জগদীশ নারায়ণ সরকার
৩। বাংলায় মীর জুমলার আর্থনৈতিক এবং বাণিজ্যিক কাজকর্ম
কর্ণাটকের মতই বাংলাতেও মীর জুমলার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মূল চরিত্রিটাই হল একচেটিয়া ব্যবসা। বাঙলার সুবাদারির সুবাদে তিনি নানান পণ্য নিজের শর্তে একচেটিয়া কারবারী রূপে কিনে তার শর্তেই সেগুলি বিক্রি করতেন। ১৬৬০ সালে মীর জুমলা ব্রিটিশ কোম্পানিকে তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী সোরা সরবরাহ করার প্রস্তাব দেন। মাদ্রাজের কুঠিয়ালের মন্তিব্য তিনি এই পদক্ষেপটি করেছেন এক্কেবারে ব্যক্তিগত লাভের জন্য। সেই সময়ে পাটনার ব্রিটিশ কুঠিয়ালকে ৩০০০০ থলে(৬০০০ মণ) ধারে সোরা সরবরাহ করেন।
নভেম্বর ১৬৬১ সালের ডাচ নথি থেকে পাচ্ছি মীর জুমলা কী ধরণের দাম চড়াতেন। ঢাকার এক শস্য কারবারির থেকে মীর জুমলা ৫০,০০০ টাকা দাবি করেন, আজকের অর্থনীতিতে এটিকে অতিরিক্ত লাভ্যাংশ কর হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে। ডাচ সূত্রটি জানাচ্ছে মীর জুমলা দাবি করেন, কোচবিহার অসম অভিযানের আগে তার শিবিরে চাল সরবরাহ করে সেই ব্যবসায়ি দ্বিগুণ লাভ করেছেন। তারা ১০০০০ টাকা দিতে চাইলে তিনি নিজের লগুড় চালাতে শুরু করেন, এবং তার ফলে তারা ২৫০০০ দিতে বাধ্য হয়। এধরণের অত্যাচারে ঢাকার এক ব্যাঙ্কার ৩০০০০০ দিতে বাধ্য হয়।
১৬৫৮ সালে হুগলীর দেওয়ান মালিক বেগ ব্রিটিশদের থেকে কাস্টমস শুল্কের জায়গায় বার্ষিক ৩হাজার(জুন ১৬৫৮) টাকা দাবি করে এই যুক্তিতে যে বর্তমানে প্রাক্তন শাসক শাহজাহান আওরঙ্গজেবের হাতে বন্দী ফলে শাহজাহানের জারি করা কোন ফরমানই প্রযুক্ত হবে না। পরের বছর বালেশ্বরের প্রশাসকও বন্দরে জাহাজ ভেড়ানোর বিপুল শুল্ক দাবি করেন। ব্রিটিশ কুঠিয়ালেরা দুটি দাবিই মানতে অস্বীকার করায় দুপক্ষের মধ্য তিক্ততা আরও বাড়তে থাকে। ১৬৬০-৬১ সালে হুগলীর ব্রিটিশ এজেন্ট মীর জুমলার অত্যাচারে ‘অতিষ্ঠ’ হয়ে তার বাণিজ্য নৌবহরের একটি দেশি নৌকো দখল ক’রে তাদের ধার শোধ করার দাবি রূপে। ব্রিটিশদের ব্যবহারে ক্ষিপ্ত মীর জুমলা কুঠিগুলি ধ্বংস এবং মাটিতে মিশিয়ে দিয়ে দেশ ছাড়া করার হুমকি দেন। মাদ্রাজের কর্মকর্তাদের পরামর্শে ত্রেভিসা মীর জুমলার সামনে তাদের কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চেয়ে নেয়। কিন্তু বার্ষিক ৩০০০ টাকার দাবি মীর জুমলা ছাড়েন নি।
প্রত্যেক বছর বিনা শুল্কে ব্রিটিশদের জাহাজে তার পণ্য(যেমন গালা) সম্ভার বিদেশে, বিশেষ করে পারস্যে পাঠানো অভ্যেস করে ফেলেছিলেন মীর জুমলা। গম্ব্রনে ব্রিটিশ কুঠিয়ালকে মাদ্রাজের কুঠিয়াল লিখলেন, যেহেতু মীর জুমলা বাংলায় ক্ষমতায় রয়েছেন, তার পণ্যের ওপরে দেয় কর/শুল্ক না নেওয়াই উচিত। তবে ১৬৬২ সালের মে মাসের ব্রিটিশদের আভ্যন্তরীণ হিসেবে দেখা যায়, মীর জুমলা যা পণ্য পাঠিয়েছেন, তার কর/শুল্ক হিসেব করলে সেটা জাহাজ কাণ্ডে তার প্রাপ্ত অর্থের পরিমান ছাড়িয়ে যাবে বরং এখানে ব্রিটিশেরা মীর জুমলার থেকেই অর্থ পাবেন।
বিনিয়োগের ওপর ভাল সুদ পেয়ে মীর জুমলা ব্রিটিশদের ব্যক্তিগত ব্যবসায় অন্তত ১ লক্ষ ২৫ হাজার টাকা বিনিয়োগ করেছিলেন ত্রেভিসা মার্ফত। সুরাতের কুঠিয়ালদের বিরক্তি সত্ত্বেও বাঙলার এজেন্ট ধার করে বাঙলার পণ্য কেনার নীতি চালিয়ে যান। মাদ্রাজের কুঠিয়ালেরা এই ধরণের ব্যবসায় অভ্যস্ত ছিলেন, কিন্তু ত্রেভিসার ব্যক্তিগতভাবে ঋণ নেওয়াকে মেনে নিতে পারে নি। তাদের আশঙ্কা ছিল এই ঝামেলা আবার তাদের ঘাড়ে এসে না পড়ে। মীর জুমলার মৃত্যুর আগে পর্যন্ত এই ঋণের একটি অংশ ফেরত দেননি ত্রেভিসা। ৯৭০০ বাকি থাকা টাকার মধ্যে ৫৬৭২ টাকা কাশিমবাজার কুঠিয়ালেরা ১৬৬৪ সালের জুন মাসে শায়েস্তা খানকে শোধ করে। ১৬৬৫ সালে এই টাকা দেওয়া নেওয়ার ঝামেলাটির সমাধান হয়।
৪। ইওরোপিয়দের সঙ্গে মীর জুমলার সম্পর্ক(১৬৬০-৬৩)
ব্রিটিশদের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষায় মীর জুমলা চতুরতার সঙ্গে সুবিধাবাদ আর চাপে রাখার নীতির মিলমিশ ঘটয়েছিলেন। তার জাহাজ কাণ্ডকে ব্যবহার করে তিনি চাপ দিয়ে আরাকানে পালিয়ে যাওয়া সুজাকে প্রত্যার্পন করিয়ে আনতে বাধ্য করেছিলেন। মীর জুমলার জাহাজ কাণ্ড সমাধান করতে মছলিপত্তনমের কুঠিয়ালেরা নিজেদের মধ্যে সম্মেলন করে যে সিদ্ধান্ত নেয় তা তাদের প্রধান দপ্তর সুরাটের কুঠিয়ালদের যেমন বিরক্তির কারন হয়েছিল, তেমনি মীর জুমলাও এই সিদ্ধান্তে খুশি হন নি। তিনি যে ২৩০০০ প্যাগোডা দাবি করেছিলেন ব্রিটিশদের মনে হয়েছে তা বেশি, এবং তিনি বকেয়া ঋণের টাকা ৩২০০০ প্যাগোডা চেয়েছিলেন তাও কোম্পানি মেনে নেয় নি। ১৬৬০ সালের মাঝামাঝি অসন্তুষ্ট সুবাদার ব্রিটিশদের কাশিমবাজার কুঠি এবং বঙ্গোপসাগরে তাদের সমস্ত কাজ কর্ম বন্ধ করে দিয়ে ত্রেভিসাকে তার সঙ্গে ঢাকায় বৈঠক করতে নির্দেশ দেন। অগস্ট মাসে একটি ছোট বজরা করে হুগলী থেকে ত্রেভিসা ঢাকার পথে রওনা হন। আগস্টের শেষের দিকে মাদ্রাজের কুঠিয়ালেরা হুগলী কুঠিয়ালদের মীর জুমলার চাহইদা পূর্ণ করে শান্ত করার নির্দেশ দেয় এবং সুজাকে কিভাবে ফেরত আনা যায় তার ব্যবস্থা করারও নির্দেশ দেন। ত্রেভিসার দৌত্য সফল হয়, পাটনার ১৫০০০ মণ সোরা যেগুলি পড়েছিল নবাবের গুদামে সেগুলি উদ্ধার হয় এবং মীর জুমলা সে সময় ব্রিটিশ আর ডাচেদের সুজাকে প্রত্যার্পণে তাকে সাহায্যের নির্দেশ দিলেন।
আওরঙ্গজেবের উদ্বিগ্নতা বুঝে ২৭ অক্টোবর ১৬৬০ সালে ডাচ প্রধান কুঠিয়াল ম্যাথায়াস ভ্যান ডেন ব্রোককে জানান তিনি আরাকান থেকে সুজাকে প্রত্যার্পণে ইচ্ছুক এবং তাকে প্রথমে মুঘল হুগলীতে আনবেন। আর তার এই উদ্যমে সুজা যদি ডাচ জাহাজ করে পারস্য বা মোকায় পালিয়ে যেতে চায়, তা যেন তারা রোখেন। এই কাজটি ডাচেরা করে দিলে ব্রিটিশদের থেকেও বেশি ব্যবসার সুযোগ সুবিধে দেওয়া হবে বলে তিনি প্রতিশ্রুতি দেন।
সামরিক কারণে মীর জুমলা ব্রিটিশ, ডাচ এবং পর্তুগিজ জাহাজ ব্যবহার করেছেন। ত্রেভিসা যে বজরায় করে ঢাকায় এসেছিলেন, তার ইওরোপিয় নাবিকদের তিনি তার বাহিনীতে নিয়োগ করেন। যুদ্ধ জাহাজ তৈরিতে তিনি ব্রিটিশ আর ডাচেদের সাহায্য নেন। হুগলীতে তৈরি একটি ডাচ গ্যালিওট জাহাজকে ব্রিটিশদের থেকে পালিয়ে আসা ক্যাপ্টেন জন ডুরসনের নেতৃত্ব এক নাবিক বাহিনী ঢাকায় নিয়ে যায় ১৬৬১ সালের মে মাসে। টমাস প্রাট নামক একজন ব্রিটিশকে যুদ্ধ জাহাজ এবং তার উপযোগী গোলাগুলি বানানর জন্য মির জুমলা নিয়োগ করেন। কিছু ইওরোপিয় বন্দুকবাজ মীর জুমলার অসম আভিযানে অংশ নিয়েছিল।
মীর জুমলার জীবদ্দশায় জাহাজ কাণ্ডটির সমাধান ঘটে নি যদিও তার মছলিপত্তনমের কর্মী টাপাটাপার কাছে সেই জাহাজটি ফেরত দেওয়ার কথা ব্রিটিশেরা বলেছিল। ১৬৬২ সালে কেড্ডা থেকে মালাক্কায় যাওয়ার সময় বিপুল ঝড়ের সামনে পড়ে সেটি তার কাজের ক্ষমতা হারায়। মীর জুমলাকে শান্ত করতে মাদ্রাজ কুঠিয়ালের সেটির বদলে অন্য একটি জাহাজ প্রতিস্থপনের প্রতিশ্রুতি দেয়, এবং একই সময়ে তারা মছলিপত্তনমের কুঠিয়ালদের, টাপাটাপার উত্তরসূরী আলি বেগকে অবস্থার কথা এবং তাদের বাধ্যবাধকতা বুঝিয়ে বলতে নির্দেশ দেয়। মীর জুমলার মৃত্যুর(ডিসেম্বর ১৬৬৩) পরে ব্রিটিশদের ধারনা হয়, তার পুত্র মহম্মদ আমিন সব ভুলে যাবেন। ১৬৬৫ সালে মাদ্রাজের কুঠিয়ালেরা কোম্পানিকে জানায় যে তখনও পর্যন্ত কোন দাবিদাওয়া ওঠে নি, মৃত নবাবের সব নথিপত্র আওরঙ্গপজেবের কাছে পাঠানো হয়েছে। তারা আশা করছে চুক্তিপত্র উল্লেখ করে ত্রেভিসার মীর জুমলাকে শান্ত করার চিঠিটি একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গিয়েছে। মোটামুটি তাদের মনে হয়েছে জাহাজ পর্ব সমাধা হয়ে গিয়েছে।
(চলবে)
No comments:
Post a Comment