জগদীশ নারায়ণ সরকার
২। মীর জুমলার দোগাছিতে প্রথম প্রত্যাঘাত
নতুন যুদ্ধ নাট্যশালায় দুর্বিপাক উপস্থিত দেখে নিশ্চুপ না থেকে মীর জুমলা তাঁর বিরুদ্ধ পরিবেশটি পাল্টানোর চেষ্টা করতে লাগলেন আন্তরিকভাবে। রাজমহল(১৩ এপ্রিল) পুনর্দখল করার পরে তাঁর প্রথম কাজ হল যুদ্ধ নৌকো জোগাড় করার চেষ্টা করা, কেননা জলযান ছাড়া এই পরিস্থিতিতে এক পাও এগোন যাবে না। প্রায় একপক্ষকাল ধরে দূর দূর এলাকায় খোঁজ করে বেশ কিছু জলযান জোগাড় হল।
নৌকো ছাড়া কিছুই করা যাবে না বুঝে, রাজমহলে সময় নষ্ট না করে তিনি আরর ১৩ মাইল দক্ষিণে দোগাছির দিকে এগোলেন শাহজাদাকে নিয়ে ১৪ এপ্রিল। সেখানে তিনি শিবির ফেললেন। সেখানে নদীর মধ্যের চরে শত্রুর বিপক্ষ পাড়ে একটা উঁচু ভূমি ছিল। উল্টো দিকে বাকারপুরে সুজার সেনাপতি সৈয়দ কুলি গোলান্দাজ বাহিনী নিয়ে শিবির করে ছিলেন আর সুজা স্বয়ং নদীতে যুদ্ধ ডিঙ্গি করে টহল দিচ্ছিলেন। তাঁর মনে হল এই এলাকার রণনৈতিক গুরুত্ব অপরিসীম, কিন্তু তাঁর সঙ্গে যেহেতু তখনও কোন ডিঙ্গি নেই, সেহেতু সুজার বাহিনী এক রাতে সেটি দখল করে নিয়ে সেখানে গোলান্দাজ বাহিনী বসিয়ে দিয়ে বিপক্ষের ওপরে গোলাফেলার পরিকল্পনা করতে থাকে।
হাতে কয়েকতা ডিঙ্গি এলে মীর জুমলা সেগুলি নির্ভর করে সেই চরটি দখল করতে সুজার বাহিনীর ওপর আক্রমণ করা, সম্ভব হলে নদী পেরিয়ে সরাসরি সুজার বাহিনীর ওপরে হামলা চালাবার সিদ্ধান্ত নিলেন। রাত-জুড়ে ছোট ছোট বাহিনীতে ভাগ হয়ে মীর জুমলার দক্ষ ব্যবস্থাপনায় এবং ব্যক্তিগত নির্দেশে নৌকো করে ২০০০ পদাতিক, কিছু সেনানী - জুলফিকার, ফতে জং, রশিদ খান আনসারি, লোদি খান, সুজন সিং বুন্দেলা, তাজ নিয়াজি সহ অন্যান্য অনুগামী ২০০ বেলদার এবং কড়েকটি কামান নিয়ে চরে ঘাঁটি গাড়লেন। পরের দিন সকাল হতে না হতেই সুজার বাহিনী বিপক্ষকে দেখতে পেয়ে জোর আক্রমন চালালেও তাদের ছেড়ে যাওয়া চরে মীর জুমলার বাহিনী ঘাঁটি গাড়তে সক্ষম হয়।
পরের দিক সুজার বাহিনীর সেনানী ফিদায়ি খান তাঁর সমগ্র নৌ বহর নিয়ে মীর জুমলার গোটা বাহিনীর ওপর জোরদার আক্রমন শানান। দুপক্ষের গোলাগুলিতে নদী দুপাশ ধোঁয়ায় ধোঁয়ায় ভরে যায়। ধোঁয়ার আড়ালে তিনি চরের এক দিকে উঠে এলে তাকে আক্রমন শানান তাজ নিয়াজী এবং তাঁর আফগান যোদ্ধারা। কিছু সময়য় ধরে সমানে সমানে তালে তাল ঠোকা চলল দুপক্ষের। তীরে বসে এই হাতাহাতি লড়াই দেখতে দেখতে মীর জুমলা লড়াইয়ের ফল, সর্বশক্তিমানের ইচ্ছের ওপর ছেড়ে দিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত সুজার বাহিনী পিছু হঠতে বাধ্য হয় এবং তাদের কয়েকটি ডিঙ্গি ডুবেও যায়। তাঁর পরেও আরও একটি বিশাল যুদ্ধের পর, যেখানে কামানে কামানের গর্জনে জলের মাছগুলিও অস্থির হয়ে উঠছিল, রণকৌশলগত দিক থেকে চরটি মীর জুমলার বাহিনী সুরক্ষিতভাবে দখল করতে সক্ষম হয়।
৩। সুতিতে মীর জুমলার নৌঅভিযান
বাস্তবে মীর জুমলার প্রথম আঘাতটি যদিও ডাকাবুকোর মত হয়ত হঠাত হঠকারীর মত মনে হতে পারে কিন্তু গভীরে দেখলে যথেষ্ট পরিকল্পনা মাফিক। তিনি নৌকো জোগাড় করেন প্রায় বিদ্যুতগতিতে। সুজার বিরুদ্ধে তিনি প্রথম লড়াইতে জিতলেন কেননা সুজার নিজের নৌবাহিনীর গরিষ্ঠতা এবং দক্ষতার ওপর আত্মসন্তুষ্টি এবং মীর জুমলার নৌ বাহিনীতে তাচ্ছিল্যের ভাব এসে গিয়েছিল, এবং মীর জুমলার এই হতচকিত আক্রমণকেও বিন্দুমাত্র দূরদৃষ্টিতে দেখতে পান নি সুজা। এই হারে সুজা শিক্ষা নিয়ে নতুন করে আক্রমন শানাতে কোমর বাঁধলেন। তাঁর নৌবহর রাজমহল থেকে দেওগাছির মধ্যে টহল দিলেও, রাজমহলে যেখানে নদী সবথেকে চওড়া, সেই রাজমহলে তিনি সব থেকে বেশি গোলান্দাজ নৌকোর টহল চালালেন। ফলে মীর জুমলা বুঝলেন হাতে মাত্র কয়েকটি নৌকো আর নোকোয় ভাসমান কামান নিয়ে ছোট ছোট বাহিনীতে ভাগ হয়ে ওপারের তীরে গিয়ে সদা জাগ্রত বাহিনীকে গেরিলা আক্রমণের রণনীতি এখন আর সফল হবে না। এবং দীর্ঘ লড়াইএর পরেও বিপক্ষের বাহিনীকে এই ধরণের যুদ্ধে তাঁর পক্ষে হারানো সম্ভব হবে না। ফলে অবশ্যম্ভাবীভাবে মীর জুমলাকে রণনীতি পরিবর্তন করতে হল। তিনি সময় নিলেন। উত্তরে রাজমহল থেকে ২৮ মাইল দক্ষিণ পূর্বে সুতির মধ্যের এলাকাটি কয়েকজন বাছা বাছা সেনা নায়কের হাতে ছেড়ে দিলেন; রাজমহলের দায়িত্ব দিলেন মহম্মদ মুরাদ বেগের হাতে, সুজার শিবিরের উল্টোদিকের দোগাছির নেতৃত্ব দিলেন শাহজাদার সঙ্গে জুলফিকার খান এবং ইসলাম খান এবং বিশাল বাহিনীর অধিকাংশ নিয়ে; আরও আট মাইল দক্ষিণে দুনাপুরে আলিকুলি এবং মীর জুমলা নিজে হাজার সাতেক সেনা নিয়ে সুতিতে শিবির করলেন।
সুতিতে মীর জুমলার নিজের ঘাঁটি গাড়া খুব বড় রণনৈতিক পরিকল্পনা ছিল। তার হাতে যথেষ্ট নৌবহর ছিল না। কিন্তু সুতিতে নদীর পরিসর খুবই সরু। স্থানীয়দের থেকে খবর পেলেন এখানে নদী হেঁটে পারাপার হওয়া যায়। এর আগেও তিনি এই রণনীতিতে জিতে এসেছেন। শাহজাদাও মীরের এই প্রস্তাব মেনে নিলেন যে সুজার বাহিনী আর নৌবহরকে নদী পার হতে দেওয়া যাবে না। সেই জন্য এই রণনীতি সক্কলকে জানিয়েও দিলেন। নদীর সমস্ত ফেরি এবং পারাপার হওয়ার রাস্তা বন্ধ হল। এই নিষেধাজ্ঞা এবং নজরদারি এতই কঠিন এবং কড়া করে লাগু হল যে ছিঁচকে চোরেরাও সেই কয় দিন চুপিসাড়েও নদী পার হতে পারে নি, যদি কেউ ধরা পড়ত তাদের নাক কান কেটে ফেলা হত।
শিবির ফেলার পরের দিন মীর জুমলা নদী পার হওয়ার চেষ্টা করলেন। কিন্তু নদীর গভীরতা বুঝতে ভুল হয়েছিল তাঁর। তিনি বুঝলেন স্থানীয় মানুষের কথায় তিনি প্রতারিত হয়েছেন। এবং দেখা গেল ১৪ দিন আগে যে জলস্তর ছিল, তা হঠাত বেড়ে গেল। বেশ কিছু ক্ষতি হল, কিন্তু আরও বড় দুর্ঘটনা থেকে অন্তত সেনাবাহিনী বেঁচে গেল।
মীর জুমলা উল্টোদিকে অবস্থান করছে বুঝে সুজা সুতির উল্টোদিকের পাড়ে নুরুল হাসান এবং দুনাপুরের উল্টদিকে ইসফান্দিয়ার মামুরি এবং তাঁর বড় ছেলে জায়িনুদ্দিনকে তাণ্ডায় দায়িত্ব দিলেন, সে তাঁর পরিবারের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে তাদের নিয়ে সেখানে গেল।
মীর জুমলা অতি গোপনে উল্টো দিকের তীরে সেনানী পাঠাবার রণনীতি তৈরি করে যেতে লাগলেন, পরিকল্পনা, কোন একদিন সেখানে গিয়ে তিনি নিজে নেতৃত্ব দেবেন। এই কাজে তাঁর দরকার প্রচুর নৌকো। তিনি পদস্থ আধিকারিকদের হুগলি, কাশিমবাজার বা এই সব এলাকায় যে কোন ধরণের নৌকো – কিস্তি বা ঘুরাবের খোঁজে পাঠালেন। হুঁশিয়ারি দিলেন ব্যর্থ হলে তাঁর পরিবার এমন কি তাঁর দেশকেও তিনি ধুলোয় গুঁড়িয়ে দিতে দ্বিধা করবেন না। হুঁশিয়ারিতে ফল ফলল। ১০ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে তারা শয়ে শয়ে নৌকো জোগাড় করে এনে দিল মীর জুমলাকে। জুলফিকারও তাকে ৪০টি নৌকো দিল। এই নৌকোগুলির সাহায্যে মীর জুমলা সুজার যে কোন আক্রমন আটকাতে পারবেন। ফলে মীর জুমলা পূর্ব তটের ৪০ ৫০ লিগ এলাকা তাঁর নৌবাহিনী নিয়ে টহল দিতে লাগলেন।
পশ্চিম পাড় হাতছাড়া হয়ে গেলে সুজা শত্রুর বাহিনী লক্ষ্য করে গোলা দাগতে ৮টি বিশাল কামান বসালেন। অন্যদিকে মীর জুমলা তাদের ওপর আক্রমণ রুখতে এক রাত্রিতে তিনি ১০ টা নৌকো বোঝাই করে বাছাই সেনা পাঠালেন বিপক্ষের কামান দখল করতে। কিন্তু সেটি সফল হল না। তিনি সময় পরিবর্তন করলেন। পরের দিন দিনে দুপুরে ২০ সেনা পাঠানোর পরিকল্পনা করলেন এবং তাঁর এই পরিকল্পনা অযাচিতভাবে সফল হল। বাতাসে অনুকূলে তর তর করে উজিয়ে গিয়ে হঠাত আক্রমনে বিপক্ষকে হতচকিত করে দিয়ে আটটি কামান এবং ব্যাটারিগুলি কোন ক্ষয় ক্ষতি ছাড়াই তুলে নিয়ে এল।
(চলবে)
No comments:
Post a Comment