পুনম বালা
আয়ুর্বেদ চিকিতসার দর্শনের সঙ্গে প্রাচীন ভারতের ধার্মিক দর্শনের বিন্দুমাত্র মিল ছিল না। আয়ুর্বেদিয় চিকিৎসকেরা তাদের প্রায়োগিক দর্শনে অনেক বেশি বস্তুগত দর্শনের কাছাকাছি ছিলেন। এর নাম লোকায়ত দর্শন, যার পিতৃপুরুষ চার্বাক। চার্বাক এবং বস্তগত দর্শনের অনুগামীরা বেদ বিরোধী। তারা পুনর্জন্ম তত্ত্বে অবিশ্বাসী কিন্তু পঞ্চভূত ক্ষিতি অপ তেজ মরুত ব্যোম দিয়ে যে শরীরের গঠন সেটা স্বীকার করে। যেহেতু ব্রাহ্মণদের সঙ্গে বস্তুবাদের তাত্ত্বিক বিরোধ লাগল, ফলে চার্বাকীয় বস্তিবাদী দর্শনের খুব বেশি বিকাশ ঘটল না। আয়ুর্বেদে শরীরের সঙ্গে পরিবেশ-প্রকৃতির যে অদ্বৈততার কথা বলা হয়েছে, তার সঙ্গে বস্তুবাদী দর্শনের মিল রয়েছে। কিন্তু বস্তুবাদী দর্শনে যা বলা হয়েছে আয়ুর্বেদ তার থেকে অনেকটা এগিয়ে গিয়েছে। ঘটনা নিরীক্ষণ এবং বিচার করা আর গবেষণামূলক তথ্যে যুক্তিবুদ্ধির বিচার করে সিদ্ধান্তে আসা ভারতীয় চিকিৎসা শাস্ত্রের খুব গুরুত্বপূর্ণ দুটি স্তম্ভ। এই দর্শনে অচিকিতসাযোগ্য রোগের কারণ হিসেবে পূর্বজন্মের কর্মফলের প্রভাবের বিষয়টি অন্তত আয়ুর্বেদ মানে না বোঝা গেল।
চিকিৎসকেরা ধার্মতাত্ত্বিকদের রোষের শিকার হলেন। চিকিতসা অভিজাতদের পক্ষে খুব নিম্নশ্রেণীর পেশা হিসেবে চিহ্নিত হল। বৌধায়নের সূত্র অনুসারে চিকিৎসকেরা হলেন আর্যসম্ভূত একটি নিম্নশ্রেণীর জাতি, যাদের নাম অম্বষ্ঠ। বাংলায় অম্বষ্ঠদের উদ্ভবের বিষয়ে বিতর্ক রয়েছে। রিজলে বলছেন এই শব্দটির সঙ্গে বৈদ্য শব্দের যোগ রয়েছে। তবে মনু সংহিতায় বৈদ্য নামী পেশা বা জাতির উল্লেখ নেই। তবে বলা হয় ব্রাহ্মণ পুরুষ আর বৈশ্য কন্যার মিলনে উদ্ভুত সন্তানকে অম্বষ্ঠ বলা হয়েছে। বাংলায় মনু কথিত অম্বষ্ঠরা প্রাচীন কাল থেকেই চিকিতসাকে পেশা হিসেবে নিয়েছেন।
পরের দিকের বৈদিক সাহিত্য যেমন যজুর্বেদ আর ব্রাহ্মণে এই প্রথম সরাসরি প্রাচীন চিকিৎসকেদের সঙ্গে পুরোহিতদের বিবাদের উল্লেখ দেখতে পাই৪৭। কৃষ্ণ এবং শুক্ল যজুর্বেদের মধ্যে কৃষ্ণতে চিকিতসকেদের জাত নষ্ট হওয়ার বিশদ বর্ণনা রয়েছে। কৃষ্ণ যজু অনুগামী তৈত্তরীয় সংহিতায় সরাসরি চিকিৎশাস্ত্রীদের প্রতি নতুন করে পুরোহিতদের মনোভাব স্পষ্ট করে বলা হয়েছে। শতপথ ব্রাহ্মণে সাধারণ মানুষের সঙ্গে একাত্মতার জন্য দুজন চিকিতসক অশ্বিন দেবের জাত খোয়ানো হয়েছে। কৃষ্ণ যজুর্বেদের অনুগামী মৈত্রয়ানী সংহিতা, কথক সংহিতা, এবং কপিস্থল সংহিতাতেও অশ্বিন দেবদ্বয়ের এই জাত খোয়ানোর বিষয়টি সমর্থন করা হয়েছে দুটি কারণে, ১) যেহেতু তারা চিকিতসক, ২)তাদের সমাজে সাধারণ মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করতে হয়৪৮।
গোঁড়া ব্রাহ্মনীয় শাস্ত্রীয় নিদানের বিরুদ্ধে গেলেন একমাত্র চিকিতসকেরাই, প্রত্যক্ষ দর্শনের ফলে উতপত্তি হওয়া জ্ঞানভাণ্ডারের জোরে তারা গোঁড়া রক্ষণশীলদের বিরুদ্ধে দাঁড়ালেন, কেননা তাদের শিক্ষায় গোঁড়ামির পাশে থাকা কার্যন্ত অসম্ভব ছিল৪৯।
চিকিৎসআ অতিন্দ্রিয় পদ্ধতিতে হয় এমত ধারণা ছড়িয়েছে ব্রাহ্মণেরা। জাগতিকভাবে তৈরি ওষুধ দিয়ে চিকিৎসকেদের রোগ সারানোয় শাসক গোষ্ঠী অসন্তুষ্ট হতে থাকল। প্রাচীনকালে তাই পুরোহিতেরা বৈদ্যদের বিরুদ্ধেই গেলেন। তারা এমন একটা অবস্থা তৈরি করলেন যাতে চিকিৎসকেরা সামাজিকভাবে পিরামিডে ক্ষমতাবান হয়ে না ওঠে এবং তাদের গোঁড়ামিকে প্রশ্ন করতে পারে। এই জন্য ব্রাহ্মণেরা দূষণ এবং বিশুদ্ধতার দোহাই দিলেন এবং সামাজিক পিরামিডে ওপরের দিকে থাকা চিকিৎসকেদের সামাজিকভাবে নিচু করে দিলেন যাতে তারা মাঠেঘাটে গবেষণা করতে না পারেন।
ব্রাহ্মণদের দাবি ছিল আয়ুর্বেদের ঐশ্বরিক উদ্ভবের। ব্রাহ্মণেরা যে প্রায়োগিক বাস্তবধর্মী চিকিতসাকর্ম অপছন্দ করতেন তার প্রচুর উদাহরণ প্রাচীন ভারতে পাওয়া যাবে। এর বড় কারণ হল চিকিৎসকেরা প্রায়োগিক জ্ঞানের অনুবর্তী হয়ে গোঁড়া ধর্মীয় তত্ত্ব বাতিল ঘোষণা করছিলেন।
বৈদ্যদের বিরুদ্ধে আড় হয়ে দাঁড়ানোর প্রক্রিয়া আইনি লড়াইতে পর্যবসিত হল। খ্রিপূ ষষ্ঠ শতে এর উদাহরণ পাওয়া যায়৫০ অপস্তম্ব, গৌতম এবং বশিষ্ঠদের স্মৃতি শাস্ত্রতে। খ্রিষ্টিয় শত থেকে মনু পর্যন্ত সময়ে স্মৃতিশাস্ত্রগুলি কিন্তু চিকিতসকেদের ওপরে খড়গহস্ত। ফলে রক্ষণশীলরা চিকিতসকেদের অপবিত্র দাগিয়েদিলেন, তারা এতই অপবিত্র যে কোন স্থানে তাদের উপস্থিতি ঐ স্থানকে অপবিত্র করে তোলে, তারা যে খাদ্য পরিবেশন করে সেগুলি এতই নোংরা যে তা গ্রহন করা যায় না, এবং তাদের যে খাওয়ার দেওয়া হয় তাও বিষে রূপান্তরিত হয়৫১।
গৌতমের স্মৃতিশাস্ত্রের নিদান হল একজন ব্রাহ্মণ শ্রমিক, শল্য চিকিতসক এবং দুষ্কৃতির হাত থেকে খাদ্য নাও নিতে পারেন। মনুর সময়ের কাছাকাছি প্রাচীন আইন শাস্ত্র ধর্মশাস্ত্র, যা পরে স্মৃতিশাস্ত্রে রূপান্তরিত হয়েছিল, সাধারণভাবে হাতে কলমে কাজ করা শ্রমিক, চিকিতসকের উপস্থিতি বলি দেওয়ার মত পুতপবিত্র স্থানকে অপবিত্র করার জন্য যথেষ্ট, তাই তাদের সেই স্থানে প্রবেশের অধিকার ছিল না। তবে চট্টোপাধ্যায় ধর্মশাস্ত্রকে স্মৃতিরূপে স্বীকার করেন না কেননা, সেটি ধার্মিক দোহাই দিয়ে মানুষের সামাজিক অবস্থান নির্নয় করে, আইন বলে নয়। উইন্টারনিতজ বলছেন এগুলি ব্রাহ্মণ এবং পুরোহিতদের ধর্মীয় রচনা, এর সঙ্গে আইনি বাস্তবতার কোন সম্পর্ক নেই৫৩।
অন্যদিকে ধর্মীয় গোঁড়ামির চিকিতসকেদের চিকিতসার প্রতি সরাসরি আঘাতের বিরুদ্ধে প্রাচীন ভারতে দেশজ চিন্তাধারা চিকিতসকেদের ওপর আঘাতের বিরুদ্ধে বর্ম হয়ে দাঁড়ায়। খ্রিপূ ষষ্ঠ শতের ভারতে ব্রাহ্মণেরা সমাজে নিয়ন্ত্রন কায়েম করে। এই সময়ের ভারতে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্ম বিকাশ লাভ করে। বৌদ্ধধর্ম গ্রামীন শূদ্র সমাজে বিস্তৃত হয়। বৌদ্ধ ধর্মের বিস্তৃতি ব্রাহ্মণ্য ধর্মের ক্ষমতায় আঘাত করতে থাকে, বিশেষ করে তারা বেদ এবং স্মৃতিকারদের ক্ষমতাকেই প্রশ্ন করতে থাকে। এগুলি ব্রাহ্মণেরা ভালভাবে নিচ্ছিল না। যদিও পরে দিকে বুদ্ধ অবতার গণ্য হলেন কিন্তু সেই পথ খুব স্বচ্ছল ছিল না।
বুদ্ধের সময়ে নানান পেশার মধ্যে চিকিৎসকেরা খুব গুরুত্ব অর্জন করলেন। বিভিন্ন বৌদ্ধ শাস্ত্রে পরম শ্রদ্ধায় জীবকের নামাচ্চোরণ এই তত্ত্ব প্রমান করে। বৌদ্ধিক নীতিশাস্ত্র বিনিয়পিটকে চিকিৎসাশাস্ত্রের প্রতি বুদ্ধদেবের ব্যক্তিগত আসক্তির কথা জানা যায়। মহাভগগতে বিভিন্ন রকমের চিকিৎসার কথা বলা হয়েছে, যা আদতে সেই সময়ের চিকিৎসাবিদ্যার ইতিহাসও বটে। এটি রোগ নিরাময়ে কর্মফলের প্রভাবকে নস্যাত করে বলে রোগীর সুস্থ হওয়া নির্ভর করছে চিকিতসক, সেবাদাত্রী এবং রোগীর নিজের ওপরেও। এই জন্য প্রখ্যাত বৌদ্ধ চিকিতসাবিদ্যালয় তক্ষশীলাকে ব্রাহ্মণেরা অপবিত্র দাগিয়ে দেয়।
এই সময় বৌদ্ধমঠভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থা চালু হয়। এবারে চিকিৎসা ব্যবস্থা ঐন্দ্রজালিকতা থেকে যুক্তিবুদ্ধিভিত্তিক চিকিৎসা ব্যবস্থায় রূপান্তরিত হয়। তার জন্য প্রয়োজন হয় প্রায়োগিক চিকিৎসা প্রদর্শন শিক্ষা। চিকিৎসক হতে গেলে চিকিৎসা শিক্ষা প্রয়োজনীয় হয়ে গেল এবার থেকে। সাত বছর ধরে শিক্ষার্থীদের শিক্ষার পাঠ্যক্রম চালু হল। বলা হয় জীবন মগধের রাজ চিকিৎসক হতে পেরেছিলেন কেননা তিনি এই কটা বছর সফলভাবে পড়াশোনা এবং রোগের চিকিৎসা করেছিলেন৬০।
মঠে পড়ানোর ব্যবস্থা ব্রাহ্মণ্যবাদ বিরোধিতা করে। ব্রাহ্মণ্যবাদী পড়াশোনায় উপনয়ন একতা বড় অংশ ছিল, এছাড়াও ধর্মীয় সূত্রগুলি মুখস্থ করতে হত। যেহেতু ব্রাহ্মণেরা চিকিৎসাশাস্ত্র এবং ধর্মশাস্ত্র দখল করেছিল, চিকিতসাবিদ্যার পুঁথিগত জ্ঞান ধর্মীয় শিক্ষার অঙ্গীভূত হয়ে গেল। পুরোহিতদের বাড়িই শিক্ষাকেন্দ্র হয়ে উঠল।
(চলবে)
No comments:
Post a Comment