পুনম বালা
হয়ত কয়েকটি মহামারী আর মন্বন্তরের পর বাংলার গ্রামীনদের স্বাস্থ্যের অবস্থা অবনতি ঘটে এবংসে সময় গ্রামীন এলাকায় নানান রোগের প্রকোপে তাদের জীবনের আশংকা বেড়ে চলছিল। স্থানীয় চিকিতসকেদের নিয়ে একটি দল তৈরি করে প্রত্যন্ত গ্রামে গরীব মানুষদের সফলভাবে চিকিৎসা সেবার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার কথা চিন্তা করেছিল। কিন্তু কিভাবে এই বিষয়টি বাস্তিবায়িত কতা হয়েছিল, তা আজানাই থেকে গিয়েছে।
১৮৬৯ সালে বাংলার এক সিভিল সার্জেন ভোলানাথ বোস পিড়ীত রোগীদের দাবি পূরণ করতে একটি পরিকল্পনা পেশ করেন। তিনি প্রত্যেক জেলায় একটি অস্থায়ী চিকিৎসবিদ্যা শিক্ষার বিদ্যালয় এবং তার সঙ্গে জুড়ে একটি হাসপাতাল খোলার প্রস্তাব দেন। প্রত্যেক বিদ্যালয়ে নেতৃত্ব দেবেন সাব-এসিস্ট্যান্ট সারজেন এবং তার সহকারী থাকবেন একজন দেশিয় চিকিৎসক, এছাড়াও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কর্মীও থাকবেন। শিক্ষার্থীদের উতসাহ দিতে জলপানি এবং বিনামূল্যে বই দেওয়া হবে। এই প্রকল্পে সারা বছর ধরে প্রশিক্ষণ এবং হাতে কলমে কাজের সুযোগও ছিল। তার পরে সফল শিক্ষার্থীদের পঞ্জীকরণ করে গ্রামে চিকতসা করার অনুমতি দেওয়া হবে।
বাংলার তৎকালীন স্যানিটারি কমিশনার ড ডি বি স্মিথ ভোলানাথ বোসের এই প্রকল্প রূপায়িত করতে অস্বীকার করেন। তার মতে সাব-এসিস্ট্যান্ট সার্জেন আর দেশিয় চিকিৎসকের থেকে শিক্ষা নিয়ে কোন যুবক শিক্ষার্থীর এক বছরের দেশজ চিকিৎসক হয়ে ওঠার পরিকল্পনা অবাস্তব। তার ভয় হল, সেই সময়ের বাংলার গ্রাম জুড়ে জর, পেটখারাপ, কলেরার মত জটিল রোগের প্রাদুর্ভাব হচ্ছিল, সেসব রোগ সারানো সেই শিক্ষার্থীদের পক্ষে সম্ভব হত না। আর অত কম সময়ে শিক্ষা নিয়ে চিকিৎসক হয়ে ওঠার যোগ্যতা অর্জন করার পরিকল্পনা স্মিথের পছন্দ হয় নি।
বোস শিক্ষার্থীদের ভাউন্ত, ইন্দ্রজবের মত পেটখারাপ, কলেরা ইত্যাদি সারানোর জন্য প্রয়োগের উদ্দেশ্য জানা ভেষজ সম্বন্ধে সচেতন করতে চেয়েছিলেন। প্রত্যেক জেলায় এই একটা বিদ্যালয় চালানোর খরচ ধরা হয়েছিল মাসে ১০০০টাকা। এই টাকা যদিও প্রাথমিকভাবে সরকারের খাজাঞ্চিখানা দিলেও পরে স্থানীয় জমিদার এবং অন্যান্য স্বচ্ছল শ্রেণীর ওপর ছোট আকারের সেস বসিয়ে সে খরচ তুলে নেওয়ার প্রস্তাব দেন। এছাড়াও প্রত্যেক প্রশিক্ষিত চিকিতসকেদের থেকে পঞ্জীকরণ শুল্কও নেওয়ার প্রস্তাব ছিল। প্রাথমিকভাবে তারা পাউন্ড কিপার(পশু রক্ষক/চিকিৎসক), টিকাকার এবং স্থানীয় স্যানিটারি অফিসার হিসেবে কাজ করবে এবং পরে তাদের গ্রামে তারা চিকিৎসা করার অনুমতি পাবে। পাঠ্য হিসেবে বিভিন্ন ধরণের বই দেশজ ভাষায় অনুবাদের পরিকল্পনা করলেন বসু।
স্মিথের সমস্যা ছিল যে ভোলানাথ বোস চিকিৎসার জন্য সম্পূর্ণভাবে দেশজ ভেষজ আর ওষুধের ওপর নির্ভর করেছিলেন। স্মিথ বিশ্বাস করতেন সরকারের উচিত দেশজ চিকিৎসা ব্যবস্থার বাইরের অন্যান্য চিকিৎসা ব্যবস্থা এবং যেসব উন্নতমানের চিকিৎসা ব্যবস্থা বর্তমান রয়েছে সেগুলির উন্নতির চেষ্টা করা। তার মতে এই পরিকল্পনা যদি সফল হয় তাহলে সরকার নিয়ন্ত্রিত ও পোষিত যে শিক্ষা ব্যবস্থা এদেশে চালু আছে তার প্রতি মানুষের অনাস্থা দেখানো হবে৮৫।
স্মিথের মনে হয়েছিল ভোলানাথ বোসের পরিকল্পনার সব থেকে বড় ঘাটিতি ছিল প্রশিক্ষিত চিকিতসকেদের পাউন্ড কিপার(পশু রক্ষক/চিকিৎসক), টিকাকার এবং স্থানীয় স্যানিটারি অফিসারের মত নিম্নশ্রেণীর পদে কাজ করানোর পরিকল্পনা। যুবা সরকার পোষিত চিকিৎসকদের শুধু সরকারের কর আর শুল্ক আদায়কারিতে রূপান্তরিত করা ঠিক হবে না। সামগ্রিকভাবে স্মিথ মনে করলেন ভোলানাথ বোসের এই পরিকল্পনাটা অকার্যকর হবে।
তবে স্মিথের মনে হয়েছিল, দেশজ ভেষজ খুবই গুরুইত্বপূর্ণ বিষয়, এগুলি কলকাতায় দীর্ঘদিন ধরে চিকিতসা কাজে নিযুক্ত থাকা অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কবিরাজদের প্রয়োগ করলে কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যাবে। তিনি মনে করতেন হাতে গোণা দেশিয় চিকিতসকেদের জেলার সরকারি ছোট হাসপাতালগুলিতে রোগীদের চিকিৎসা করার সুযোগ দিলে জেলার স্বাস্থ্য ব্যবস্থ্যা উন্নত হবে। এই সুযোগে তারা তাদের জ্ঞানভাণ্ডার উন্মুক্ত করতে পারবেন। ব্রিটিশ চিকিৎসকেরা তাদের থেকে দেশজ ভেষজ বিষয়ে যথোপযুক্ত জ্ঞানও আহরণ করতে পারবেন। এছাড়াও ক্যালকাটা মেডিক্যাল কলেজে যদি শিক্ষার্থীদের তাদের জ্ঞান উজাড় করে দিতে পারেন, তাহলে সেটাও ভাল কাজ হতে পারে। জেলায় জেলায় উচ্চশিক্ষার(কলেজ) কেন্দ্রগুলিতে জেলা মেডিক্যাল স্কুল খোলার প্রস্তাব দিলেন তিনি, যাতে ব্রিটিশ প্রমিত ওষুধগুলি নির্দিষ্ট হারে জেলায় জেলায় পৌঁছে যেতে পারে।
মার্সার, বোস বা স্মিথ, কারোর কোন প্রস্তাবই বাংলার লেফটানেন্ট জেনারেলের অনুমোদন মিলল না। প্রত্যেকটার পিছিনে থাকা নীতিগুলির গুরুত্ব অস্বীকার না করেই তার মাথায় এল যে জেলায় জেলায় সিভিল সার্জেনের তত্বাবধানে প্রত্যেক জেলায় ৫ জন শিক্ষার্থীকে পাঠিয়ে সাধারণ ওষুধ এবং চিকিৎসার মূল সূত্র সম্বন্ধে যদি জানানো যায়। কোন সরকারি চিকিৎসালয়ে তাদের বছরে বছরে বেড়ে চলা অঙ্কের জলপানি নির্ভর করে তিন বছর ধরে পড়ানো হবে, সেই সময় তারা সেখানে বা সিভিল এবং জেল হাসপাতাল এবং ডিস্পেনসারিতে ড্রেসার, হাসপাতাল শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজ করবে। তৃতীয় বছরের শেষে তারা তাদের গ্রামে চিকিৎসা করার অনুমতি পাবে। পড়ানোর সময়ের অবধির পার্থক্য ছাড়া বোসের পরিকল্পনার সঙ্গে লেফটানেন্ট পরিকল্পনার মিল অদ্ভুত। এছাড়াও লেফটানেন্ট গভর্নর স্মিথের প্রস্তাবের একাংশ অনুমোদন করে, জেলায় জেলায় পশ্চিমি ওষুধ যেমন কুইনাইন, জেমস পাউডার, ডোভার্স পাউডার ইত্যাদি দামে দামে পাঠাবার অনুমতি দিলেন।
(চলবে)
No comments:
Post a Comment