরাদ্দ করেছিল। য়ুনানি শিক্ষাকেন্দ্র সম্পর্কে রাজকীয় বরাদ্দের যথেষ্ট প্রমান পাওয়া যাচ্ছে, যদিও আয়ুর্বেদিয় শিক্ষা কেন্দ্র সম্বন্ধে এ ধরণের উদাহরণ পাওয়া যাচ্ছে না, তবুও মনে হয় সেই পরিমানটা খুব নগণ্য ছিল না।
মহম্মদ তুঘলকের সময় তাকে প্রতিস্পর্ধা দেওয়া দাক্ষিণাত্যের বাহমনি রাজারা জনগনের জন্য স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল, যদিও তার কোন বিশদ বিবরণ পাওয়া যায় না।
(চলবে)
No comments:
Post a Comment