এই ছবিগুলি মধুমঙ্গল মালাকারের ভাই গুরুকিঙ্কর আর তার পুত্র গৌরবের। ছবিগুলি গৌরবের কল্যানে পাওয়া। সে সাম্মানিকস্তরে পড়ছে - কিন্তু বাপ-দাদার কয়েকশ বছরের কাজ ছাড়ে নি। বরং কোথাও কোথাও মনে হয় সে হয়ত তার বাপ-দাদকে ছাড়িয়ে যাবে আগামী দিনে, যদি লেগে থাকে, যদি তার কাঁধের ওপর মাথাটা ঠিক থাকে।
দিনাজপুর!
একদা, খুব বেশি দূর যেতে হবে না, মাত্র শ'সাতেক বছর, বাংলার শিল্প-বাণিজ্য-উতপাদনকর্মে ছিল অগ্রগণ্য। বাংলার ইতিহাসে পুণ্ড্রবর্ধনের স্থান আজও সম্ভ্রম জাগায়। ইংরেজদের লুঠেরা ব্যবসায় দিনাজপুর ছিল প্রথম সারিতে। বাঙলা-বাঙালি বিদ্বষী কেরির কর্মস্থল দিনাজপুর। আজও ইতিউতি দিনাজপুরে নীলকুঠির ভাঙ্গাবাড়ি চোখে পড়ে। ঠাকুরদের জমিদারিও ছিল দিনাজপুরে।
গৌড় নামে যে ভূখণ্ডটি বিশ্বে পরিচিত, তার ভৌগোলিক বিস্তৃতি ছিল মুর্শিদাবাদ-মালদা-দিনাজপুর।
তো দিনাজপুর-গৌড় ছিল বিশ্ববাণিজ্যকেন্দ্র। বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার ঘোড়া বাণিজ্যে গৌড়ের স্থান ছিল অনতিক্রম্য। শুধু গৌড় শহরেই একসঙ্গে তিনটি টাঁকশাল চলত।
তুর্কি দেশের তাতারি ঘোড়া(অশিক্ষিত ব্রিটিশদের উচ্চারণে টাট্টু ঘোড়া), ইরাকি ঘোড়া বা মধ্য এশিয়ার ঘোড়া চিন সহ দক্ষিণ এশিয়ায় যেত এই গৌড়বঙ্গ হয়েই। দিনাজপুরের কুনোরের পোড়ামাটির কারিগরদের ঘোড়া বিষ্ময় জাগায়। পীরের সমাধিতে আজও প্রত্যেক ধর্ম্নসম্প্রদায় এই ছলন ঘোড়া মানত করেন।
মুদ্রা বিশেষজ্ঞ, সৈয়দ এজাজ হুসেইন Silver Flow and Horse Supply to Sultanate Bengal with special Reference to Trans-Himalayan Trade (13th-16th Centuries) প্রবন্ধে বলছেন উচ্চ দামের যুদ্ধ ঘোড়া দক্ষিণভারতের সুলতানি রাজ্য হয়ে বাঙলায় পৌঁছত, সেখান থেকে জাহাজের চেপে বা ভূপথে যেত চিনের উনান বা দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার নানান দেশে। তার পরিবর্তে ঘোড়া কারবারিরা তাদের দেশে সোনার বাঙলা থেকে নিয়ে যেত বস্ত্র, খাবারদাবার, মশলা, তেল, নুন ইত্যাদি।
তো এই ইতিহাস আজও বয়ে বেড়াচ্ছেন দিনাজপুরের মধুমঙ্গল মালাকার আর তার বিস্তৃত পরিবার নাচের ঘোড়া তৈরির মাধ্যমে। এই ঘোড়া নিয়ে নাচ করেন সাঁওতাল সমাজ আর মুসলমান ধর্মাবলম্বীরা। ইতিহাসে মুসলমান ধর্মাবলম্বীদের ঘোড়া ব্যবহার আর তার বিশ্বব্যাপী বাজার তৈরির ইতিহাস জ্ঞাত আজও দুলদুল শুধু আরবে নয়, এই বাংলার কথ্য সংস্কৃতির বিপুল অংশ।
কিন্তু সাঁওতাল সমাজে কেন? এই বিষয়টি বেশ ভাবাচ্ছে।
হিতেশ রঞ্জন সান্যাল মশাই সোসাল মবিলিটি ইন বেঙ্গল, ১৯৮১ সালের প্রবন্ধে বলছেন একদা সাঁওতাল সমাজ লোহাচুর থেকে লোহার দণ্ড তৈরি করতেন, সেই লোহা নিয়ে নানান তৈজস বা ব্যবহারের কাজ করতেন কর্মকারেরা। সাঁওতাল গ্রামের বাইরে তাই একটি অন্তত অসাঁওতাল পরিবারের বাস থাকত। এখন সাঁওতালেরা সেই বিদ্যে ভুলেছেন।
কিন্তু ঘোড়া কেন? সাঁওতালি ইতিহাসে কোথাও সাঁওতাল সমাজে ঘোড়া ব্যবহারের উল্লেখ পাওয়া যায় বা। তাহলে কেন আজ সাঁওতাল পরবে ঘোড়া নাচ হয়? তারা কি বাগদী বা ডোমেদের মত একদা যুদ্ধ জাতি ছিল?
কোন সুধি কি উত্তর দিতে পারেন।
No comments:
Post a Comment