পুনম বালা
মধ্য যুগে চিকিৎসা ব্যবস্থা
প্রাচীন যুগের শেষে আয়ুর্বেদের চিকিৎসা পদ্ধতি এবং তত্ত্বের লিখিত সংস্করণ তৈরি হয়েছিল। তার সময়ের শাসকদের অনুমতিক্রমে চিকিৎসক বা সংহিতাকার বা সম্পাদকেরা বছরের পর বছর ধরে প্রয়োজনীয় ওষুধগুলিকে চিকিৎসাশাস্ত্রে অঙ্গীভূত করার কাজ করেগিয়েছেন নিরলসভাবে।
মধ্যযুগে ভারতে ইসলাম অভিযানের সঙ্গে সঙ্গে গ্রিসিয়-আরবিয় ইয়ুনানি চিকিৎসা ব্যবস্থার ভারতে আগমন ঘটল। য়ুনানিরর তত্ত্বগুলি মিশর এবং গ্রিসের চিকিৎসা শাস্ত্র নির্ভর করে বিকশিত এবং বাগদাদী খলিফার পৃষ্ঠপোষকতায় আরব আর পারস্যে এসে সেটি একটি নির্দিষ্ট অবয়ব ধারণ করে। সে সময়ের পারস্য ভারত চিন মধ্য এবং দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলির চিকিৎসা ব্যবস্থার জোরের দিকগুলি আহরণ করে আরবেরা এই চিকিৎসা ব্যবস্থাটিকে সমৃদ্ধ করে। পরের দিকে মুঘলেরা এটিকে আরও সুসংবদ্ধ করে।
মধ্য যুগের ভারতে আলোচ্য দুটি চিকিৎসা ব্যবস্থার বন্ধুত্বপূর্ন সহাবস্থান ঘটেছিল তিনটি গুরুত্বপূর্ণ মিলের জন্য - এগুলি হল সংহিতা করণের ওপরে গুরুত্ব দেওয়া, দৈহিক ধাত তত্ত্ব এবং চিকিৎসা জ্ঞানের হস্তান্তর।
সিদ্দিক৬৮ এবং ইসরায়েলি৬৯র বয়ানে পাচ্ছি, মধ্যযুগের রাজা, সুলতানেরা চিকিতসকেদের চিকিৎসার সংহিতা প্রকাশ করে চিকিৎসার জ্ঞানকে বিস্তৃতির সুযোগ করে দিয়েছিলেন। চিকিতসকেদের নিয়ে চিকিৎসা কেন্দ্র, রোগ নির্নয় কেন্দ্র তৈরি করেন।
য়ুনানানির নানান সংকলনের মধ্যে মাদানু-শিফা সিকারশানি নামক পুঁথিতে য়ুনানি চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে বিশদে আলোচনা রয়েছে। এটিতে য়ুনানি এবং আয়ুর্বেদে ব্যবহৃত নানান ভেষজ থেকে তৈরি ওষুধের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে।
মনে হয়, এই সময়ের চিকিৎসকেরা তাদের সারা জীবনের অধীত জ্ঞান এবং বিদ্যা উজাড় করে দিয়েছিলেন পুঁথি লেখার কাজে যাতে তারা রাজা রাজরাদের খুশি করতে পারেন। অন্য চিকিতসকেদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা তো ছিলই, একে অন্যকে দমিয়ে দিতেও চেষ্টা করেছেন, যাতে একজন অন্যের থেকে বেশি সুযোগ এবং খ্যাতি অর্জন করতে পারেন। এগুলি সেসময়ের চিকিৎসা ব্যবস্থা – ওষুধ, ভেষজ, রোগের বিশ্লেষণ এবং ওষুধ রোগীর দেহে কিভাবে কাজ করছে সেই সবের সংহিতা মাত্র। সে সময় এ ধরণের প্রচুর সংহিতা প্রকাশিত হয়েছিল, যেগুলিকে নতুন বৈজ্ঞানিক কাজরূপে আজ ভুল করা হয়। বাস্তবে দুটি ব্যবস্থারই চিকিতসকেরা রাজ দরবারে স্থান পেয়েছন, ধনার্জন করেছেন, প্রখ্যাত হয়েছেন। চিকিৎসার ক্ষেত্রে অগ্রগতির কোন বিশেষ চরিত্রের সন্ধান পাওয়া যায় না, যেহেতু পার্সি ছিল রাজদরবারের ভাষা, সেহেতু চিকিৎসা শাস্ত্রগুলি পার্সি ভাষাতেই রূপান্তরিত হয়েছে। এটি শুধু য়ুনানি বা হেকিমি চিকিতসকেদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রইল না, ভারতীয় প্রাচীন চিকিতসাবিদ্যার চিকতসক বৈদ্যরাও এ ধরণের সংহিতা তৈরিতে জুড়ে গেলেন। তাদের মাঠেঘাটের অভিজ্ঞতার জ্ঞান সংহত করে তারা নতুন করে প্রাচীন চিকিৎসা শাস্ত্রকে নতুন করে লিখলেন। আয়ুর্বেদ আর য়ুনানি চিকিতসকেরা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে চিকিতসাবিদ্যার সংহিতাকরণের কাজ করতে থাকলেন।
দেহের ধাত বা রস(বডি হিউমার) সংক্রান্ত তত্ত্ব কিন্তু আয়ুর্বেদ এবং য়ুনানি এই দুই চিকিতসাবিদ্যার ভিত্তি – পার্থক্য মাত্র হল রস বা ধাতের সংখ্যায়। হেকিমেরা টেট্রাহিউমরাল(চাররস) তত্ত্ব ভিত্তিতে চিকিৎসা করতেন, অন্যদিকে বৈদ্যরা নির্ভর করতেন ট্রিহউমরাল(তিনরস) তত্ত্বে। পার্থক্য বলতে শুধু এইটুকু।
হেকিমেরা রসকে চার ভাগে ভাগ করতেন, রক্ত, কফ, হলুদ এবং কৃষ্ণ পিত্তরসে। এইগুলিই শরীরের ব্যথা এবং স্বাস্থ্য নির্ভর করে। দুটি চিকিসা ব্যবস্থাই এই রসগুলি পরস্পরের সঙ্গে মিলিয়ে মিশিয়ে তত্ত্ব তৈরি করে রোগ আর স্বাস্থ্য বিচার করে। এইগুলির কোনোটার অভাব বা কোনটার আধিক্য দেহের সাম্যাবস্থায় গলদ এনে দেহকে অসুস্থ করে, অন্যদিকে এগুলির ঠিকঠিক অনুপান দেহকে সুস্থ রাখে। দেহের তাপমাত্রার ওপরে নির্ভর করে হেকিমরা স্যাঙ্গুইন, ফেলম্যাটিক, কলেরিক এবং মেলানকলিক(য়ুনানিতে ব্যবহৃত প্রাযুক্তিক শব্দগুলি জানিনা তাই পুনমের ব্যবহৃত শব্দগুলি ব্যবহার করলাম) অবস্থার ওষুধ ব্যবহার করেন। ফলে মোটের ওপরে মোটামুটি সৌসাদৃশ্যই দুটি চিকিৎসা ব্যবস্থার পরম্পরের সঙ্গে মিলেজুলে থাকার কারণ।
মধ্যযুগে বা মুসলমান শাসনের প্রথম দিকে শিক্ষকেরা গুরু হিসেবে শিক্ষা দান করতেন। সে অর্থে হেকিমির কোন শিক্ষা কেন্দ্র ছিল না, হেকিমেরা ছাত্রদের নিয়ে হাতে কলমে চিকিৎসা শেখাতেন। শিক্ষক আর ছাত্রের মধ্যে একটা ব্যক্তি নির্ভর নীতিমূলক(ডিডাকটিভ) শিক্ষা দানের পরিবেশ গড়ে উঠেছিল। শিক্ষকের চিকিতসাকেন্দ্র বা বাড়িই হয়ে উঠত শিক্ষা কেন্দ্র। এই চিকিৎসা ব্যবস্থা মূলত পারিবারিক ছিল, পিতার কাজের উত্তরাধিকার আর্ষাত পুত্রের ওপরেই৭০। এই পারিবারিক উত্তরাধিকারের পরম্পরা দীর্ঘদিন ধরে চলেছে এবং আজও সেই ধরণের প্রাচীন কিছু পরিবারের সন্ধান পওয়া যায়৭১। হেকিমদের এই ধরণের বংশলতিকা ইমতিহান-উল-আলবা-লে-কাফাত-ইল-আল-তিবা নামক চিকিৎসাশাস্ত্রে পাওয়া যায়।
মুসলমান শাসন যুগে চিকিৎসাবিদ্যা অনেকটা বৈদিক ব্রাহ্মণ জ্ঞানচর্চার মত হয়ে উঠছিল। শিক্ষক আর ছাত্রের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক এই শিক্ষা ব্যবস্থার মূলে। এই জন্যই য়ুনানি পদ্ধতির সঙ্গে আয়ুর্বেদিয় পদ্ধতির কোন বিরোধ ঘটল না, বরং তারা উভয়েই মুসলমান সুলতানদের পৃষ্ঠপোষকতা অর্জন করল অথচ এর সঙ্গে ব্রাহ্মণ জ্ঞানচর্চা নির্ভর শিক্ষাদানের অমিল যথেষ্টই। ভারতে শাসকদের সেবা করতে যে সব পার্সি চিকিতসকেরা এলেন, তাদের আকাঙ্ক্ষা উদ্দেশ্য এবং কর্মপদ্ধতি প্রাচীন ভারতের চিকিতসকেদের থেকে আলাদা। মুসলমান ধর্মবিশ্বাস য়ুনানি চিকিৎসা বিদ্যার বিকাশে মাথা গলায় নি। ফলে চিকিৎসা শিক্ষা নির্দিষ্ট চিকিৎসা সংক্রান্ত সংস্থাগুলি থেকেই করা হত।
(চলবে)
No comments:
Post a Comment