পুনম বালা
প্রস্তাবিত পরিকল্পনায় এই ওষুধগুলি বিক্রি করতে চিকিৎসক এবং অচিকিতসকেদের নিয়োগের পরিকল্পনা হল। জেলার মেডিক্যাল অফিসার এবং তার অধস্তন আর জমিদারদের জুড়ে এই কাজটা সম্পাদন করার পরিকল্পনা করল সরকার। ত্রাণের বা অন্যান্য কাজে কিন্তু বাংলার কবিরাজদের যুক্ত করেন নি লেফটানেন্ট জেনারেল। দেশজ ওষুধ ব্যবহার ছাড়া দেশজ চিকিৎসকের সাহায্য নিতে এবং তাদের সাহায্য করতে অস্বীকার করেন তিনি।
ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতাল বেছে নেওয়া হল এই প্রকল্পের মুখড়া হিসেবে ১৮৬৯এর শেষের দিকে। সেখানে সিভিল সার্জেন এবং আরেকজন যোগ্য সহকারী সিভিল সার্জেন, এনাটমি, সার্জারি, মেটিরিয়া মেডিকা এবং ছোটখাট শল্য চিকিৎসা নিয়ে বক্তৃতা দেওয়া শুরু করেন। তিন বছরের শিক্ষানবিশী কাল শেষে উত্তীর্ন ছাত্রদের প্রস্তাব দেওয়া হয়, হয় তারা কম্পাউণ্ডার বা নিচুস্তরের দেশিয় চিকিৎসক হিসেবে সরকারি চাকরি করতে পারে অথব গ্রামে ফিরে গিয়ে চিকিৎসা করতে পারবে। এই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য যেহেতু গ্রামীন দেশিয় রোগ্রাক্রান্তদের সাহায্য করার জন্য তাই ভারতের ব্রিটিশ জনগনকে সাহায্য করতে স্নাতকদের গ্রামে যেতেই উতসাহ দেওয়া হল। আর মহামারীর প্রকোপ হলে এই চিকিৎসকেরা সরকারের হয়ে কাজ করতেন।
১৮৭৩ সালে গ্রামের কবিরাজ, কম্পাউন্ডারদের সরকারি ডিসেপেনসারিতে প্রশিক্ষণ দিয়ে কাজে লাগানোর নতুন এক পরিকল্পনা পেশ করেন বর্ধমানের জেলা শাসক মেটকাফ। তার উদ্দেশ্য ছিল জ্বরাক্রান্ত বর্ধমানের জেলাগুলিতে তাদের ব্যবহার করা। প্রশাসনের দুটিস্তরের মতভেদে এই প্রস্তাবটাও চাপা পড়ে যায় – প্রথম দপ্তরটি আইন সংক্রান্ত, যেখানে মেটকাফ নিজেই চাকরি করতেন এবং আরেকটি স্বাস্থ্য সংক্রান্ত যেখানে বাংলার হাসপাতালগুলির ডেপুটি ইনপেক্টর জেনারেল ড জি স্যান্ডার্স কাজ করতেন। স্যান্ডার্স, মেটকাফের প্রস্তাবের পাল্টা দিয়ে বললেন কবিরাজদের বাংলার প্রেসিডেন্সির বিভিন্ন প্রান্ত থেকের জোগাড় করে তাদের বর্ধমানের সিভিল সার্জেনের তত্ত্বাবধানে জ্বর, পেটখারাপ, পাতলা পায়খানা ইত্যাদি রোগের নিশ্চিত এবং যথেষ্ট পরিমান ওষুধ বর্ধমানে তৈরি করিয়ে চিকিৎসা করতে সাহায্য করতে হবে। প্রত্যেক প্যাকেটের গুলি, গুঁড়ো এবং মিকচারের গায়ে কম্পাউন্ডারের নির্দেশে দেশিয় ভাষায় ব্যবহারের নির্দেশ দেওয়া থাকবে। তবে তিনি স্পষ্ট বলেন চিকিতসায় কম্পাউন্ডারের জ্ঞানের ওপর নির্ভর করা চলবে না৮৯।
এই নীতিই দুটি প্রকল্পের মধ্যে পার্থক্য ঘটিয়ে দিয়েছিল। বোস এবং স্মিথ একদিকে যেমন দেশিয় চিকিতসকেদের পশ্চিমি ঔষধে শিক্ষিত করিয়ে কাজে লাগাবার কথা ভাবছিলেন অন্যদিকে সান্ডার্সের প্রকল্পে দেশিয় চিকিৎসকেরা কম্পাউন্ডার, সহায়ক, সাহায্যকারী মাত্র। আগের প্রকল্পে পশ্চিমি দৃষ্টিভঙ্গীতে দেশজ চিকিতসার গুনাগুন চিহ্নিত করে সেই জ্ঞানকে ব্যবহার আর দ্বিতীয় প্রকল্পে তাদের জ্ঞানকে ব্যবহার করে তাদের সাহায্যকারী হিসেবে রেখে দেওয়া।
তার পরের কয়েকটি প্রস্তাবে দেশিয় চিকিতসকেদের ব্যবহারের কথা উঠেছিল। ১৯০৭ সালে দিল্লিতে এক বৈঠকে স্থানীয় প্রশাসনে য়ুনানির হেকিম এবং আয়ুর্বেদিয় বৈদ্যদের কাজে লাগানোর নতুন করে প্রস্তাব ওঠে। ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল সার্ভিসের ডিরেক্টর জেনারেল জি বমফোর্ড লেফটানেন্ট গভর্নরের প্রস্তাব গ্রহন করে বৈদ্য আর হেকিমদের কাজে লাগানোর শর্ত কমিশনারদের হাতে ছেড়ে দিলেন। এবং পুরসভা আর পঞ্চায়েতে তাদের কাজের মাসিক বেতন ১৫টাকা থেকে বেড়ে হল ২২টাকা।
উনবিংশ শতের শেষের দিকে এবং বিংশ শতকের প্রথম দিকে তিন ধরণের চিকিৎসক ব্রিটিশ বাংলায় দেখা যেত, প্রথম দলের মানুষ হলেন নিজের শেকড়ে দাঁড়িয়ে থেকে দেশিয় চিকিৎসার গোঁড়া সমর্থন, যারা শেষ দিন পর্যন্ত নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে ব্যবসা করে গেছেন। দ্বিতীয় শ্রেণীর মানুষেরা হলেন পশ্চিমি চিকিতসাব্যবস্থায় চিকিৎসা করা ইওরোপিয় আর দেশিয় চিকিৎসকবৃন্দ। আর্নল্ডের ভাষায় তারা নিজেদের ব্যবস্থার বাইরে সব কিছুকে ফেলনা দাবি করেন। আর তৃতীয় শ্রেণীর দেশিয় চিকিৎসকেরা পশ্চিমি চিকিৎসাবিদ্যার দৃষ্টিতে নিজেদের চিকিতসাবিদ্যার গবেষণা এবং প্রচার প্রসার ঘটানো। এই কাজে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় দেশজ চিকিৎসাবিদ্যা বিষয়ে গবেষণা আর জ্ঞানচর্চা ছিল তৃতীয় শ্রেণীর মানুষদের কাজের বিকাশের মৌল ভিত্তি। তারা ১৯১৭-১৮ সালে একটি পৃথক আয়ুর্বেদিক বোর্ড তৈরি করার দাবি জানান তাহলেই তাদের মনে হয় আয়ুর্বেদ বিষয়ে নির্দিষ্ট ধরণের গবেষণার পদক্ষেপ গ্রহন করা যাবে। তাদের বিশ্বাস বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্ত্বাবধানে যদি এই ধরণের গবেষণা করা যায়, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় সংক্রান্ত উপাধি পাওয়া সহজ হবে। এই ধরণের কাজ কবিরাজ যামিনীভূষণ রায় বাস্তবায়িত করতে উদ্যোগী হয়ে ওঠেন। ১৯১৬-১৭ সালে অষ্টাঙ্গ আয়ুর্বেদিয় কলেজের স্থাপনা করে পশ্চিমি চিকিৎসাবিদ্যা পড়াবার মত করে পাঠ্যক্রম তৈরি করেন তিনি। এর কুড়ি বছর পরে দেশে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন তুঙ্গে ওঠায় ভারতীয় চিকিৎসাবিদ্যায় স্টেট মেডিক্যাল ফেসিলিটিগুলি গড়ে ওঠে।
সারাংশ
দেশিয় এবং পশ্চিমি, এই দুই ধরণের চিকিৎসাবিদ্যা শুধু যে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষনায় বেড়ে উঠেছিল তা যেমন ঠিক, তেমনি দুটি চিকিৎসা, নিদান দেওয়ার তাত্ত্বিক অবস্থানের মিলের জন্যও এই বিকাশ হয়েছিল এটাও বলা দরকার। ঠিক সেই জন্য প্রথম দিকে একটি অন্যটির প্রতিস্পর্ধী হয়ে ওঠে নি। এর ফলে দেশজ ওষুধ বিষয়ে গবেষণা বৃদ্ধি পায় এবং দেশজ চিকিতসকেদের চাকরি হয়।
কিন্তু বিদেশিয় ভাষায় বিদ্যাদান দেশিয় চিকিৎসা বিকাশে প্রতিবন্ধকতা খাড়া করে। ব্রিটিশ রাষ্ট্রের অনুমোদনক্রমে ইংরেজি মাধ্যমে দেশিয় চিকিৎসাবিদ্যা পড়ানো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। দুই চিকিৎসা ব্যবস্থার মধ্যে বিপুল ফারাক তৈরি করার পিছনে যেমন সাম্রাজ্যবাদী তাত্ত্বিকদের বড় অবদান ছিল, তার সঙ্গে জুড়েছিল বাড়তে থাকা বড় পুঁজির বিনিয়োগে রসায়ন এবং ওষুধ শিল্পের দ্রুত কেন্দ্রিভবন ঘটতে থাকা আর ব্রিটেনে চিকিতসাবিদিদেরন বাড়তে থাকা পেশাদারিত্বও। একবিংশ শতের দ্বিতীয় শতে ভারতীয়রাও ভাবতে শুরু করে যে এই পার্থক্যটা হয়ত আর ঘোচানো সম্ভব নয়। এই পার্থ্যক্যটা কিভাবে বিভিন্ন স্তরীয় পেশাদারিত্বের জন্য ঘটল সেটা আমরা পরের অধ্যায়ে আলোচনা করব।
(চলবে)
No comments:
Post a Comment