Wednesday, February 1, 2017

বাংলা যখন বিশ্ব সেরা৭১ - লাইফ অব মীর জুমলা, জেনারেল অব আওরঙ্গজেব


জগদীশ নারায়ণ সরকার
২। মীর জুমলার যুদ্ধ প্রস্তুতি
আওরঙ্গজেবের জয় এবং ঢাকায় মুঘলদের যুদ্ধ প্রস্তিতির সংবাদে কোচ আর অহোম রাজারা মুঘলদের সঙ্গে শান্তি চুক্তি করার জন্য প্রস্তাব পাঠায়। অহোম রাজা জয়রাজ শান্তির অনুরোধ জানিয়ে বললেন, তিনি কামরূপ জয় করেছেন কোচদের হাত থেকে উদ্ধার করার জন্য, এখন সেটি মুঘলদের হাতে তুলে দিতে চান। এই প্রস্তাবে মীর জুমলা অহোম রাজ্যকে দখল নিতে রশিদ খানকে পাঠালেন এবং বর্ষার আগে আরাকানে সুজাকে দখল নেওয়ার পরিকল্পনা করলেন। কিন্তু তিনি কোচ করদ রাজ্যের রাজা প্রাণনারায়নকে ছাড় দিতে রাজি হলেন না, রাজা সুজা সিংএর নেতৃত্বে বাহিনী পাঠালেন। তাকে সাহায্য করার জন্য তার পিছন পিছন মীর্জা বেগ সুজায়ীকে। প্রাণনারায়ন দূতের হাত দিয়ে পাঠানো চিঠ সেনানায়ক না পড়েই তাকে কয়েদ করা হয়।
অহোম আর কোচদের শান্তি প্রস্তাব আদতে সময় নেওয়ার ছল, যাতে তারা পাল্টা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে পারে। সুসজ্জিত অহোমদের বিরুদ্ধে এগোতে সাহস না পেয়ে রশিদ খান রাঙামাটিতে শিবির ফেললেন। ওদিকে সুজন সিংহ কোচেদের বিরুদ্ধে একদুয়ারের বেশি এগোতেই পারলেন না(মে-জুন ১৬৬১),  ভয়াল উত্তরবঙ্গের বর্ষা সামনে আসছে জেনে সেখানে ঘাঁটি গেড়ে বসলেন। কোচেদের বিরুদ্ধে নিজে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করবেন এবভং সম্ভব হলে অহোমদের বিরুদ্ধেও, তাই তিনি বাংলা প্রশাসনে কিছু পরিবর্তন আনলেন।
১৬৬১ সালের ১ নভেম্বর মীর জুমলা এবং দিলির খান খিজিরপুর থেকে ১২০০০ ঘোড়া, ৩০০০০ পদাতিক, প্রচুর যুদ্ধ জাহাজ সহ ৩২৩টা নৌকোর নৌবহর নিয়ে এগোলেন। এই বাহিনীর মধ্যে সব থেকে ভয়াল ছিল ডাচেদের ঘুরাবগুলি, প্রত্যেকটির সঙ্গে ১৪টি কামানযুক্ত ৫০-৬০ জন সেনানী সহ চারটি কষা নৌকো। দোআঁশলা ম্যাস্টকোস ছাড়াও পর্তুগিজদের সব থেকে দক্ষ নৌসেনানীর সঙ্গে ছিল কিছু ডাচ এবং ইংরেজ সেনানীও। ইওরোপিয় যোদ্ধাদের সম্বন্ধে মীর জুমলার সদর্থক মনোভাব ছিল বিশেষ করে পর্তুগিজ, ডাচ গোলান্দাজ আর আমেরিকান রিসালা(ঘোড়সওয়ারদের) ওপর তিনি সন্তুষ্ট ছিলেন। প্রচুর অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত দোআঁশলা পর্তুগিজ ছিল। ডাচেদের মাইনে দেওয়া হত, কিন্তু পর্তুগিজ আর ব্রিটিশেরা সেচ্ছাসেবা দিতে এসেছিল।   
৩। মীর জুমলা কোচবিহার দখল করলেন
বারিতলা সীমান্ত শিবিরে পৌঁছে মীর জুমলা কোচবিহারের দিকে দুটি পরিচিত রাস্তা, একটা একদুয়ার হয়ে যেটিতে রাজার সেনাবাহিনী সারাক্ষণ নজর রেখেছে, একটি সুসজ্জিত শিবিরও রয়েছে, আরেকটি কুঠিঘাট হয়ে রাঙ্গামাটি দিয়ে দুপাশে জঙ্গলে ভরা ছোট রাস্তা, নালা পার করে যাওয়া যায়। এটি খুব ব্যবহার হয় না। তার দূরদৃষ্টিতে তিনি এই রাস্তাটি বাছলেন এবং এগোলেন এবং এই রাস্তায় খুব বড় নজরদারি নেই, রাস্তার তলায় কোচবিহারের বাইরের দেওয়ালের ছোট আল দিয়ে মুঘল বাহিনী চলতে লাগল। বাহিনী এই পথটা নজরদারি করা শুরু করল।
সুজন সিংএর সঙ্গে মীর জুমলার আসার খবর পেয়ে যতটুকু প্রতিরোধ ছিল তাও হল না, সেনারা সব পালিয়ে গেল(১৩ ডিসেম্বর ১৬৬১)।  পরের দিন মীর জুমলা আলের পথ ধরলেন। খচ্চরে চড়ে জঙ্গুলে রাস্তা তৈরিতে সাধারণ সেনানীর সঙ্গেও হাত লাগালেন। কোচবিহারে পৌঁছতে আর তিন ধাপ বাকি তখন খবর এল মন্ত্রীকে নিয়ে রাজা ভূটানের সীমান্তে কাঠাঁলবাড়ি হয়ে মারাঙ্গের পথে পালিয়ে গিয়েছেন। জঙ্গল পার হয়ে, নালা পায়ে হেঁটে বাধাহীন ভাবে ১৯ ডিসেম্বর মীর জুমলা কোচবিহারের রাজধানীতে পৌঁছলেন।
৪। কোচবিহারে মীর জুমলার প্রশাসন
মীর জুমলা কোচবিহারকে তো মুঘল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত করলেন। তার প্রশাসন ছিল তেজি কিন্তু বোঝাপড়ায় সমৃদ্ধ, যাতে সাধারণ মানুষ তুষ্ট হয়। সদর মীর মহম্মদ সিদ্দিকিকে দিয়ে তিনি রাজপ্রাসাদ থেকেই নামাজ পড়ালেন। একডালা দুর্গ ধ্বংস করালেন। ১০০ গজের মধ্যে যে সব জঙ্গল ছিল কেটে ফেলে সমতল করা হল। ১০৬টা কামান, ১৪০টা জম্বুরক, ১১টা রামছঙ্গী, ১২৩তা বন্দুক যুদ্ধ সামগ্রী দখল নিয়ে ঢাকা পাঠানো হল। রাজার ব্যবহৃত নানান জিনিস মহম্মদ আবিদকে দিয়ে পরীক্ষা এবং হিসেব করানো হল। কোচবিহারের নাম হল আলমগীরনগর। মীর জুমলার প্রস্তাবে আওরঙ্গজেবের নির্দেশে আকসর খান স্থায়ী ফৌজদার হিসেবে যোগ না দেওয়া পর্যন্ত আল্লা ইয়ার খানের পুত্র ইসগান্দিয়ার বেগ(খান)কে অন্তর্বর্তীকালীন ফৌজদার, কাজি সামুই সুজাইকে দেওয়ান, মীর বাহাদুর রজ্জাককে মনসবদার এবং খ্বাজা কিশোর দাসকে আমিন পদে নিয়োগ করা হল।   
দেশের শাসন ব্যবস্থায় যদি ঠিকঠাক পরিবর্তন আনেন, তিনি প্রজ্ঞা দেখিয়েছেন রায়তদের সেনানীর লুঠের হাত থেকে বাঁচিয়ে। শহরে ঢোকার আগেই তিনি নির্দেশ দিয়ে সেনাদের, উপস্থিত-পালিয়ে যাওয়া রায়তদের বাড়ির আসবাব এবং অন্যান্য সব সম্পত্তি অত্যাচার লুঠ করার নিষেধাজ্ঞা জারি করে দিয়েছিলেন। আর যারা করবে তাদের চরম শাস্তি এবং জরিমানা করা হবে। যে সব সেনা পালিয়ে যাওয়া রায়তদের উঠোন থেকে গরু বা ছাগল বা ফসল লুঠ করেছিল, তাদের চুরি করা দ্রব্যগুলো গলায় ঝুলিয়ে শহরের ঘুরিয়ে দেখানো হল। প্রত্যেক রায়তকে শহরে ফিরে আসতে উৎসাহ দিয়ে বাড়ি ফিরে চাষাবাদ করতে বলা হল। আলমগির নগরে একটা টাঁকশাল তৈরি করে সেখান থেকে সম্রাটের নামে মুদ্রা ছাপানোর ব্যবস্থা করা হল। রাখাল দাস বন্দ্যোপাধ্যায় লিখছেন, মুঘল জামানার একমাত্র মুদ্রা যেটিতে বাঙলা অক্ষরে পারসিক না হয় আরবিতে ভাষায় লেখা রয়েছে। স্থানীয় সংস্কৃতিকে শ্রদ্ধা এবং যতদূর সম্ভব পরিবর্তন না করার মীর জুমলার এই নীতি অসাধারণ।
রাজার পুত্র মুঘলদের সঙ্গে যোগ দিয়ে ইসলাম গ্রহন করেন এবং বাবাকে ধরিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব দেয়। তার উজির ভবনাথকে দুপাশ থেকে ইফান্দিয়ার এবনহ ফারহাদ খান ধরে আনে এবং রেজা কুলি বেগ আবাকীশ তাকে গ্রেপ্তার করে এবং কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। কিন্তু রাজাকে ধরা সম্ভব হয় নি। তিনি ভূটান পাহাড়ের তলদেশ কাঁঠালবাড়ি থেকে শৃঙ্গের দিকে ঊঠে গিয়েছিলেন। দূতেরা হাতি, দুটি ঘোড়া এবং তার সেগুলির ভূটিয়া মালিককে নিয়ে ফিরে এল। পশুগুলি নবাব দখলে নিলেন এবং ভূটিয়াকে গ্রেফতার না করে তিনি ভূটানরাজ ধর্মরাজাকে চিঠি লিখলেন রাজাকে ফিরিয়ে দিতে, না হয় অন্তত বহিষ্কার করতে। ভূটানের রাজা তার আশ্রিতকে মীর জুমলারহাতে তুলে দিতে রাজি হলেন না। ভূটানের রাজাকে শাস্তি না দিয়েই তিনি ১৬ দিন কোচ বিহারে থেকে অসম(৪ জানুয়ারি, ১৬৬২) অভিযানে বেরিয়ে গেলেন।
১৬৬২র বর্ষায় রাজা পাহাড় থেকে নেমে এসে তার রাজ্য দখল নিলেন। প্রজারা তত দিনে মুঘলদের চাপিয়ে দেওয়া রাজস্ব ব্যবস্থায় অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। তিনি মনসবদার মহম্মদ সালিহকে কাঁঠালবাড়িতে খুন করলেন, এবং ইসফানদিয়ার খানের কাছে রসদ আসার পথ কেটে দিলে গোলাঘাটে পালিয়ে যান। আসকর খান পৌঁছলেও কোচবিহার উদ্ধার করতে পারলেন না।

No comments: