Saturday, February 18, 2017

উপনিবেশ বিরোধী চর্চা৭ - উনবিংশ এবং বিংশ শতে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র এবং দেশজ চিকিৎসা ব্যবস্থা ১৮০০-১৯৪৭

পুনম বালা

চিকিৎসা শাস্ত্র শিক্ষা গ্রহনের পরের ধাপ যুক্তি। যুক্তিবুদ্ধির মাধ্যমে প্রাকৃতিক নানান উপাদানগুলি প্রয়োগের হাতে কলমে শিক্ষা দান। যুক্তি শুধুই শুকনো জ্ঞানচর্চা নয়, বরং আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের থেরাপিটিক সাফল্যের বৌদ্ধিক যৌক্তিক প্রয়োগের প্রকাশ২৫। চরকের মতে সিদ্ধি যুক্তান প্রতিষ্ঠিতা/তিষ্ঠতি উপরি যুক্তিজ্ঞানহঃ দ্রব্যজ্ঞানবতম সদা। অর্থাৎ শুধু উপাদানগুলির পুঁথিগত জ্ঞানার্জন নয়, যুক্তিবুদ্ধি প্রয়োগ করে জ্ঞানের প্রায়োগিক বিদ্যা অনেক বেশি উচ্চমার্গের। শেষতমভাবে বলা যায়, যে পুঁথি এবং হাতে কলমে প্রায়োগিক চিকিৎসাশাস্ত্রজ্ঞান চিকিৎসক লাভ করলেন, সেটি আন্তঃবিদ্যা বিতর্ক এবং আলোচনায় আরও বেশি বিকশিত এবং বিস্তৃত হবে এই ব্যবস্থা তৈরি প্রাচীন ভারতের আয়ুর্বেদজ্ঞ তাত্ত্বিকেরা২৭। এটি কিন্তু প্রাচীন ভারতের চিকিৎসাশাস্ত্রের তাত্ত্বিক অবস্থানের খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় – শুকনো জ্ঞানার্জন নয়, সেটির প্রায়োগিক ব্যবহার।

প্রাচীন ভারতে শল্য চিকিতসা অতিরূপে বিকশিত হয়েছিল। কিন্তু সঠিক তথ্যের অভাবে আজ আর বলা সম্ভব নয়, কেন শল্য চিকিতসা পরে বাতিল হল। দেহতত্ত্ব এবং শরীরজ্ঞানের সঠিক ত্থ্য আহরণের জন্য মৃত দেহ প্রয়োজন হত, কিন্তু মৃতদেহ ছোঁয়া নিয়ে যে বিরুদ্ধতার খড়্গ উঠেছিল প্রাচীন কালে, সেই বিষয়ে আমরা আলোচনা করেছি। তার জন্যই মনে হয় এটি ঘটেছে। তবুও হাড় জোড়াবিদ্যা নতুন উচ্চতায় পৌঁছয়। এর সঙ্গে জোড়া যাক নাকের ওপর প্রয়োগ করা শল্যবিদ্যা যা আজকে পশ্চিমি চিকিৎসাবিদ্যায় রাইনোপ্লাস্টি নামে পরিচিত। সেই চিকিৎসাবিদ্যাটিও অসীম উচ্চতায় পৌঁছেছিল২৮।

বলা দরকার অতীতে ভারতই একমাত্র দেশ যেখানে চিকিৎসাবিদ্যায় শল্য জ্ঞানের প্রয়োগ হত। শল্যচিকিৎসা বিদ্যাটি প্রাচীন গ্রিসে বাতিলজ্ঞান রূপে অভিহিত থাকে। শল্যচিকিৎসকেদের নরসুন্দরদের স্তরে নামিয়ে আনা হয়। শুধু গ্রিসই নয়, অন্যান্য সভ্যতায় মনে করা হত ভগবানের রোষেই রোগের উতপত্তি, কেননা মানুষের ভাগ্য নির্ধারণ করেন ভগবানই। ভারতের সঙ্গে তৎকালীন গ্রীসের চিকিৎসাবিদ্যার তুলনা করলেই দুটি চিকিতসাপদ্ধতির মূলগত পার্থক্যটা বোঝা যাবে।

গ্রিক চিকিতসাতাত্ত্বিকেরা প্রয়োগের থেকে পুঁথিগত বিদ্যাকেই জোর দিতেন, অন্যদিকে ভারতীয় চিকিতসা তাত্ত্বিকেরা ঠিক এর উল্টোটা করতেন সে তথ্য আমরা কিছু আগেই আলোচনা করেছি। আদতে খ্রিপূ ৫ম শতক থেকে গ্রিসের শাসকেরা শ্রমকে ঘৃণা করতে থাকেন। ফ্যারিংটন বলছেন, হাত মাথার মধ্যে বিচ্যুতি (তৈরি হল)২৯। ধনাঢ্য শ্রেণীর মধ্যে প্রয়োগ বিদ্যার সঙ্গে তত্ত্বজ্ঞানের বিরোধ ঘটল, তত্ত্বজ্ঞানই প্রধান হয়ে দাঁড়াল, প্রয়োগ নয়। চিকিৎসাবিদ্যায় ভেষজ সংগ্রহের দায়িত্ব যাদের ছিল, তারা সমাজপিরামডের নিম্নস্তরে চলে গিয়ে শুধুই শ্রমিকের পর্যায়ে পৌঁছে গেলেন। চিকিৎসকেরা ওষুধের নতুন জ্ঞান লাভ করা থেকে বঞ্চিতই থেকে গেলেন। চাইল্ড চিকিতসকেদেরকে বলছেন তাত্ত্বিক গবেষক। এরা চিকিতসাবিদ্যাকে প্রায়োগিক বিদ্যা থেকে কল্পনাভিত্তিক শাস্ত্রে পরিণত করলেন। সেই সময়ে ভারতে কিন্তু অবস্থা ঠিক উল্টোটা, প্রাচীন ভারতীয় চিকিৎসাশাস্ত্রে, বিভিন্ন ভেষজ সংগ্রহ করে, সেগুলি প্রায়োগ করে চিকিতসা জ্ঞানের বিকাশের বিশদ বিবরণ বর্ণিত হয়েছে। গ্রিসের চিকিতসকেদের পথে না হেঁটে ভারতীয় চিকিৎসকেরা আইনরূপায়কদের বেঁধে দেওয়া সীমার মধ্যেই ভেষজ এবং তার প্রয়োগের ফলের বিপুল জ্ঞান আহরণ করেন।

গ্রিসে চিকিৎসকেরা শুধু ভেষজিক ওষুধের প্রায়োগিক জ্ঞান অর্জন থেকে বঞ্চিত হলেন তাই নয়, অন্যান্য ওষুধ বিষয়েও সাধারণ জ্ঞানার্জন থেকে বঞ্চিতই থেকে গেলেন৩১। আমরা গ্রিসীয় চিকিৎসাবিদ্যার ইতিহাসের সঙ্গে আয়ুর্বেদের তুলনা করলে দেখব, ভারতে চিকিতসকেদের ভেষজ সংগ্রহে যথেষ্ট গুরুত্ব ও উতসাহ দেওয়া হচ্ছে যাতে তার পুঁথিগত বিদ্যার বিস্তৃতি ঘটতে পারে বিশেষভাবে। গ্রিসে হিপোক্রিটের পরবর্তী প্রজন্মের চিকিৎসকেরা এই বিশেষ জ্ঞানার্জন থেকে বঞ্চিতই থেকেছেন। চিকিৎসকেদের হাতে কলমে কাজ করে উতকর্ষ লাভের যে পথনির্দেশ ভারতীয় চিকিতসাবিজ্ঞান দিচ্ছেন, সেখানেও ভারতের সঙ্গে গ্রিসিয় চিকিৎসাবিদ্যার মৌলিক তফাত ঘটে গিয়েছে। চরকসংহিতায় বলা হয়েছে, চিকিতসাসাস্ত্রীয় উপাধিওয়ালা চিকিতসাশাস্ত্রীর হাতে কলমে কাজ, উত্তম চিকিতসকে রূপান্তরিত হতে সাহায্য করে৩২। গ্রিসিয় চিকিৎসকেরা প্রকৃতির আরোগ্যদানিক ক্ষমতা প্রয়োগ করে ফলপ্রসূ চিকিতসাজ্ঞানের নিদান দান করতে পারতেন না।

ভারতীয় চিকিতসাবদ্যার ওপর গ্রিসিয় চিকিৎসাবিদ্যার বিশেষ প্রভাব রয়েছে এই তত্ত্বের মূলে কুঠারাঘাত করে আমাদের আলোচ্য গ্রিসিয় বনাম ভারতীয় চিকিৎসাজ্ঞান। চিকিৎসাবিদ্যার দৃষ্টিভঙ্গীর এই বিপুল পার্থক্য নিয়ে এই প্রভাবতত্ত্বে আস্থাবান হওয়াটাই মুশকিল। তবে এখানে দুটি তত্ত্ব বিদ্যমান – কুতুম্বিয়ার৩৩ মতে গ্রিসিয় চিকিতসাবিদ্যা বিকাশের বহু আগেই ভারতীয় চিকিৎসাজ্ঞানের বিকাশ ঘটেছিলে৩৪। য়লি আর ফিলিওজাটের বক্তব্য দুই সভ্যতার চিকিৎসাশাস্ত্র পরস্পরের ওপর প্রভাব বিস্তার না করেই সমান্তরালভাবে বিকাশলাভ করেছিল। ফরাসি সংস্কৃতবিদ ফিলিওজাটের বক্তব্য, সামগ্রিক পশ্চিম এবং পূর্বগোলার্ধর কিছুটা অংশজুড়ে গ্রিসিয় চিকিৎসাবিদ্যার বিকাশের সঙ্গে, বৌদ্ধ ধর্মের হাত ধরে প্রতিবেশী দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় ভারতীয় চিকিৎসাবিদ্যার বিস্তার ঘটার তুলনা করা যায়।

প্রভাবের তত্ত্বটি আজও বিতর্কিত থেকে গিয়েছে। কিন্তু আয়ুর্বেদের বিকাশের উচ্চতম স্তরের যে ইতিহাস আমরা আলোচনা করেছি, সেই যুক্তিতে আমরা সরাসরি কুতুম্বিয়ার তত্ত্বে আস্থা পেশ করতে পারি।
(চলবে)

No comments: