Friday, January 27, 2017

বাংলা যখন বিশ্ব সেরা৬৮ - লাইফ অব মীর জুমলা, জেনারেল অব আওরঙ্গজেব

জগদীশ নারায়ণ সরকার

নিজাম হিসেবে মীর জুমলা বাঙলা প্রশাসনে অব্যাহত একনায়কতন্ত্র চালাতেন। বিহার আর ওডিসার প্রশাসন তিনি কিছুটা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছেন। ১৬৬০-৬১সালে পাটনার দেওয়টান লুতফুল্লা বেগ রাষ্ট্রের রাজস্ব বাড়াবার জন্য সোরা ব্যবসা দখলের চেষ্টায় ডাচেদের সঙ্গে যে সব মধ্যসত্ত্বভোগীরা কাজ করত তাদের নির্দেশ দিলেন সমস্ত সোরা রাষ্ট্রকে জমা দিতে। হুগলীর ডাচ কুঠিয়াল ভ্যান্ডেনব্রোক, মীর জুমলা এবং ব্রিটিশদের অভিযোগ করে বলেন যে এই কাজটি পাটনার ব্রিটিশ কুঠিয়াল চেম্বারলেইন আর দালাল গঙ্গারামের ষড়ে হয়েছে, গঙ্গারাম দেওয়ানকে সমস্ত সোরা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, এবং ব্রিটিশেরা দেওয়ানের থেকে সোরা কিনে নেবে(বলা দরকার সেই সময় পাটনার বিপুল পরিমাণ সোরা কিনত ডাচেরা - অনুবাদক)। এর উত্তরে ব্রিটিশ কুঠিয়াল ত্রেভিসা সরাসরি বললেন তিনি দেওয়ানের এই চুক্তিতে সায় দিচ্ছেন না, বরং সোরা কেনা ব্যবস্থায় ডাচেদের সঙ্গে রয়েছেন এবং তারা সরাসরি দালালদের থেকে সোরা কিনবেন বরাবরের মত। মীর জুমলা পরওয়ানা দিয়ে লুতফুল্লাকে ডাচেদের বিরুদ্ধে যেতে বারণ করলেন।

নিজাম হিসেবে মির জুমলার কোন সহকারী ছিল না, তাহলে হয়ত কিছু প্রশাসনিক দায়িত্ব ভাগ করে দিতে পারতেন। ১৬৫৯এর বসন্তে মীর জুমলা বাঙলার দখল নিশ্চিন্ত করে ইস্তিয়াখ খানকে অস্থির ওডিসার দায়িত্ব দিলেন। মনে হয় এই সময়েই রাষ্ট্রীয় ফরমান বলে মীর জুমলা খালসা রাজস্ব না মেটানোর অভিযোগে ওডিসার রাজা নীলকান্ত দেবের তুয়ুল দখল নেন কিন্তু কাশিজোড়া মহালের সরকার গোয়ালপাড়ার কুতুবপুরের মদদইমাশ জমি ভোগ করা শেখ আবদুল খয়ের স্বত্ব বজায় রাখলেন। ওডিসার দেওয়ান হবিসেবে খানইদৌরানের পদের মাধ্যমে মীর জুমলা কিছুটা হলেও ওডিসার ওপর দখলদারি বজায় রেখে ছিলেন। অসম অভিযানের ঠিক আগে ওডিসা থেকে রাজমহল পর্যন্ত ডাকচৌকি বসানো হল, কিন্তু তার সময়টা জানা যায় নি। রাজমহল হয়ে বাঙলা ওডিসার রাজস্ব একযোগে দিল্লিতে পাঠানো হত।

হিজলির বিদ্রোহী জমিদার বাহাদুর খানকে দমন করতে খানইদৌরানকে ব্যবহার করেন মীর জুমলা। বাহাদুর খান সুজার কারাগার থেকে পালিয়ে গিয়ে নতুন করে তার ক্ষমতা পুনরুদ্ধার করেন। ইওরোপিয় কুঠির নথি বলছে মীর জুমলা এটি দখল করতে ডাচ, ব্রিটিশ, পর্তুগিজদের থেকে জাহাজ দাবি করেন। তবে ওডিসার প্রধান হিসেবে খানইদৌরানের পদপ্রাপ্তিতে এই অভিযানের পরিকল্পনা কিছু দিনের জন্য স্থগিত থাকে। শেষ পর্যন্ত মীর জুমলা সম্রাটকে প্রভাবিত করে ওডিসা বাঙলার প্রশাসনের অন্তর্ভূক্ত করেন, ব্রিটিশ স্লুপ আর ডাচ গ্যালিয়ট নিয়ে হিজলি দখল করেন। বাহাদুরের ভাই কমল খান নিহত হয়। ৬ মে বাহাদুর এবং তার ১১ জন সাথীকে গ্রেফতার করে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়।

আরাকানের রাজা মীর জুলমার দখল করা তার কিছু রাজত্বের অংশ চেয়ে পাঠিয়ে একটি উদ্ধত চিঠি দেয়। মীর জুমলা তার অভিযোগ খারিজ করে একটি যুক্তিপূর্ণ চিঠি এবং কিছু সামান্য উপহার পাঠান। সুজাকে আরাকান থেকে নিয়ে আসার জন্য তিনি ডাচেদের ওপরে চাপ দিলেন। মগেদের অত্যাচার চরমে উঠলে মীর জুমলা সম্রাটকে জানান যে খিজিরপুরের আগের মুঘল আধিকারিক মগেদের আক্রমণের ভয়ে পালিয়ে থাকতেন। শীতের পরে যখন মগেদের অক্রমণের ঝাঁঝ কমত, তখন ঢাকার সুবাদার তার সেনা নিয়ে সেখানে যেতেন। মগদের অত্যাচার বন্ধ করার জন্য মীর জুমলা কিছু পরিকল্পনা করেন। তবে সেটি রূপায়িত করার কথা ভাবেন কোচবিহার অভিযানের পরই।
কোচবিহার-অসম আক্রমণের আগে তিনি বাংলায় কিছু প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। রাজমহলের দেওয়ান হিসেবে কাজ করতে থাকেন মুখলিস খান, ওডিসার দায়িত্ব ছেড়ে আসার পর তিনি ইস্তিশান খানকে ঢাকা সুরক্ষায় খিজিরপুরের দায়িত্ব দিলেন। সাম্রাজ্যের দেওয়ান রায় ভগবতী দাস এবং খ্বাজা ভগবান দাস সুজায়িকে সাম্রাজ্যের আর্থ ব্যবস্থা দেখাশোনা করার পাশাপাশি বাংলায় মীর জুমলা সরকারের একই বিভাগ দেখাশোনা করার দায়িত্ব দেন। দক্ষ, চতুর এবং কর্মঠ হিসেবে বর্ণিত ঢাকার আধিকারিক মহম্মদ মুকুম নাওয়ারার(নৌবাহিনী) দায়িত্ব এবং মীর গাজিকে খাজাঞ্চি এবং খবর-লেখকের(গোয়েন্দা) দায়িত্ব দেন।

মীর জুমলা যখন অসম অভিযানে যান তখন দুবছর ধরে বাংলায় চরম দুর্ভিক্ষ চলেছিল। জাকাত দানের সমান চালের দাম উঠেছিল। চৌকিদার, রাহদারের(শুল্ক আধিকারিক) অত্যাচারে এবং আভ্যন্তরীণ গোলযোগের জন্য ব্যবসায়ীদের গতায়াত বন্ধ হয়ে যায়। তালিশ সে সময়ের মানুষের অবর্ণনীয় সমস্যার ওপর আলোকপাত করেছেন, ‘মানুষের জীবন রুটির চেয়েও শস্তা, অথচ দেশের কোথাও রুটি পাওয়া যেত না’। এই দুর্ভিক্ষের প্রভাব পড়েছিল অসমে মুঘল শিবির মথুরাপরের ওপরেও। লাখুতে মুঘল নৌবাহিনীর জন্য কোন ত্রাণ পাঠানো সম্ভব হয় নি। অসমে বাহিনীর খাবার অভাব দূর করতে তিনি অসমের দিহিং নদীতে দখল করা ১২০০০ মণ চাল শিবিরে পাঠাতে নির্দেশ দেন। মীর জুমলার প্রশাসক উত্তরসূরী দাউদ খান জাকাতের সম্পূর্ণ দান জনগণের জন্য উন্মুক্ত করে দেন, তাতে কিছুটা দর্ভিক্ষের প্রকোপ প্রশমিত হয়।

সুজার সময় থেকে বাঙলার প্রশাসনিক কিছু সংস্কার করার প্রয়োজন হলেও মীর জুমলা সেগুলি করার সুযোগ পান নি। মীর জুমলার মৃত্যুর পর সাময়িকভাবে দায়িত্বপ্রাপ্তর পক্ষে এটি রূপায়ন করা সম্ভব হয় নি এবং দুর্যোগ আরও গভীরতর হয়। শায়েস্তা খান বাঙলার নবাব(সুবাদার) হয়ে বেশ কিছু যোগ্য প্রতিবিধান করে এই বিশৃঙ্খলতা মেটান। মীর জুমলার যে কটি অর্ধসমাপ্ত কাজ তিনি সমাধা করেন, তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণটি ছিল নৌবাহিনীকে নতুন করে গড়ে তোলা। যে সব পরগণাকে নৌবাহিনীর দেখাশোনা করার জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল বার্ষিক ১৪ লক্ষ টাকার বিনিময়ে, সুজার সময়ে তার গাছাড়া মনোভাবের জন্য, সারা বাঙলা জুড়ে গোলযোগ চলার জন্য এবং রাজস্ব আদায়কারীদের অত্যাচারের জন্য এই অর্থ তোলা যায় নি, নৌবাহিনী। মীর জুমলার পদপ্রাপ্তির ফারমানে আওরঙ্গজেব, ইব্রাহিম খানের নীতি অনুসরণ করে নৌবাহিনীকে নতুন করে গড়ে তোলার সমস্ত চেষ্টা চালানোর নির্দেশ দেন। নৌবাহিনীকে নতুন করে গড়ে তুলতে নৌবাহিনীর পুরোনো ব্যবস্থাপনা বদলাবার কথা ভাবেন, কিন্তু নতুন ব্যবস্থাটি চালু করার আগেই তাকে কোচবিহার-অসম অভিযানে যেতে হয়। এই অভিযানে প্রচুর নৌসেনাপতি মারা যায় এবং গোটা নৌ বাহিনী ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ে। ইবন হুসেইন পদত্যাগ করলে মহম্মদ বেগকে এর দায়িত্ব দিয়ে তার গুণগত মান, সংখ্যা এবং অবস্থা সমীক্ষাপত্র জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। নৌ বাহিনীর পতনের ফলে বাংলায় মগ এবং পর্তুগিজ হার্মাদদের অত্যাচার বাড়তে থাকে। ১৬৬৪ সালে নৌবাহিনীর দায়ত্বে থাকা সদরইসৈরাব মুনাওয়ার খান ‘কয়েকটি ভাঙা ঝুরঝুরে নৌকো’ সম্বল করে তাদের মুখোমুখি হতে না পেরে পালিয়ে যান। পরে সায়েস্তা খান এসে সামগ্রিক নৌবহর গড়ে তোলেন।
(চলবে)

No comments: