Wednesday, February 22, 2017

উপনিবেশ বিরোধী চর্চা১৮ - উনবিংশ এবং বিংশ শতে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র এবং দেশজ চিকিৎসা ব্যবস্থা ১৮০০-১৯৪৭

পুনম বালা

পূর্বের দেশ সমূহে পশ্চিমি চিকিৎসাবিদ্যা শেখানোর লক্ষ্যে এই শিক্ষাকেন্দ্রটি প্রণালীবদ্ধ পাঠ্যক্রম পরিচালনায় পুরোধা রূপে কাজ করবে আগামী দিনে। এই শিক্ষাকেন্দ্র বিষয়ে আমরা পরের অধ্যায়ে বিশদে আলোচনা করব। এটির পরিচালনভার দেওয়া হল এডুকেশন কমিটির ওপর এবং বেন্টিঙ্কের নির্দেশনামায় বলা হল এই শিক্ষাকেন্দ্রে ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে ১৪ থেকে ২০ বছরের মধ্যে যে কেউ ভর্তি হতে পারবে। আপাতত ছাত্ররা সরকারের থেকে সাত টাকা জলপানি পাবে এবং সেই অঙ্কটি পরের দিকে বাড়তে পারে। এই নির্দেশে বলে দেওয়া হল সে সময়ের সরকারি ভাষা ইংরেজিতেই পড়াতে হবে। দেশের শিক্ষা চর্চায় ভাষা পছন্দ পালটে যাওয়ার পিছনে মেকলের বড় হাত রয়েছে, কেননা তিনি প্রতিনিয়ত ভিত্তিহীনভাবে সংস্কৃত সাহিত্যের ওপর আক্রমন শানিয়ে চলতেন, এবং বললেন উচ্চ শিক্ষা হবে পশ্চিমি পাঠ্যসূচী এবং শিক্ষার বাহনই হবে একমাত্র ইংরেজি২৬।

ভারতে চিকিৎসা বিদ্যা শিক্ষার ইতিহাসের ক্ষেত্রে এগুলি খুব গুরুত্বপূর্ণ স্তর, কেননা এই প্রথম পশ্চিমি চিকিতসাবিদতা আর দেশিয় চিকিতসাবিদ্যার যৌথ পাঠ্যক্রমে বিভেদ এনে দিল। এই ঘটনাটি বহুকাল পরে সংশ্লিষ্ট এবং জাতীয়তাবাদী ভারতীয়রা দেশিয় চিকিৎসাবিদ্যার জন্য আন্দোলনে নামবে।
১৮২২ থেকে ১৮৩৫ সাল পর্যন্ত এনএমআই ১৬৬ জন দেশিয় চিকিৎসককে দেশিয় এবং পশ্চিমি চিকিৎসাবিদ্যায় শিক্ষা দান করেছে। ১৯৩৯ সালে সরকার বাংলা প্রেসিডেন্সিতে ৩০৫ জন দেশিয় চিকিতসককে নিযুক্ত করে, তার মধ্যে ১২৪ জনই বিলুপ্ত এনএমআইএর ছাত্র। অন্যান্য ছাত্র গান ক্যারেজ এজেন্সিতে কাজ পেল। চতুর্থ অধ্যায়ে আমরা আলোচনা করব এর পর থেকে কিভাবে সরকারের শিক্ষা দান নীতি ক্যালকাটা মেডিক্যাল কলেজ কেন্দ্রিক হয়ে উঠল।

দেশিয় ওষুধ
১৮৩৫ সালে দেশিয় এবং পশ্চিমি চিকিৎসা শিক্ষা ব্যবস্থার রাস্তা আলাদা হয়ে গেলেও দেশিয় ওষুধ যেহেতু শস্তা এবং সহজেই পাওয়া যায়, তাই সেটি তৈরিতে ব্রিটিশদের উতসাহ কমল না। এর ফলে ড ও’শাউঘনেসির বেঙ্গল ফার্মাকোপিয়া তৈরি হল। এই বইটি ১৮৩৭ সালে প্রকাশিত হয়, এতে বাংলায় যে সব ভেষজ ব্যবহার হয় সেগুলির বিশদ বর্ননা রয়েছে। এ বছরেই বাংলার গভর্নর জেনারেল ইন কাউন্সিলএর নির্দেশে কলকাতায়, দেশজ ওষুধ তৈরির জন্য একটি রসায়নাগার স্থাপন করা হল এবং সিদ্ধান্ত হল ড ও’শাউঘনেসির মত অনুসারে দেশজ ফার্মাকোপিয়া নির্ভর করে কোন ওষুধের কি কি গুণাগুণ তা জানার। বলা হল এই শস্তা এবং কার্যকর ওষুধগুলি শুধু সাধারণ মানুষেরই উপকারে লাগবে না, মিলিটারি এবং সাধারণ হাসপাতালগুলির ওষুধ দোকানেও মিলবে।

রাষ্ট্রীয় নীতিতে দেশিয় ফার্মাকোপিয়ায় উল্লিখিত ওষুধের গুনাগুণ নির্ধারণের জন্য চিকিৎসক(মেডিক্যাল মেন) নিয়োগ করা একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। কলকাতার ডিসপেনসারি কমিটিতে দেশিয় ওষুধের বিষয়ে জ্ঞান সম্পন্ন সম্ভব হলে একজন দেশিয় ওষুধ তৈরির নির্দেশক(এপোথেকারি জেনারেল), বোটানিক্যাল গার্ডেনের নির্দেশককে প্রবেশাধিকার দেওয়া হল। রোগ নির্নয়ে বাংলার প্রায় প্রত্যেকটি দাতব্য চিকিতসাখানায় ভারতীয় কম্পাউণ্ডার নিযুক্ত হল। ড ও’শাউঘনেসি সরকারকে বললেন, দেশিয় মেটিরিয়া মেডিকা তৈরিতে বর্তমানে কর্মক্ষম দেশজ চিকিতসকেদের নির্দেশে দেশজ রোগের জন্য নির্দিষ্ট ওষুধের যথেষ্ট পরিমান তৈরি করে হাসপাতালে প্রয়োগ এবং সেগুলির প্রভাব নিরীক্ষণ করতে। ড ও’শাউঘনেসিরর নির্দেশে এই গবেষণায় ক্যানাবিস ইন্ডিকা ব্রিটিশ ফার্মাকোপিয়ায় প্রবেশ করল ১৮৩৯ সালে। এই ওষুধটি আরক এবং নির্যাস তৈরি হল।
চিকিৎসকেরা একদিকে যেমন ওষুধের ওপর গবেষনা করছিলেন, অন্যদিকে মেডিক্যাল বোর্ড এবং গুরুত্বপূর্ণ হাসপাতালে যুক্ত শল্য চিকিৎসকেরা ওষুধগুলির প্রয়োগের প্রভাব নির্ণয় করে মেডিক্যাল বোর্ডকে তাদের সমীক্ষা দিচ্ছিলেন। সরকারি খরচেই ফার্মাকোপিয়া ছাপা হল৩৩।

১৮৪১ সালে পশ্চিমি চিকিতসকেরা বাংলার একটি চিকিৎসালয়ে (ডিসপেনসারি)৩৪ দেশিয় ওষুধ প্রয়োগ করলেন৩৫। কালা দানা এবং কুট কেলিজার মত দেশিয় ওষুধ ব্যবহার করা হল সেখানে। পারদ এবং আফিম নির্ভর বহু ওষুধ প্রয়োগ করা হল ১৮৩৯-৪০এর বাংলা প্রেসিডেন্সির ব্যাপক কলেরা মহামারীতে৩৭। এইগুলি এবং অন্যান্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াহীন ওষুধ সফলভাবে চট্টগ্রাম চিকিৎসালয় থেকে প্রাথমিকভাবে প্রয়োগ করা হল এবং সেগুলি যে খুব ভাল কাজ করছে সে তথ্য সমীক্ষাতেও পাওয়া গেল। চট্টগ্রাম চিকিতসালয়ের অর্ধবার্ষিকী সমীক্ষায় এই তথ্য স্পষ্টভাবে জানানো হয়েছে।
১৮৫০এর দিকে পরের স্তরে গবেষণায় দেশিয় ফার্মাকোপিয়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং ব্রিটেনের ফার্মাকোপিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ কিছু পরিবর্তন আসে। মেডিক্যাল এক্ট ১৮৫৮র আইনে সরকারিভাবে যে সব ওষুধ উল্লিখিত হল সেগুলি জেনারেল মেডিক্যাল কাউন্সিলে প্রতিপালিত হয়ে ১৮৫৮ সালে ব্রিটিশ ফার্মাকোপিয়া নামে চিহ্নিত হয়। এর মধ্যে রয়েছে ওষুধ এবং কম্পাউণ্ডের তালিকা, সেগুলি তৈরির প্রক্রিয়া, এবং কোন অনুপানে এবং ওজনে সেগুলি তৈরি করতে মিশ্রিত করতে হবে তার বিশদ বিবরণ। প্রথম সংস্করনটি প্রকাশনার খুব তাড়াতাড়ি ১৮৬৪ সালের দ্বিতীয় সংস্করণের কাজ শেষ হল, ততদিনে পশ্চিমি চিকিৎসকেরা দেশজ ফার্মাকোপিয়া নিয়ে বিশদে কাজ করেছেন এবং তার সমীক্ষা প্রকাশও পেয়েছে।
(চলবে)

No comments: