জগদীশ নারায়ণ সরকার
তৃতীয় পর্ব
অসমে মীর জুমলার দুর্দশার শুরু
১। মীর জুমলার বাস্তবিক দুর্দশা
বিজিত দল নিয়ে এর আগে অসম অভযানে যে সব দুর্দশার মুখোমুখি হয়েছিলেন, সেগুলি ফিকে হয়ে পড়ল এবারে বর্ষায় যে দুর্যোগে তিনি পড়তে চলেছেন। রাশিয়ার শীত সমতলে যে প্রভাব সৃষ্টি করে, অসমের বৃষ্টিও সেই ভূমিকা পালন করেছে। নদীগুলি সমুদ্রের মত ফুলে ফেঁপে ওঠে আর নালাগুলি যেন নদীতে রূপান্তরিত হয়। অহমিয়াদের আতঙ্ক মুঘল ঘোড়াগুলি বর্ষায়, কাদায় আর জলাজমিতে কোন কাজই করল না। সামনা সামনি লড়াই না করে অহমিয়ারা মুঘলদের ব্যতিব্যস্ত করার পদ্ধতি আরও ঘন ঘনভাবে কজে লাগাতে লাগল। লুকিয়ে থেকে হঠাত হঠাতই এখান সেখান থেকে রাতে মুঘল থানাগুলি আক্রমণ করলেও মুঘলেরা তার প্রত্যুত্তর দিতে পারল না। এছাড়াও যে সব গ্রামীনেরা মুঘলদের কাছে আত্মসমর্পন করেছিল, তাদের ওপর আক্রমন চালাতে লাগল অহমিয়ারা। সমস্ত রাস্তা বন্ধ করে দিল, খবর দেওয়া নেওয়ার ব্যবস্থাকে বিপর্যস্ত করল, লাখাউ আর গড়গাঁওএর মধ্যের নৌ বাহিনীর রসদ আনায় বাধা দিল অহমিয়ারা। রক্তচোষা তীর ব্যবহার করে তারা মুঘলদের খোলামেলাভাবে ঘোরাফেরা প্রায় বন্ধ করে দিল এমন কি মথুরাপুর আর গড়গাঁওতেও, এখন মুঘলদের তীরান্দাজ সেনা নিয়ে বেরোতে হয়। আত্মসমর্পনকারী গ্রাম দেবলগাঁওয়ের ওপরে আক্রমণ জাগ্রত থানাদারের জন্য ব্যহত হলেও ভিটারুয়াল ফুকন অতর্কিতে হানা দিয়ে আনোয়ার বেগের থেকে গজপুর দখল করে নেয়। ত্রিমোহনী থেকে গজপুর পর্যন্ত দিহিং নদীতে মুঘল সেনার জন্য রসদ আনায় বাধা সৃষ্টি করল অহোম বাহিনী। তিয়ক থেকে আরও ওপর পর্যন্ত সমস্ত মুঘল ব্যাপারী জাহাজ গতায়াত বন্ধ হয়ে গেল অহমিয়াদের আক্রমনে, ফলে রসদ আসাও বন্ধ হয়ে গেল। দিহিংএর বন্যা আর শালপানি পাহাড় থেকে নেমে আসা তীব্র বেগের জল মুঘল দারিয়াবাদীদের গতায়াত বন্ধ করে দেয় এবং মিয়ানা খানের পদাতিক বাহিনী আর রিসালাও বসে যায়। ফলে পাহাড় থেকে বর্ষার মধ্যেই অহোমরা তীব্রবেগে নেমে আসতে আসতে গড়োগাঁও ঘিরে ফেলে যদিও সতর্কভাবে মুর্তাজা বাধা দিতে থাকে এই জেনে যে তার সাহায্যের আর উদ্ধারের জন্য কোন বাহিনী আসবে না। বরগোঁহাইর নেতৃত্বে ১০-১২০০০ সেনা দেওপানি থানা ঘিরে ধরলেও তাদের নেতা মারা যাওয়ায় তারা পিছিয়ে যায়। গড়গাঁও, মথুরাপর আর অভয়পুরের অভয়ে বাস করছিলেন যে সব গ্রামীন, গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যায়।
মুঘল আর আহোমদের মধ্যে একেরপরেক লড়াই, খুন, জখম এত বেশি শুরু হয় যে তা আর গণনা করা বন্ধ করে দেওয়া হয়। কবর খুঁড়ে তার পূর্বজকে বার করার শাস্তিদিতে মুঘলদের হত্যা করার নির্দেশ দেন। কয়েক শকে হত্যা করলেও অহোমরা দেখল, মুঘল সেনার শক্তি কমছে না।
থানাগুলির বিচ্ছিন্নতা মীর জুমলার মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ১৬৬২ সালের মে থেকে অক্টোবর পর্যন্ত মুঘল বাহিনী তাদের শিবিরে বসেই থাকে। কিন্তু সেনাপতিদের ওপর তার নিয়ন্ত্রণ এতই প্রবল ছিল যে এই বসে থাকার মধ্যেও তার বাহিনী নানান আঘাতের বিরুদ্ধে প্রত্যাঘাত করতে থাকে তাদের জীবনের বিনিময়ে। তালিস লিখছেন, পরিচ্ছদ একেবারের জন্যও খোলার সময় পাচ্ছেনা সেনারা। যে সেনা একটাও ধুলো সহ্য করতে পারে না, তাকেই কাদা মেখে সারাদিন জলে ভিজে, সূর্যের রোদ্দুরে পুড়ে যুদ্ধ করতে হয়, ঘোড়ার জিন একদিনের জন্যেও খোলা হয় না, চাকরেরা তাদের প্রভুদের সেবা করতে পারে না, এবং পালগাঘন্টি শুনলেই কোন সময় না নিয়েই প্রত্যেককে হাতে খোলা তরোয়াল ধরতে হয়।
২। নৌবাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করার ব্যার্থতা
মীর জুমলা ছাড়া অন্য কোন সেনা নায়কের পক্ষে বর্ষার অসমের মৃত্যুমুখী পরিবেশ থেকে মুঘল সেনা বাহিনীকে বের করে আনা সম্ভব ছিল না। তার ঠাণ্ডা মাথা, প্রজ্ঞা, ব্যবস্থাপনার দক্ষতার জন্য এই কাণ্ডটি সম্ভবপর হয়েছিল। যেখানে যখন প্রয়োজন সেখানে তিনি প্রয়োজনীয় ত্রান পাঠালেন। তার প্রথম পরিকল্পনা ছিল নৌবাহিনীকে ব্যভার। সেটি তার অসম আক্রমণের প্রাথমিক শক্তি, এবং তার প্রথম কাজ হল নৌবহরের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা। দেওয়লগাঁওয়ে আলি রাজাকে সাহায্যের জন্য গেলেন য়াদগার খান উজবেগ, আক্রমনকারীরা পালাল। কিন্তু গজপুরের থানাদার সারান্দাজ খান লাখাউয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করতে ব্যর্থ হলেন। নালায় বন্যার জন্য তিনি তিয়ক থেকে বেশি দূর পর্যন্ত পৌঁছতে পারেন নি। মীর জুমলা মহম্মদ মুরাদকে নৌবাহিনী দিয়ে এবং পরে পদাতিক দিয়ে সারান্দাজ খানকে উদ্ধারের জন্য নির্দেশ দিলেন। কিছু আধিকারিকের অযোগ্যত্যার জন্য পরিকল্পনাটি মাঠে মারা গেল লড়াই না করেই সেই বাহিনীকে ধরতে সমর্থ হল আহোমরা। ২৩ মে মুরাদ ত্রিমোহনীর দিকে পালাল আর দিলির খানের নেতৃত্বে কিছু নৌকো সুরক্ষিত অবস্থায় দেওলগাঁওতে আসতে পারল। মীর জুমলা হাসানকে দেওপানি ঘিরে বসে থাকা অহোমদের ধংস করতে পাঠিয়েছিলেন, তিনি সেই কাজ করে দেখালেন। গড়গাঁওএর নিরাপত্তার জন্য এবারে সৈয়দ সালার খানের নেতৃত্বে ৫০টি ঘোড়সওয়ার বাহিনী রইল।
ফারহাদ খানকে মীর জুমলা নির্দেশ দিলেন লাখাউ থেকে রসদ আনা, রাস্তার দুপাশে অহোমদের বাধা হটানো এবং গজপুরে থানা বসানো আর ত্রিমোহনি আর রান্ডাংএর সিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার জন্য। ফারহাদ খানকে সাহায্য করার জন্য মীর জুমলার নিজের সিপাহি দিলেন আবুল হাসানকে। কিন্তু এই বিশাল কাজটি ব্যর্থ হতে বসল নৌকোর অভাবের জন্য। গড়গাঁও থেকে ২৭ মে রাতে বেরিয়ে তারা তিয়কে(ত্রিমোহনী আর গজপুরের মাঝে) আটকে গেলেন বন্যার দুর্বিপাকে। জলে ভরা সমতল মাঠ যেন দিহিংএর তুলনায় বিপুলাকায় নদীর মত দেখাতে লাগল। কোনখানেই রাস্তা দেখা গেল না। আকাশ থেকে জল ঝরছে আর মাটির নিচ থেকে আরও বেশি জল উঠছে। তাঁবুগুলো যেন জলের বুদবুদের মত দেখা যেতে লাগল। রিসালারা তাদের ঘোড়ার ওপরে আর পদাতিকেরা তাদের পায়ের ওপরে দাঁড়িয়ে থাকতে বাধ্য হল সারারাত। অসহায় ফারহাদ ফিরতে গেলেন সারান্দাজকে নিয়ে ত্রিমোহনী থেকে, পিছন ফিরে দেখলেন, রাস্তা গভীর খাত আর শালবল্লার খুঁটি দিয়ে আটকানো এবং খাতগুলিকে দিহিঙ্গের সঙ্গে জুড়ে দিয়ে তাদের দ্বীপের মত করে আটকে দিয়েছে। এবারে ভিটারুটয়াল ফুকন তার নৌবহর নিয়ে মুঘলদের চারপাশে ঘুরতে লাগল। নৌবহর আর প্রয়োজনীয় রসদ ছাড়া সেনাপতির প্রায় অসহায় অবস্থা।এই সময় তাদের নিজেদের ঘোড়া আর ষাঁড় কেটে খেতে হয়েছে। মহম্মদ মুনিম বেগ আর একাতাজ খান মীর জুমলার নির্দেশে এলেও তারা ত্রিমোহনীতে বন্যার জন্য আটকে গিয়েছেন। হাতির পিঠে চাপিয়ে উদ্ধারকারী দল পাঠানোর অবাস্তব পরিকল্পনা বাতিল করতের হল। ফারহাদের ইঙ্গিতে সুজন সিংএর বাহিনী অহোমদের নৌবাহিনীর একাংশের দৃষ্টি ঘুরিয়ে দিলে ফারহাদ ভোরে কয়েকটি ছিটিয়ে থাকা অহোম নৌবাহিনীর ওপর অতর্কিতে হানা দিয়ে ৪১টা আহমিয়া নৌকো দখল করেন, অধিকাংশ খাসা। সেগুলির ওপর নির্ভর করে ত্রিমোহনী পৌঁছতে পারলেন।
৩, গড়গাঁও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল
ফারহাদ খানের উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ রূপে ব্যর্থ হয়ে পড়ায় অহোমেরা পূর্ণদ্যোমে সব রাস্তা বন্ধ করে দিল। এমন হল যে থানাগুলি থেকে কেউ বেরোতেও পারবে না কেউ ঢুকতেও পারবে না। মীর জুমলয়া সব থানা বন্ধ করে দিলেন। অভয়পুর থেকে মথুরাপুর খুব কষ্ট করে ফিরে এলেন আজম খান। অন্যেরা গড়গাঁওতে ফিরে এলেন। দিখু পূর্ব দিকে পাহারা দিচ্ছিল সারান্দাজ খান আর মিয়ানা খান, পশ্চিমে মীর মুর্তাজার নেতৃত্বে জালাল খান দারিয়াবাদী, গাজি খান এবং মহম্মদ মুকিম। লাখাউএর পূর্ব দিকের সম্পূর্ণ দেশটি অহোমদের দখলে চলে যায়, শুধু মুঘলদের হাতে থাকে গড়গাঁও এবং মথুরাপুরটুকু। নিরাপত্তা বাহিনী ছাড়া বাইরে বেরোনো অসম্ভব হল। মীর জুমলার সামনে আর কোন আশা নেই, কোন বাহিনীও উদ্ধারে আসতে পারবে না। খাদ্য সহ কোন রসদ মুঘল শিবিরে প্রবেশ করছে না। সক্কলে বাড়ি ফিরে যাবার সব আশা ছেড়ে দিল। তাদের কোন খবরই বাইরে বেরোতে পারছে না, হিন্দুস্তানের বাড়িতে বাড়িতে সেনাবাহিনীতে যাওয়া মানুষদের শেষ কৃত্য করে ফেলল। তালস লিখছেন, বাবা আদমের সময় থেকে ১২ হাজার পদাতিক বহু সংখ্যক রিসালা, অসংখ্য শিবির ছ মাস কোন কাজ ছাড়া ক্ষমতাহীন হয়ে বসে রয়েছে। এ যেন বইয়ের মধ্যে বৃত্ত। তার বাইরে কেউ পা ফেলতে সাহস করছে না।
অহোমেরা দ্বিগুণ উতসাহে পরিকল্পনা সাজাতে লাগল। অভিজাতদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে রাজা তাদের যুদ্ধে যাবার জন্য উৎসাহিত করতে লাগলেন। তিনি নামরূপ থেকে বেরিয়ে গড়গাঁও থেকে মাত্র চার দিনের পথ শোলাগুড়িতে শিবির ফেললেন। বাদুলি ফুকনকে তার নং ফুকনরূপে বা প্রধানমন্ত্রী এবং সেনানায়ক পদে বৃত করলেন এবং নির্দেশ দিলেন মুঘল সেনানীদের হত্যা করে মীর জুমলাকে ধরে আনার জন্য। অহোমদের নির্দেশ দেওয়া হল বাদুলি ফুকনকে যে কোন প্রকারে সাহায্য করতে। ২-৩ দিনেই ফুকন চওড়া, ৬ মাইল লম্বা উবং উঁচু আর শক্ত বুরুজুওয়ালা দেওয়াল মথুরাপুর পূর্বের দিল্লি নদীর তীরে তুলে দক্ষিণী পাহাড়ের সঙ্গে দিহিং নদীর সংযোগ ঘটিয়ে ফেলল। মথুরাপুরের ওপর তার রাতের আক্রমন দিলির খান বফল করে দিয়েছিলেন।বাদুয়লি ফুকন আর বর গোহাঁইএর যৌথ বাহিনীর আক্রমন হওয়ার আগেই শিলিঘাটের মুঘলেরা নামরূপের দক্ষিণে বুরহাটে চলে এসেছিল। সাইরিঙ্গএর রাজা আগামী দিনের চিক্রধ্বজ সিংহ, বা চারিং রাজা গড়গাঁওএ আক্রমণ করলে সুজন সিং তা প্রতিহত করেন। এরকম প্রচুর ছোটখাট লড়াই চলতে থাকে।
No comments:
Post a Comment