পুনম বালা
নিম, চিরতা এবং অনন্তমূলের মত দেশজ ভেষজ ওষুধ বিভিন্ন মেডিক্যাল মেন মেডিক্যাল কলেজে বিক্রি করত, এগুলি রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে প্রকাশিত তালিকা থেকেই নির্বাচিত করা হয়েছিল। গভর্নর কাউন্সিলের সূত্রে জানা যাচ্ছে বাংলা প্রেসিডেন্সির প্রখ্যাত পশ্চিমি চিকিৎসকেরা বিংশ শতের প্রথম দশকে মকরধ্বজ দিয়ে টাইফয়েড এবং অন্যান্য রোগের চিকিৎসা করেছেন৬৫, এছাড়াও বিভিন্ন স্থানীয় কমিটি ম্যালেরিয়া এবং পেটখারাপ নিয়ন্ত্রনে দেশিয় ওষুধের তালিকা চেয়ে পাঠাত। এর ফলে ইওরোপিয় ওষুধ কেনা বন্ধ হয়ে যায়৬৮। ঘোষ এই ঘটনার প্রেক্ষিতে বলছেন প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের জন্য পশ্চিমি ওষুধ আসা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এই দেশি ওষুধ দিয়ে চিকিৎসার ঘটনা ঘটেছিল। সেই সময় স্থানীয় উপাদান ব্যবহার করে নিদান দেওয়ার সাঙ্ঘাতিক চেষ্টা করেছিল সরকার।
কলকাতা থেকে প্রকাশিত ইংলিশম্যান পত্রিকা বলছে যুদ্ধের জন্য মধ্য ইওরোপ সারা বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় ভারতে বিভিন্ন ধরণের ভেষজ আমদানি বন্ধ হয়ে যায়। ফলে ভারতে ভেষজ চাষে উতসাহ দেওয়া হতে থাকে। ইংলন্ডের চিকিতসাবিদ্যার স্নাতক এবং বম্বের গভর্মেন্ট মেডিক্যাল স্টোর্স ডিপার্টমেন্টের ফার্মাসিউটিক্যাল কেমিস্ট ছিলেন ঘোষ। তিনি কলকাতার স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিনের সঙ্গে একটা বাগান করে ভেষজ চাষের গবেষণার প্রস্তাব দেন।
১৯৩০ সালে সরকার আরও একটা কমিটি তৈরি করে ভারতের বাজারে দেশিয় চিকিৎসকেরা যে ধরণের ওষুধ বিক্রি করেন তার কার্যকারিতা এবং বিশুদ্ধতা নির্ণয় করার সমীক্ষা করতে বলে। সরকারের এই উদ্দেশ্য ভারতীয়রা খুব ভালভাবে নেয় নি। দেশে যখন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে, তখন অনেকেরই মনে হতে থাকে কংগ্রেস যেহেতু ব্রিটিশ ওষুধ বর্জনের ডাক দিয়েছে তার প্রতিষেধক হিসেবে এই কমিটিটি সরকার তৈরি করেছে।
এই কমিটির সরকারি নাম হল ড্রাগ এনকোয়ারি কমিটির। যেহেতু কমিটিকে সরকার শর্ত বেঁধে দিল, দেশজ ঔষধগুলি কতটা অশুদ্ধ ভাবে এবং প্রয়োগের সিঠিক কার্যকারিতা না নিয়েই ব্রিটিশ ভারতে বিক্রি হচ্ছে তা নির্নয় ও সমীক্ষা করা, তাই জাতীয়তাবাদীদের মনে প্রথমেই সরকারের উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দেহ উঁকি মারতে শুরু করে। ততদিনে ইওরোপিয় ওষুধ ভারতের বাজারের পকড় পেয়ে গিয়েছে এবং আন্দোলনকারীদের অভিযোগ সরকার উদ্দেশ্যপূর্ণ ভাবে দেশজ ওষুধ তৈরি ব্যবস্থাকে ভেঙ্গে দিতে চাইছে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে ব্রিটেনে দেশিয় ওষুধ শিল্পের বিকাশ একটা বড় কাজ হয়ে দাঁড়াল, যেহেতু ওষুধের জন্য ব্রিটেন সরাসরি নির্ভর করত জার্মানির ওপরে। সে সময় জার্মানি বিশ্ব ওষুধ শিল্পের অঘোষিত নেতা। কিন্তু যুদ্ধ এসে যাওয়ায় জার্মান ওষুধ কোম্পানিগুলি ঠিকমত প্রয়োজনীয় ওষুধ সরবরাহ না করতে পারায় যুদ্ধের প্রয়োজনে ওষুধ সংক্রান্ত গবেষনার কাজ জোর কদমে শুরু হয়ে গেল। একই ঘটনা ঘটে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ১৯৩৭ থেকে ১৯৪৬এর সময়টিতে, ব্রিটিশ ওষুধের বিক্রি তিনগুণ বেড়ে দাঁড়ায় ৫৮ মিলিয়ন পাউণ্ডে। যুদ্ধের পরিবর্তী পর্যায়ে একাডেমিক গবেষণা সংস্থাগুলি বিভিন্ন থেরাপিটিগ যৌগ আবিষ্কার করে, এবং সওদাগরি সঙ্গঠনগুলি সেগুলিকে ওষুধে রূপান্তরিত করে বাজারে নিয়ে আসার উদ্যম নেয়। এর পর থেকে গবেষকেরা মূল মেডিক্যাল কলেজগুলি থেকে বেরিয়ে গিয়ে সওদাগরি সঙ্গঠনের গবেষণাগারে যোগ দিতে শুরু করে।
ব্রিটিশ বাংলার দেশজ ওষুধ বিষয়ে সরকারি নীতির পরিবর্তনকে তিনিটি পর্বে ভাগ করতে পারি, প্রথম পর্যায়ে উনবিংশ শতের শুরুতে যখন সরকার দেশিয় ওষুধের গবেষণা এবং চিকিতসায় উতসাহ দিতে থাকে। দ্বিতীয় পর্যায় হল শতাব্দ যত এগোতে থাকল দেশিয় ফার্মাকোপিয়ার ক্লিনিক্যাল গবেষণা তিন ধরণের রাস্তায় গেল, প্রথম, পশ্চিমি ওষুধের দৃষ্টিতে পরীক্ষা করা, দ্বিতীয়ত, মেডিক্যাল স্কুল, কলেজ এবং ডিসপেনসারিতে সেগুলি পৌঁছে দেওয়া, এবং দেশজ ওষুধের পক্ষে দাঁড়িয়ে ইওরোপিয় ওষুধের আমদানি কমিয়ে দেওয়া।
তৃতীয় ও শেষ পর্যায়ে পশ্চিমি ফার্মাকোপিয়ায় বিশ্বাসযোগ্য(প্লসিবল) গুরুত্বপূর্ণ দেশজ ওষুধের প্রবেশ ঘটল। এর সঙ্গে সঙ্গে দেশজ ঔষধের বাজার ধ্বসে গেল এবং বিংশ শতকের তৃতীয় শতাব্দে ইওরোপিয় ওষুধ ভারতের বাজার দখল করে নিল।
দেশজ চিকিৎসক
উনবিংশ শতকের প্রথম দিকে বাংলায় দেশজ চিকিতসকেদের নিয়োগের পদক্ষেপ নেওয়া হয়। আর্নল্ড ১৮৩০ সালে ১০-১৫ জন, ১৮৪৪এ ৩০ এবং ১৮৫০এ ৬৮ জন টিকাদারের নাম তালিকাভুক্ত করছেন। বৈদ্যরা পশ্চিমি ওষুধ প্রাচারে কাজ করেছেন।
১৬৮০ সালে দেশজ চিকিতসকেদের চিকিৎসার কাজে ব্যবহার করতে বিভিন্ন প্রকল্প প্রস্তাবিত হয়। উদাহরণস্বরূপ, সিলেটে যেহেতু প্রথাগত চিকিৎসার সুযোগ খুব সীমিত, তাই জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেট প্রস্তাব দিলেন সেখানে অঞ্চলে অঞ্চলে হাসপাতাল বা ক্লিনিক চালু না করে দেশজ চিকিৎসক যাদের নাম কবিরাজ তাদের উন্নয়ন ঘটালে কাজ হতে পারে। এই চিকিৎসকেরা নতুন শিক্ষা বা চিকিৎসা কেন্দ্র তৈরি করে পশ্চিমি চিকিতসকেদের থেকে নতুন শিক্ষা গ্রহন করতে পারে। শিক্ষার্থীদের খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু ওষুধ দেওয়া ছাড়াও তাদের শল্য চিকিতসায় হাত পাকাবার জন্য কিছু যন্ত্রও দেওয়া যেতে পারে। এই ধরণের কেন্দ্রে মানুষেরা পশ্চিমি চিকিৎসা পেলে তার ওপরে জনগণের আস্থা আসতে পারে। ভারত সরকারের সচিব এইচ বেল অফিসিয়েটিং কমিশনারকে লেখা এক চিঠিতে লেখেন, দেশিয় কবিরাজদের ব্যবহারে যদি সাফল্য আসে, তাহলে তারা পশ্চিমি চিকিৎসার জ্ঞান প্রচারে সাহায্য করতে পারে। সরকারের উদ্দেশ্য দেশজ ওষুধ এবং দেশজ চিকিৎসক ব্যবহার করে পশ্চিমি চিকিৎসার প্রচার ও প্রসার। এই প্রস্তাব সরকারের অনুমোদন পায়। ধনবান ভারতীয় এবং ইওরোপিয়রা যৌথভাবে এই ধরণের ডিসপেনসারি তৈরিতে অর্থ বরাদ্দ করবে এবং সরকার বাহাদুর কর্মী, যন্ত্রপাতি এবং ওষুধ দেবে। দেশজ চিকিতসকেদের মাসিক মাইনে স্থির হল ৪০ টাকা এছাড়া ঠিক হল ওষুধ এবং অন্যান্য খরচ ডিস্পেন্সারি কমিটি বহন করবে। এই প্রস্তাব সরকারের অনুমোদন লাভ করেছিল এই তথ্যটুকু ছাড়া আদৌ বাস্তবায়িত হয়েছিল কি না তা জানি না।
পশ্চিমি চিকিৎসার সঙ্গে জুড়ে দেশজ চিকিৎসার প্রসারে ১৮৬১ সালে উর্দুতে রোগের পরিভাষা এবং বর্গীকরণ প্রকাশিত হয়। সরকারি নির্দেশে এই বইগুলি জেল এনগ ডিস্পেনসারি, ব্রিটিশ এবং দেশিয় সেনাদের মধ্যে বিতরিত হয়৮০।
ভারতের অন্যনায় অঞ্চলে দেশজ চিকিতসকেদের ব্যবহার সফলভাবে কার্যরী হয়। যেমন মেজর মার্সার পাঞ্জাবের শিয়ালকোটে একটা প্রকল্প চালু করেন, প্রত্যেক জেলায় প্রধান হেকিমের তত্ত্বাবধানে নির্বাচিত সহকারী হেকিম দিয়ে গ্রামচিকিতসালয়(ডিসপেনসারি) চালান। নদিয়া জেলার কমিশনার সরকারকে এই ধরণের প্রকল্প রূপায়নে প্রস্তাব দেয়। একই প্রসাতব কিন্তু বাংলার লেফটানেন্ট গভর্নর অনুমোদন করেন নি।
(চলবে)
No comments:
Post a Comment