জগদীশ নারায়ণ সরকার
৪। গড়গাঁও ধরে রাখার লড়াই
বাদুলি ফুকন এবারে গড়গাঁও অবরোধের পথে হাঁটলেন। এই শিবিরে মীর জুমলা উপস্থিত না থাকলেও, এখানে সাম্রাজ্যের সম্পত্তি, রসদ, পশু, গোলাবারুদ এবং কিছু যুদ্ধ নৌকোও রয়েছে, তাই এই শিবিরের নিরাপত্তা আঁটসাঁট করে রেখেছেন তিনি। ১৪ জুন তিনি ফারহাদ খানের নেতৃত্বে একটি বাহিনী পাঠালেন মীর মুর্তাজার নিরাপত্তাকে জোরদার করার জন্য। ১৬টি জলবা আর ১৮ খাসাকে তৈরি রাখা হল, বাগানের পশ্চিমে শত্রুর কাটা পরিখা বোজানো হল, শহরের উত্তরপশ্চিম প্রান্তে দিখুর তীর পর্যন্ত বাঁশের কেল্লা তৈরি হল, বিভিন্ন দিকে প্রয়োজনীয় টহলদার মোতায়েন করা হল। অসমের চাচনি গ্রাম থেকে মুসলমান বন্দুকবাজ দিয়ে উত্তরের দিকে নিরাপত্তা বিধান করা হল।
রাজধানীতে পরপর কয়েকটি রাত জুড়ে আক্রমন চালিয়ে গেল অহোমেরা। ৮ জুলাই, উত্তরের বাঁশের বেড়ার পিছনে নিরাপত্তায় বাকসারিয়া বন্দুকবাজদের খতম করে দুর্গের অর্ধেকটা দখল করে নিল তারা। দুর্গের ভিতর থেকে প্রবল প্রতিরোধ হওয়ায় এই আঘাত সামলে নিল মুঘলেরা। তার ভুল বুঝতে পেরে পরের দিন বাঁশের দেওয়ালের বদলে মাটির দেওয়ালের প্রতিরোধ গড়লেন সেনাপতি। এক হপ্তার মধ্যে কয়েকটি বুরুজ দিয়ে একটি বিশাল চওড়া দেওয়াল তৈরি হয়ে গেল। গড়গাঁওএর নিরাপত্তা বিধানে মীর জুমলা এই দেওয়ালের খুব প্রশংসা করেছিলেন। অহোমদের রাতের আক্রমন চলতেই থাকল, কিন্তু যুদ্ধে আসত অসুস্থ ফারহাদ সারা রাত নিজে পাহারায় থাকলেন। মীর জুমলা অহোম বন্দুকবাজদের থেকে ডাঙ্গা নালার মুখের সেতু পাহারা দেওয়ার জন্য প্রত্যেক রাতে ২০০জনের বাহিনী নিয়োগ করেছিলেন, তারা নিজের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য না দেখে গোটা রাজধানীর নিরাপত্তায় নজর রাখত। তারা সারা রাত জেগে থেকে ভোরে মথুরাপুরে ফিরে যেত।
ফরহাদ মীর জুমলার আস্থার পরিপূর্ণ প্রতিদান দিলেন। ১২ তারিখ রাতে চারদিক থেকে চারটি বাহিনী রাজধানী আক্রমন করায় ফারহাদের রণিনীতিতেই বেঁচেছিল সৈয়দ সালারের দারিয়াবাদী বাহিনী গণহত্যার হাত থেকে। তিনি শহরের মাঝে দাঁড়িয়ে যুদ্ধের জন্য প্রয়োজনীয় রদস মুহুর্মুহু চার দিকে পাঠাবার ব্যবস্থা করছিলেন। শিহাবুদ্দিন তালিশ লিখছেন, একমাত্র তার বাহিনীরই পরাক্রমে উত্তরপশ্চিমে আহোমদের আক্রমন থেকে শহরটি বেঁচেছিল।
গড়গাঁওএর ভবিষ্যৎ চিন্তা করে উদ্বিগ্ন মীর জুমলা রাতদিন ‘দূরের গোলমালের দিকে কান খাড়া’ করে রেখেছিলেন। সুউচ্চ কাঠের মিনারে দাঁড়িয়ে গড়গাঁওতে আগুণ দেখা যাচ্ছে কিনা তার নিরাপত্তা কর্মীরা লক্ষ্য রাখতেন। শাহাবুদ্দিন তালিশকে তিনি বলেছিলেন, ‘সকালের নামাজের পরে সবাইকে ধন্যবাদ দিয়ে আমি পাতা কার্পেটের ওপরেই ঘুমোতাম। সেখানেই আমার সারা রাত দিন কাটত।’
১৫, ১৬, ১৮ জুলাই অহোমিয়ারা নতুন করে আক্রমন শানাল। কিন্তু গড়ের নিরাপত্তা ভাঙতে পারল না। অসুস্থ, আহত ফারহাদের জায়গায় মীর জুমলা রশিদ খানকে দায়িত্বে দিলেন। গড়গাঁওএর চারপাশের কাটা পরিখাগুলি, বিশেষ করে কাকুজানের(২৩ জুলাই) রশিদ খান নিজে ঝটিকা আক্রমন করে বুজিয়ে দিলেন তাঁর পরাক্রম অহোমদের। দিল্লি নদীর পাশে কাটা পরিখা থেকে নিজেদের সরিয়ে নিল অহোমবাহিনী এবং দাঙ্গা নদী পেরিয়ে চলেও গেল। বহুকাল পরে গড়গাঁওতে শান্তি ফিরে এল।
রণঅক্লান্ত ফুকন তার ব্যার্থতাগুলি বুঝতে পারলেন। রাতের আক্রমন, রসদের ওপর আঘাত বা মুঘল শিবিরের ওপর আক্রমনেও মুঘল বাহিনীর সেনাপতির মনোবলে চিড় ধরল না। হয় নিজের উদ্যোগে বা রাজার নির্দেশে ফুকন শান্তি প্রস্তাব দিলেন(জুন-জুলাই) দিলির খানের মধ্যস্থতায়। মীর জুমলা খুব কিছু কঠিন শর্ত দিলেন, যাতে তাকে অহোমেরা দুর্বল না ভাবে - রাজাকে প্রথম দাঁত কাটা ৫০০ হাতি দিতে হবে, ৩০ লাখ তোলা সোনা আর রূপো দিতে হবে, রাজার মেয়েকে সম্রাটের হারেমে পাঠাতে হবে, প্রথম দাঁত ওঠা ৫০টা মদ্দা যুদ্ধ হাতি বার্ষিক উপহার হিসেবে দিতে হবে, এবং রাজা শুধু নামরূপ এবং তার আশেপাশের পাহাড়গুলি দখল রাখতে পারবেন। মীর জুমলার দূত খ্বাজা ভুর মলকে ফুকনকে জানালেন তিনি মুঘল বাহিনিতে যোগ দিতে ইচ্ছুক যদি রাজা এই শান্তি প্রস্তাব না মানেন। মীর জুমলা মথুরাপুর থেকে বড়গাঁওএর দিকে রওনা হলেন ১৭ আগস্ট মহামারীর আশংকায়। অহোমেরা শান্তিশর্ত বাতিল করল।
৫। মথুরাপুর আর গড়গাঁওএর মুঘল শিবিরে মহামারী এবং মন্বন্তরের প্রকোপ
আগস্টে মথুরাপুরে মহামারী আক্রমন করল মুঘল শিবিরে। এবং সেটি অহোমদেরও ছাড় দিন না। মীর জুমলার ভাইপো সহ দুইতৃতীয়াংশ সেনা মারা গেল। অহোমদের প্রায় ২৩ লক্ষ লোক মারা গেল। মৃতদের ঠিকভাবে পোড়ানো বা কবর দেওয়াও গেল না। ব্রহ্মপুত্রর জলে হাজারে হাজারে মৃতদেহ ভাসতে লাগল এবং জল অপেয় দূষিত হয়ে গেল, লাখাউএর মুঘল সেনাকে ফুটিয়ে সেই জল খেতে হত।
মীর জুমলার পক্ষে শিবিরে মজুদ চাল বা অন্যান্য রসদ না নিয়ে মহামারীতে ভোগা শিবির ছেড়ে যাওয়া মুশকিল। কিন্তু গতায়াতের অসুবিধের জন্য সেগুলি নিয়ে যাওয়া যাবে না। কিন্তু মহামারীর সঙ্গে শুরু হল খাবারের অপ্রতুলতা। ১৭৩টা ধানের গোলার মধ্যে মাত্র ১৬টা বন্যার জলের বা শত্রুর লুঠের থেকে বাঁচানো গিয়েছিল। এর মধ্যে ৬টা পশুদের জন্য আর ১০টা মানুষের জন্য বরাদ্দ করে দিলেন মীর জুমলা। লাল, মোটা চাল খেতে হল সক্কলকে। প্রথমের দিকে গরুর মাংস জলে ফুটিয়ে খাওয়া, তার পরে লুঠ করা ষাঁড়গুলির চর্বিতে গরুর মাংস ফুটিয়ে, তার পরে ঘোড়ার, উট এবং হাতির মাংস খাওয়া শুরু হল। দৈনন্দিনের চাল, লাল, তেল, ঘি, মিষ্টি, আফিম, তামাক বা নুনের উভাব দিনের পর দিন বাড়তে বাড়তে শিবিরের সেনারা পাগলপারা হতে থাকে। ঘি বিক্রি হতে থাকল ১৪টাকা সের, ছোলার দাম উঠল ১টাকা সের। আফিমের তোলার দাম উঠল ১টি সোনার মোহর, এক ছিলিম তামাকের দাম উঠল ৩টাকা, মুগডাল আর নুন পাওয়া যেত একযোগে ১০টাকা সের। মহম্মদ বেগ মীর বক্সী যাদের তামাক অতি প্রয়োজন সেনাদের দিয়ে দিলেন, নিজের আফিম খাওয়ার মাত্রা কমিয়ে দিলেন।
মথুরাপুরে জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠল। ১৭ আগস্ট সন্ধ্যায় প্রাসাদে নামাজ সেরে বিপুল বর্ষার মধ্যে শিবির ছেড়ে পরের দিন ভোরে গড়গাঁও পোঁছলেন মীর জুমলা। কয়েকটি সাঁজোয়া গাড়ি রাস্তায় কাদায় আটকে রয়ে গেল। দিলির খান সেগুলি উদ্ধার করে ১৮ তারিখ সন্ধ্যায় নিয়ে আসেন। নির্দেশ সত্ত্বেও গুদামের তিন চতুর্থাংশ ধান নিয়ে আসা গেল না। বহু অসুস্থ সেনাও শিবিরে ছেড়ে আসতে।
কোন সাফল্য ছাড়া অহোমদের গড়গাঁওতে রাতের আক্রমন চলতে থাকে। মীর জুমলা তার সেনানায়ককে ঠিক সময় সৈন্য পাঠাতে পারেন। ১৫ সেপ্টেম্বর চাঁদনি রাতের আক্রমনে আবুল হাসান এবং রাজা সুজন সিং আহোমদের এমনভাবে পর্যুদস্ত করে যে তারা আর তার পরে আক্রমন শানাবার কথা ভাবে নি।
মারী আক্রান্ত মথুরাপরের উদ্বাস্তুরা গড়গাঁও এসে পৌঁছলে, মন্বন্তর আর মহামারী একসঙ্গে আক্রমন করে মুঘল বাহিনীকে। বমি আর দাস্ত একসঙ্গে চলতে লাগল... শরীর জলশূন্য হয়ে গেল...মরণ যেন ধন্বন্তরী...তার কোলে টেনে নেয়...লাল মোটা চাল আর গাছের লাল পাকা লেবু ছাড়া সব ধরণের খাদ্যদ্রব্যের অভাব ঘটতে লগল...লালচালের ভাত খেলেই কম্প দিয়ে জ্বর আসতে লাগল...। গরীবেরা গাছের পাতা মাঠের ঘাস বা নদীর ধারের শাকপাতা খেতে লাগল। তার জন্য বরাদ্দ মীর জুমলা দিয়ে দিলেন সৈন্যদের। ঐতিহাসিক মহম্মদ মুনিম তাব্রেজি, অসুস্থদের শুশ্রূষা করতে করতে মারা গেলেন।
৬। অসমে মুঘল নৌবহর
দুর্দশার মাসগুলোয় মুঘল নৌবাহিনী নিজেদের বাঁচিয়ে রাখে এবং সেনাদের সাহায্যও করে। বর্ষায় মীর জুমলার থেকে সংযোগ চ্ছিন্ন হয়ে গেলেও লাখাউতে নৌবাহিনী প্রধান ইবন হুসেন তার সৈন্যদের মানসিকতা উত্তেজকর বক্তৃতা দিয়ে উঁচু তারে ধরে রেখেছিলেন। আলি বেগের নেতৃত্বে একটি নৌবহর গজপুরে পাঠানো হয়। কিন্তু জলের টানে বাঁশবাড়ি (দেওলগাঁও আর গজপুরের মাঝে) পর্যন্ত ফিরে আসতে হয়। সেখানে যোগ দেন মুনাবার খান। তারা তামুলি দলাইএর থেকে দুটি জাহাজ উদ্ধার করে লাখাউতে ফিরে আসে। আলি বেগ অন্য একটা অচেনা জলপথে গড়গাঁওতে মীর জুমলার সঙ্গে মিলিতে যাবার কথা ভাবলেও সেই পরিকল্পনা দেওলগাঁওএর থানেদার য়াদগার খান বাতিল করায়।
লাখাউ ছিল মন ভেঙ্গে যাওয়া মুঘলদের শেষ ভরসাস্থল। মীর জুমলা নৌসেনাকে বার্তা পাঠালেন যে সেনাদের জন্য আলাদা করে না ভেবে তাদের জন্য যেন তারা রসদ পাঠাব্র ব্যবস্থা করে। এবং কালিয়াবর, সমধারা এবং দেবলগাঁও থেকে বাহিনী নিয়ে লাখাউতে জড়ো করার নির্দেশ দেন।
৭ জুলাই ইবন হুসেন মীর জুমলাকে নৌ বহরের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত না হওয়ার কথা বলেন। কিন্তু সমধারা আর কালিয়াবরের থানা তুলে নেওয়ার প্রতিবাদ জানায়, তার ফলে বাংলার সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে। তবে তিনি দেবলগাঁওএর থানা তুলে নেন কেননা এটি দখল করতে মাজুলি থেকে ভিটারুল ফুকন এগোচ্ছিলেন। তিনি বাঁশের কেল্লা পরিখা তৈরি করে ফুকনের রাত আক্রমণের প্রতিষেধক প্রতিরক্ষা সাজান, এবং গুয়াহাটির সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে চলেন। এক সময়ে লাখাউ পশ্চিম, দক্ষিণ এবং উত্তর থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। কিন্তু ব্রহ্মপুত্রের উত্তর তীরের স্থানীয় চাষীদের থেকে প্রচুর ধান জোগাড় করলেন এবং শোলাগড়ে(লাখাউ এবং কালিয়াবরের মধ্যে) অকারণে বহু অহোমকে হত্যা করেন। ভয় পেয়ে বহু চাষী তাদের নেতাকে ধরয়ে দিয়ে মুঘলদের কাছে আত্মসমর্পন করেন(৫ আগস্ট) এবং পশ্চিম দিকের বার্তাবিনিময়ের রাস্তাটি তারা সুরক্ষা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেন। কালিয়াবর হয়ে লাখাউ থেকে গুয়াহাটির মধ্যে বার্তা লেনদেনের রাস্তার সুরক্ষা নিশ্চয় হয়ে যায়। মৃত শ্বশুর সৈয়দ নাসিরুদ্দিনের স্থলে সৈয়দ হুসেন কালিয়াবরের থানাদার হলেন(১২ আগস্ট) আর সমাধায় মৃত সৈয়দ মির্জার স্থলাভিষিক্ত হলেন কিসান সিং। ইবন হুসেন দেশটি ধরে রাখার সমস্ত রকমের চেষ্টা করলেন, কেননা তিনি জানেন মুহূর্তের অসতর্কতায় চরম বিপদ ঘটে যেতে পারে এবং তার সেনাবাহিনীর মনোবল ভেঙ্গে যেতে পারে।
গড়গাঁওতে মুঘল সেনার হাতে পর্যুদস্ত হয়ে অহোমেরা নৌ বাহিনীর ওপরে আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেয়। ভিটারুয়াল ফুকনের লাখাউতে এবং অন্যন্য থানায় রাতের আক্রমন ব্যর্থ হয়। তবে অসমিয়াদের গণহারে হত্যালীলা চালিয়ে গেলেন ইবন হুসেন। ভয়ে ভীত রায়তেরা চিঙ্গুলাং লুথুরি দায়াঙ্গিয়া রাজখোয়া এবং বুড়াগোহাঁইকে ধরিয়ে দিলেন মুঘল নৌ সেনাধ্যক্ষ্যের কাছে। লাখাউ আর গড়গাঁওএর মাঝে অহোম বিদ্রোহীদের হারানোর জন্য মুঘলদের সাহায্য করতে থাকে সাধারণ প্রজারা। প্রজাদের অসন্তোষে ভিটারুল ফুকনকে দেবলগাঁও থেকে মাজুলি দ্বীপের রাঙ্গালি চাপরিতে পালিয়ে যেতে হয়। এবারে ইবন হুসেন দেবলগাঁওতে নতুন করে থানা তৈরি করে মীর জুমলার কাছে দু’দন অহোমের মার্ফত এই খুশির খবর পাঠালেন(৫ সেপ্টেম্বর)। এদিকে তামুলি দলাই বাঁশবাড়িতে হারার পরে পালিয়ে যায়। গজপুর এবারে মুঘলদের দখলে এল।
(চলবে)
No comments:
Post a Comment