জগদীশ নারায়ণ সরকার
৮। ১৬৫৭-৫৮ সালে বীজাপুর আক্রমণের সময় কর্ণাটক
বীজাপুর আক্রমনে নিজেকে প্রস্তুত করতে করতে তিনি সম্রাটকে বাধ্য করলেন বেটুল নির্ভর বীর পরগণার শাহ বেগ খানকে তাঁর সহায়ক হিসেবে দিতে, যাতে কর্ণাটকে হিন্দুদের জোরালো প্রভাবশালী বিদ্রোহ দমন করা যায় এবং মীর জুমলাকে আক্রমণে পাঠানো হচ্ছে – সুলতানের মাধ্যমে এই বার্তা দিয়ে তিনি দক্ষিণী সুলতানদের রক্ষণাত্মক খোলসে ঢুকিয়ে অতিরক্ত ভয় দেখাবার ব্যবস্থা করলেন। মীর জুমলার প্ররোচনায় আওরঙ্গজেব গোটা বাহিনী জোগাড়ের জন্য বিন্দুমাত্র দেরি না করে, তক্ষুণি হাতে যে বাহিনী রয়েছে(৫০০০ ঘোড়সওয়ার) তা নিয়েই খানকে অভিযানের নির্দেশ দিলেন এবং রাস্তায় মীর জুমলার গোমস্তা কাজি মহম্মদ মহসিনের সঙ্গে যোগ দিতে বললেন। ১৬৫৬ সালের ৩০ নভেম্বর সরফরাজ খান, যদু রায় এবং তাঁর ভাই, জওহর খান এবং উদাচারম – শাহ বেগ বীর থেকে বের হয়ে ইন্দোরে পৌছলেন ১৫ ডিসেম্বর কুতুব শাহের রায়তদের লুঠ আর মীর জুমলার এলাকাগুলিতে রায়তদের ক্ষতি না করে তাঁর মূল গন্তব্যের দিকে রওনা হলেন। উদ্বিগ্ন উজিরকে শান্ত করতে আওরঙ্গজেব তাঁকে কাজির শেষতম ডাক এবং তাঁর সঙ্গে শাহ বেগ খানকে তাঁর নিজের নির্দেশটি – যাঁর কর্ণাটকে পৌছবার তারিখ ছিল ৭ জানুয়ারি, ১৭৫৭, জুড়ে পাঠালেন।
শাহ বেগকে অভিযানে পাঠানো কার্যকর প্রমান হল। আবদুল জাব্বার হায়দ্রাবাদে হঠে এলেন। অভিশপ্ত রয়ালকে আওরঙ্গজেব অকম্মা করে দেন এবং অন্যান্য জমিদার মীর জুমলার কর্ণাটক থেকে বীজাপুরী কর্ণাটকে পালিয়ে গেলেন।
কয়েকটি মহালের রাজস্ব তোলা নিয়ে কুতুব শাহ আর মীর জুমলার আধিকারিকদের মধ্যে ঝগড়া, সীমান্ত নিয়ে গোলযোগ পর্যন্ত পৌঁছল। সুলতান সম্রাটকে অভিযোগ করে বললেন, মীর জুমলা হয় তাঁকে প্রতিশ্রুত বছরে দেয় ৪ লাখ হুণ(কুড়ি লাখ টাকা) দিন, না হয় সম্রাট তাঁকে এল্লোর আর রাজামুন্দ্রির মত কৃষ্ণার দক্ষিণের অঞ্চলের তাঁর জায়গির থেকে বকেয়া উদ্ধার করতে সাহায্য করুণ।
মীর জুমলা তখন দিল্লিতে বীজাপুর আভিযানে সম্রাটের অনুমতি নেওয়ার চেষ্টা করছেন। তিনি তখন(২৬ নভেম্বর ১৬৫৬) উদ্ধার করা পেশকাশের মধ্যে ১৫ লক্ষ টাকা ৯ তাং(২৬ রতি বা ২১৬ সুর্খ) ওজনের বড় হিরে যার দাম ২,১৬,০০০ টাকা সহ অন্যান্য দামি গয়না, ২০টা হাতি – চারটি সোনা আর রূপার শিকলিতে মোড়া উপহার দিলেন। সম্রাট সুলতানকে তাঁর উত্তরাধিকারীদের উদয়গিরি দূর্গ দখল রাখতে নির্দেশ দিলেও মীর জুমলার ক্ষেত্রতে হাত না বাড়াতে নির্দেশ দিলেন। সম্রাট লিখলেন, ‘কর্ণাটকে প্রচুর হিরের খনি রয়েছে... (মুয়াজ্জম)খান আমাকে সেই খনির একটি ৯ তাংএর বড় হিরে উপহার দিয়েছে... তুমি আমায় এ ধরণের পেশকাশ বা উপহার দাও নি। ফলে ঐ এলাকার দায়িত্ব আমি মীর জুমলাকেই দিলাম... তুমি কর্ণাটক আর তাঁর খণিগুলির ওপর তোমার দাবি তুলে নাও। অনভিজ্ঞ মানুষের পক্ষে আদিল শাহ এবং অন্যান্য অবিশ্বাসীর হাত থেকে ঐ এলাকা রক্ষা করা সম্ভব নয়।’ আর যদি সম্রাটের নির্দেশ অমান্য করা হয় তাহলে পাদশাহ প্রস্তাব দিলেন, মুহম্মদ আমিন খানকে বড় বাহিনীর দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়ে তাঁর পিতার জায়গির শাসন এবং জমিদারদের থেকে সেটিকে বাঁচানোর আদেশ দেওয়া হল।
সম্রাটের আদেশে সন্তুষ্ট না হয়ে কুতুব শাহ বীজাপুর অভিযানের সুযোগ নিয়ে কর্ণাটক দখলের পরিকল্পনা করলেন। তিনি আওরঙ্গজেবকে বললেন মীর জুমলার কিছু আধিকারিক কুতুব শাহী এলাকা কাম্বাম এবং উদগির দখল করার চেষ্টা করছে, এবং এই এলাকাগুলি সম্রাট মীর জুমলাকে দিয়েছেন। আওরঙ্গজেব সতর্ক হয়ে শাহ বেগ খানকে বললেন,
১) যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কর্ণাটক পৌঁছন এবং মীরের আদেশের জন্য অপেক্ষা করুণ
২) অভিজ্ঞ এবং সৎ বক্সী এবং ওয়াকিয়ানবিশকে বলা এই বিবাদ মিটিয়ে একটা সমীক্ষা পেশ করতে,
৩) কাজি মহম্মদ হাশিমের সাহায্যে বিষয়টার সমাধান খুঁজতে
৪) আর মীর জুমলার ডাকচৌকিগুলি কর্মক্ষম করতে।
কিন্তু এদিকে মীর জুমলা সম্রাটের সামনে অভিযোগ করে বললেন কুতুব শাহের আধিকারিকেরা কাম্বাম এবং উদগিরের মধ্যের এলাকা দখল করে নিয়েছে, এবং মীর জুমলার কর্ণাটকের জায়গিরের ১৬০ মাইল ভেতরে তাদের সীমান্ত টেনিয়ে এসেছে। এই সংবাদ পেয়ে আওরঙ্গজেব শাহ বেগ খানকে নির্দেশ দিলেন আবদুল মোবাদকে না পাঠিয়ে নিজেই তদন্ত করতে। যদি মীর জুমলার অভিযোগ সত্য হয়, শাহ বাগ যে শুধু সুলতানের কর্মীদের ভর্তসনা করবেন তাই নয়, তাদের তাড়িয়ে দিয়ে দেখবেন, যাতে একটাও কোস গ্রাম সুলতানের অধীনে না থেকে যায়।
১৬৫৭র জুলাইতে দেখা গেল সুলতানের অভিযোগ মিথ্যা, শুধু উদগির নয়, একটাও গ্রাম মীর জুমলার অধিকারে আসে নি। সুলতান শুধু এই অঞ্চলটি দখল করতে মিথ্যা অভিযোগ করেছিলেন এবং সম্রাটের নির্দেশনামা উল্লঙ্ঘন করেছেন। এই সংবাদে আওরঙ্গজেব শাহ বেগকে নির্দেশ দিয়ে বললেন শাহী সেনা কত পরিমান রাজস্ব আদায় করেছে সেই পরিমান জানাতে এবং উদগির ছাড়া সেই গ্রামগুলিতে মীর জুমলার বাহিনীকে বসিয়ে দিতে এবং উদগীর দূর্গে শুধু কেল্লাদারকে রেখে শাহী বাহিনীকে সেই এলাকা ছাড়া করতে।
ইতিমধ্যে শাহজী ভোঁসলা বীজাপুর এবং কর্ণাটকে মুঘল দখলের খবরে কুর্ণুলের হাবসি কিলাদার সিদ্দি জৌহরের সহায়তায় কর্ণাটকের কিছু অংশ দখল করে নেন। কিন্তু মুঘলদের বীজাপুর অভিযানের খবর পেয়ে সিদ্দি তাঁর পাশ থেকে সরে যায় এবং শাহজীর মীর জুমলার বাহিনীর হাতে একের পর এক হার হতে থাকে।
বীজাপুর অভিযান মীর জুমলার কর্ণাটকের ওপর অন্য প্রভাব ফেলল। এর ফলে মাদ্রাজের কাছে থাকা তাঁর বাহিনীর কাছে খাদ্য সামগ্রী পৌছনোর কাজে ব্যঘাত ঘটল – সেই এলাকাটি জমিদারেরা দখল করে নিয়ন্ত্রণ করছিল। মীর জুমলার সেনানায়ক টুপাকি কৃষ্ণাপ্পা নায়ক একটি হঠাত আক্রমণ শানিয়ে রয়ালের লুঠেরা বাহিনীকে পরাস্ত করে। এই গেরিলা আক্রমণে ১০০ বেশি নিহত হয় নি, কিন্তু একি পরাজয়ের ফলে হিন্দুদের মনোবলে জোর আঘাত হানে। রয়াল এবং তাঁর সাহায্যকারী শাহজী জিঞ্জির কাছে বড় দুর্গ আর্নির দু মাইল ভেতরে ঢুকে যেতে বাধ্য হন। তাঁরা বীজাপুরীদের সঙ্গে যোগ দিয়ে বাহিনীর মনোবল বাড়াবার চেষ্টা চালালেও, টুপাকির আবার আক্রমণে তাদের সে প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়।
কর্ণাটকের অবস্থা কিছুটা উন্নতি ঘটলে আওরঙ্গজেব শাহ বেগ খানকে ফিরে আসতে নির্দেশ দিলেন। তিনি কোক্কানুর এবং তাঁরই নির্দেশে গোরুমকোণ্ডায় কাজি মহম্মদ হাশিম এবং অন্যান্য সেনানায়কের নেতৃত্বে একটি বাহিনী রেখে এলেন।
আওরঙ্গজেবের কর্ণাটকের নীতি এবং কর্ম নির্ধারণে মীর জুমলার ভূমিকা খুব কম ছিল না। আওরঙ্গজেব সংক্রান্ত ব্যাপারে তিনি বাস্তবিকই স্নায়ুচাঞ্চল্যে ভুগছিলেন – আমরা আগেই দেখেছি, আওরঙ্গজেবের কর্ণাটকের বিষয়ে কর্মসম্পাদনের আন্তরিকতা নিয়ে তাঁর সন্দেহ অমূলক ছিল, কিন্তু সেই চাঞ্চল্য স্বাভাবিকও ছিল। অকুস্থলে দাঁড়িয়ে আওরঙ্গজেবকে প্রত্যেক (দুঃ)ঘটনায় নতুন নতুন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। আওরঙ্গজেব কিন্তু উজিরকে নিয়ে কিছুটা শঙ্কিতই ছিলেন, কিন্তু তাঁর প্রস্তাব বাস্তবের মাটিতে রূপায়িত করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধান্বিত হননি। মীর জুমলা তাঁকে প্রয়োজনীয় কূটনীতি(যেমন শাহজীরর সঙ্গে সম্পর্ক) এবং সেনাবাহিনী কিভাবে যাবে, আধিকারিকদের কোথায় বদলি করতে বা শাস্তি দিতে(যেমন কাবাদ বেগ) হবে, সেসব বিষয়ে নিয়ত নির্দেশ দিতেন। যেহেতু প্রত্যেকটার সঙ্গে সম্রাটের নির্দেশ জুড়ে থাকত, ফলে তাঁর পক্ষে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কোন সুযোগ ছিল না, বরং মীর জুমলার প্রত্যেকটি সিদ্ধান্ত বাধ্য হয়ে মেনে নিতে হয়েছিল যাতে সম্রাটের প্রিয়পাত্র মীর জুমলা, সম্রাটের বিশ্বাসের পাত্র দারাকে কোণঠাসা করে তাঁর দাক্ষিণাত্যে আগ্রাসী নীতি অনুমোদন করিয়ে নিতে পারেন। এই কাজে মীর জুমলার ছিল অসীম ধৈর্য, অসম্ভব কূটনৈতিক দক্ষতা এবং যোগ্যতা, প্রভাবিত করার ক্ষমতা, দাক্ষিণাত্য বিষয়ে সুনির্দিষ্ট জ্ঞান, এবং সব থেকে বড় কথা অসীম সম্পদ ভাণ্ডার – এই সব জড়ো করে তিনি অন্যান্য দক্ষ আধিকারিকদের টপকে সম্রাটের দাক্ষিণাত্য নীতির বিষয়ে প্রভাবিত করতে পেরেছিলেন। এইসবগুলি বিবেচনা করে দ্বিধাহীনভাবে বলা যায় ১৬৫৬-৫৭ সালের মুঘল সাম্রাজ্যের দাক্ষিণাত্য নীতির মূল মাথা ছিলেন মীর জুমলা।
(চলবে)
৮। ১৬৫৭-৫৮ সালে বীজাপুর আক্রমণের সময় কর্ণাটক
বীজাপুর আক্রমনে নিজেকে প্রস্তুত করতে করতে তিনি সম্রাটকে বাধ্য করলেন বেটুল নির্ভর বীর পরগণার শাহ বেগ খানকে তাঁর সহায়ক হিসেবে দিতে, যাতে কর্ণাটকে হিন্দুদের জোরালো প্রভাবশালী বিদ্রোহ দমন করা যায় এবং মীর জুমলাকে আক্রমণে পাঠানো হচ্ছে – সুলতানের মাধ্যমে এই বার্তা দিয়ে তিনি দক্ষিণী সুলতানদের রক্ষণাত্মক খোলসে ঢুকিয়ে অতিরক্ত ভয় দেখাবার ব্যবস্থা করলেন। মীর জুমলার প্ররোচনায় আওরঙ্গজেব গোটা বাহিনী জোগাড়ের জন্য বিন্দুমাত্র দেরি না করে, তক্ষুণি হাতে যে বাহিনী রয়েছে(৫০০০ ঘোড়সওয়ার) তা নিয়েই খানকে অভিযানের নির্দেশ দিলেন এবং রাস্তায় মীর জুমলার গোমস্তা কাজি মহম্মদ মহসিনের সঙ্গে যোগ দিতে বললেন। ১৬৫৬ সালের ৩০ নভেম্বর সরফরাজ খান, যদু রায় এবং তাঁর ভাই, জওহর খান এবং উদাচারম – শাহ বেগ বীর থেকে বের হয়ে ইন্দোরে পৌছলেন ১৫ ডিসেম্বর কুতুব শাহের রায়তদের লুঠ আর মীর জুমলার এলাকাগুলিতে রায়তদের ক্ষতি না করে তাঁর মূল গন্তব্যের দিকে রওনা হলেন। উদ্বিগ্ন উজিরকে শান্ত করতে আওরঙ্গজেব তাঁকে কাজির শেষতম ডাক এবং তাঁর সঙ্গে শাহ বেগ খানকে তাঁর নিজের নির্দেশটি – যাঁর কর্ণাটকে পৌছবার তারিখ ছিল ৭ জানুয়ারি, ১৭৫৭, জুড়ে পাঠালেন।
শাহ বেগকে অভিযানে পাঠানো কার্যকর প্রমান হল। আবদুল জাব্বার হায়দ্রাবাদে হঠে এলেন। অভিশপ্ত রয়ালকে আওরঙ্গজেব অকম্মা করে দেন এবং অন্যান্য জমিদার মীর জুমলার কর্ণাটক থেকে বীজাপুরী কর্ণাটকে পালিয়ে গেলেন।
কয়েকটি মহালের রাজস্ব তোলা নিয়ে কুতুব শাহ আর মীর জুমলার আধিকারিকদের মধ্যে ঝগড়া, সীমান্ত নিয়ে গোলযোগ পর্যন্ত পৌঁছল। সুলতান সম্রাটকে অভিযোগ করে বললেন, মীর জুমলা হয় তাঁকে প্রতিশ্রুত বছরে দেয় ৪ লাখ হুণ(কুড়ি লাখ টাকা) দিন, না হয় সম্রাট তাঁকে এল্লোর আর রাজামুন্দ্রির মত কৃষ্ণার দক্ষিণের অঞ্চলের তাঁর জায়গির থেকে বকেয়া উদ্ধার করতে সাহায্য করুণ।
মীর জুমলা তখন দিল্লিতে বীজাপুর আভিযানে সম্রাটের অনুমতি নেওয়ার চেষ্টা করছেন। তিনি তখন(২৬ নভেম্বর ১৬৫৬) উদ্ধার করা পেশকাশের মধ্যে ১৫ লক্ষ টাকা ৯ তাং(২৬ রতি বা ২১৬ সুর্খ) ওজনের বড় হিরে যার দাম ২,১৬,০০০ টাকা সহ অন্যান্য দামি গয়না, ২০টা হাতি – চারটি সোনা আর রূপার শিকলিতে মোড়া উপহার দিলেন। সম্রাট সুলতানকে তাঁর উত্তরাধিকারীদের উদয়গিরি দূর্গ দখল রাখতে নির্দেশ দিলেও মীর জুমলার ক্ষেত্রতে হাত না বাড়াতে নির্দেশ দিলেন। সম্রাট লিখলেন, ‘কর্ণাটকে প্রচুর হিরের খনি রয়েছে... (মুয়াজ্জম)খান আমাকে সেই খনির একটি ৯ তাংএর বড় হিরে উপহার দিয়েছে... তুমি আমায় এ ধরণের পেশকাশ বা উপহার দাও নি। ফলে ঐ এলাকার দায়িত্ব আমি মীর জুমলাকেই দিলাম... তুমি কর্ণাটক আর তাঁর খণিগুলির ওপর তোমার দাবি তুলে নাও। অনভিজ্ঞ মানুষের পক্ষে আদিল শাহ এবং অন্যান্য অবিশ্বাসীর হাত থেকে ঐ এলাকা রক্ষা করা সম্ভব নয়।’ আর যদি সম্রাটের নির্দেশ অমান্য করা হয় তাহলে পাদশাহ প্রস্তাব দিলেন, মুহম্মদ আমিন খানকে বড় বাহিনীর দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়ে তাঁর পিতার জায়গির শাসন এবং জমিদারদের থেকে সেটিকে বাঁচানোর আদেশ দেওয়া হল।
সম্রাটের আদেশে সন্তুষ্ট না হয়ে কুতুব শাহ বীজাপুর অভিযানের সুযোগ নিয়ে কর্ণাটক দখলের পরিকল্পনা করলেন। তিনি আওরঙ্গজেবকে বললেন মীর জুমলার কিছু আধিকারিক কুতুব শাহী এলাকা কাম্বাম এবং উদগির দখল করার চেষ্টা করছে, এবং এই এলাকাগুলি সম্রাট মীর জুমলাকে দিয়েছেন। আওরঙ্গজেব সতর্ক হয়ে শাহ বেগ খানকে বললেন,
১) যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কর্ণাটক পৌঁছন এবং মীরের আদেশের জন্য অপেক্ষা করুণ
২) অভিজ্ঞ এবং সৎ বক্সী এবং ওয়াকিয়ানবিশকে বলা এই বিবাদ মিটিয়ে একটা সমীক্ষা পেশ করতে,
৩) কাজি মহম্মদ হাশিমের সাহায্যে বিষয়টার সমাধান খুঁজতে
৪) আর মীর জুমলার ডাকচৌকিগুলি কর্মক্ষম করতে।
কিন্তু এদিকে মীর জুমলা সম্রাটের সামনে অভিযোগ করে বললেন কুতুব শাহের আধিকারিকেরা কাম্বাম এবং উদগিরের মধ্যের এলাকা দখল করে নিয়েছে, এবং মীর জুমলার কর্ণাটকের জায়গিরের ১৬০ মাইল ভেতরে তাদের সীমান্ত টেনিয়ে এসেছে। এই সংবাদ পেয়ে আওরঙ্গজেব শাহ বেগ খানকে নির্দেশ দিলেন আবদুল মোবাদকে না পাঠিয়ে নিজেই তদন্ত করতে। যদি মীর জুমলার অভিযোগ সত্য হয়, শাহ বাগ যে শুধু সুলতানের কর্মীদের ভর্তসনা করবেন তাই নয়, তাদের তাড়িয়ে দিয়ে দেখবেন, যাতে একটাও কোস গ্রাম সুলতানের অধীনে না থেকে যায়।
১৬৫৭র জুলাইতে দেখা গেল সুলতানের অভিযোগ মিথ্যা, শুধু উদগির নয়, একটাও গ্রাম মীর জুমলার অধিকারে আসে নি। সুলতান শুধু এই অঞ্চলটি দখল করতে মিথ্যা অভিযোগ করেছিলেন এবং সম্রাটের নির্দেশনামা উল্লঙ্ঘন করেছেন। এই সংবাদে আওরঙ্গজেব শাহ বেগকে নির্দেশ দিয়ে বললেন শাহী সেনা কত পরিমান রাজস্ব আদায় করেছে সেই পরিমান জানাতে এবং উদগির ছাড়া সেই গ্রামগুলিতে মীর জুমলার বাহিনীকে বসিয়ে দিতে এবং উদগীর দূর্গে শুধু কেল্লাদারকে রেখে শাহী বাহিনীকে সেই এলাকা ছাড়া করতে।
ইতিমধ্যে শাহজী ভোঁসলা বীজাপুর এবং কর্ণাটকে মুঘল দখলের খবরে কুর্ণুলের হাবসি কিলাদার সিদ্দি জৌহরের সহায়তায় কর্ণাটকের কিছু অংশ দখল করে নেন। কিন্তু মুঘলদের বীজাপুর অভিযানের খবর পেয়ে সিদ্দি তাঁর পাশ থেকে সরে যায় এবং শাহজীর মীর জুমলার বাহিনীর হাতে একের পর এক হার হতে থাকে।
বীজাপুর অভিযান মীর জুমলার কর্ণাটকের ওপর অন্য প্রভাব ফেলল। এর ফলে মাদ্রাজের কাছে থাকা তাঁর বাহিনীর কাছে খাদ্য সামগ্রী পৌছনোর কাজে ব্যঘাত ঘটল – সেই এলাকাটি জমিদারেরা দখল করে নিয়ন্ত্রণ করছিল। মীর জুমলার সেনানায়ক টুপাকি কৃষ্ণাপ্পা নায়ক একটি হঠাত আক্রমণ শানিয়ে রয়ালের লুঠেরা বাহিনীকে পরাস্ত করে। এই গেরিলা আক্রমণে ১০০ বেশি নিহত হয় নি, কিন্তু একি পরাজয়ের ফলে হিন্দুদের মনোবলে জোর আঘাত হানে। রয়াল এবং তাঁর সাহায্যকারী শাহজী জিঞ্জির কাছে বড় দুর্গ আর্নির দু মাইল ভেতরে ঢুকে যেতে বাধ্য হন। তাঁরা বীজাপুরীদের সঙ্গে যোগ দিয়ে বাহিনীর মনোবল বাড়াবার চেষ্টা চালালেও, টুপাকির আবার আক্রমণে তাদের সে প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়।
কর্ণাটকের অবস্থা কিছুটা উন্নতি ঘটলে আওরঙ্গজেব শাহ বেগ খানকে ফিরে আসতে নির্দেশ দিলেন। তিনি কোক্কানুর এবং তাঁরই নির্দেশে গোরুমকোণ্ডায় কাজি মহম্মদ হাশিম এবং অন্যান্য সেনানায়কের নেতৃত্বে একটি বাহিনী রেখে এলেন।
আওরঙ্গজেবের কর্ণাটকের নীতি এবং কর্ম নির্ধারণে মীর জুমলার ভূমিকা খুব কম ছিল না। আওরঙ্গজেব সংক্রান্ত ব্যাপারে তিনি বাস্তবিকই স্নায়ুচাঞ্চল্যে ভুগছিলেন – আমরা আগেই দেখেছি, আওরঙ্গজেবের কর্ণাটকের বিষয়ে কর্মসম্পাদনের আন্তরিকতা নিয়ে তাঁর সন্দেহ অমূলক ছিল, কিন্তু সেই চাঞ্চল্য স্বাভাবিকও ছিল। অকুস্থলে দাঁড়িয়ে আওরঙ্গজেবকে প্রত্যেক (দুঃ)ঘটনায় নতুন নতুন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। আওরঙ্গজেব কিন্তু উজিরকে নিয়ে কিছুটা শঙ্কিতই ছিলেন, কিন্তু তাঁর প্রস্তাব বাস্তবের মাটিতে রূপায়িত করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধান্বিত হননি। মীর জুমলা তাঁকে প্রয়োজনীয় কূটনীতি(যেমন শাহজীরর সঙ্গে সম্পর্ক) এবং সেনাবাহিনী কিভাবে যাবে, আধিকারিকদের কোথায় বদলি করতে বা শাস্তি দিতে(যেমন কাবাদ বেগ) হবে, সেসব বিষয়ে নিয়ত নির্দেশ দিতেন। যেহেতু প্রত্যেকটার সঙ্গে সম্রাটের নির্দেশ জুড়ে থাকত, ফলে তাঁর পক্ষে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কোন সুযোগ ছিল না, বরং মীর জুমলার প্রত্যেকটি সিদ্ধান্ত বাধ্য হয়ে মেনে নিতে হয়েছিল যাতে সম্রাটের প্রিয়পাত্র মীর জুমলা, সম্রাটের বিশ্বাসের পাত্র দারাকে কোণঠাসা করে তাঁর দাক্ষিণাত্যে আগ্রাসী নীতি অনুমোদন করিয়ে নিতে পারেন। এই কাজে মীর জুমলার ছিল অসীম ধৈর্য, অসম্ভব কূটনৈতিক দক্ষতা এবং যোগ্যতা, প্রভাবিত করার ক্ষমতা, দাক্ষিণাত্য বিষয়ে সুনির্দিষ্ট জ্ঞান, এবং সব থেকে বড় কথা অসীম সম্পদ ভাণ্ডার – এই সব জড়ো করে তিনি অন্যান্য দক্ষ আধিকারিকদের টপকে সম্রাটের দাক্ষিণাত্য নীতির বিষয়ে প্রভাবিত করতে পেরেছিলেন। এইসবগুলি বিবেচনা করে দ্বিধাহীনভাবে বলা যায় ১৬৫৬-৫৭ সালের মুঘল সাম্রাজ্যের দাক্ষিণাত্য নীতির মূল মাথা ছিলেন মীর জুমলা।
(চলবে)
No comments:
Post a Comment