জগদীশ নারায়ণ সরকার
৫। মীর জুমলার সঙ্গে আওরঙ্গজেবের রণনীতি বিষয়ে মন্ত্রণা
ঠিক সময়ে উজির দাক্ষিণাত্যে পৌছতে না পারার জন্য দাক্ষিনাত্যের সুবাদারের পক্ষে বীজাপুর অভিযানের সময় সঙ্কুচিত হয়ে আসছিল এবং তিনি আদৌ সম্রাটের নির্দেশ পালন করতে পারবেন কি না সে সম্বন্ধে সন্দিহান হয়ে পড়ছিলেন।
আদিল শাহের মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর তার দেওয়া জবাব এবং মীর জুমলাকে দাক্ষিণাত্যে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়ার পূর্বে সম্রাটের পরিষ্কার নির্দেশ ছিল, আওরঙ্গজেব মীর জুমলাকে সঙ্গে বীজাপুরের দিকে রওনা হয়ে যাবেন এবং সেই দেশ দখল করে নেবেন। না করতে পারলে আওরঙ্গজেব শুধু নিজামশাহীর(বিজাপুর থেকে ১৫৩৬ সালে আলাদা হওয়া) অধিকারের অংশটুইকুই দখল করবেন, বীজাপুরকে বাৎসরিক রাজস্বের বদলে তার স্বাধীনতা বজায় রাখবেন, সেখান থেকে তিনি গোলকুণ্ডা দখলে যাবেন, যে রাজ্য বীজাপুরের থেকেও সহজে জয় করা যায়। জ্যোতিষীরা আওরঙ্গজেবের বীজাপুরের দিকে যাওয়ার দিনক্ষণ ধার্য করেছিল ৮ জানুয়ারি। কিন্তু ডিসেম্বর পর্যন্ত জানা যায় নি বীজাপুর না গোলকুণ্ডা, কোনটা আগে মীর জুমলা আক্রমণ করতে চাইছেন। সম্রাটের দেওয়া আর আওরঙ্গজেবের চাহিদা মত সময়ে যে মীর জুমলা আওরঙ্গজেবের বাহিনীর সঙ্গে যে মিলতে পারছেন তা পরিষ্কার হয়ে যায়। আওরঙ্গজেবের মনে হচ্ছিল যে দেশ দখলের যে অবশ্যম্ভাবী যোগটা তৈরি হয়েছে সেটা না হাতছাড়া হয়ে যায়। তিনি প্রথমে বীজাপুর দখল করে, কুতুব শাহকে দেখে নেওয়ার পরিকল্পনা করে তার হাত থেকে মীর জুমলার অধিকৃত কর্ণাটক ছিনিয়ে নেওয়ার কথা ভেবেছিলেন। তাঁর মতে গোলকুণ্ডা যে কোন সময়েই দখল নেওয়া যায়। ১১ এবং ১৪ ডিসেম্বরের মীর জুমলার দুটি চিঠির উত্তরে আওরঙ্গজেব লিখলেন, এ বিষয়ে(আক্রমণের রণনীতি) উজিরের মত তিনি জানতে উতসুক, তা তার পরিকল্পনা রূপায়নে সাহায়তা করবে। যদি মীর জুমলা তাঁকে প্রস্তাব দেন যে প্রথমে বীজাপুর অভিযান করে – পুরো বা আংশিক দেশটা দখল করে এবং সুলতানের থেকে বিপুল পরিমান ক্ষতিপূরণ চেয়ে তারপরে গোলকুণ্ডা দখল এবং তার পরে হয় সেই বছরে বা পরের বছরে কর্ণাটকের দিকে এগোনো যাবে – তাহলে আওরঙ্গজেব তার মস্তিষ্ককে বিশ্রাম দিয়ে সঠিক দিনক্ষণ মিলিয়ে বীজাপুরের দিকে অগ্রসর হতে পারেন।
সম্রাটের অনিশ্চয় অবস্থায় যে আওরঙ্গজেব বিপদে পড়েছেন সেটা তিনি মীর জুমলাকে স্পষ্টতই জানিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু তিনি একা এই অভিযানে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে চাইছিলেন না। ঠিক করলেন, যতক্ষণ মীর জুমলা এসে না পড়েন, ততক্ষণ তিনি শিকার(বীজাপুর সীমান্তে রামদোয়ায়) করেই বেড়াবেন, এবং সঠিক সময়ে উজির এসে পড়লে অভিযানের দিন ঠিক করবেন। ১৬৫৭ সালের মধ্য জানুয়ারিতে তিনি জানতে পারলেন যে মীর জুমলা ১৮ তারিখে এসে পড়ছেন এবং তিনি এলেই অভিযানের পথ ঠিক হবে। আওরঙ্গজেবের প্রস্তাব ছিল যে তাঁদের মধ্যে প্রথম মোলাকাতের দিনে শিকারে যাওয়া হবে এবং সেই সুযোগে রণনীতিও ঠিক হবে। যদি ঠিক হয় বীজাপুরের দিকে যাওয়া হবে তাহলে তো হয়েই গেল, না হলে গোলকুণ্ডার দিকে যাওয়া হবে।
৬। বীজাপুরী অভিযানে মীর জুমলার ভূমিকা
১৮ জানুয়ারি মীর জুমলা আহমদনগরে পৌঁছেই, সেই দিন আওরঙ্গজেবকে নিয়েই বীজাপুরের দিকে যাত্রা করার সিদ্ধান্ত নিলেন।বিপুল আস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত সাঁজোয়া বাহিনীর গতি খুবই ধীর ছিল। ২৮ ফেব্রুয়ারি আন্দুরে পৌঁছে ওয়ালি মহলদার খানকে সেখানের সরবরাহ আর রাস্তার সুরক্ষার জন্য রেখে বিদর দুর্গের কাছে গিয়ে শিবির গাড়লেন।
প্রায় দুর্ভেদ্য বিদর দুর্গ দখল করা দাক্ষিণাত্য এবং কর্ণাতক দখলের অন্যতম প্রধান চাবিকাঠি। সেটির নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন প্রবীন কিলাদার সিদ্দি মারজান, ছিল ১০০০ ঘোড়সওয়ার আর ৪০০০ গোলান্দাজ, তুফাং চি, হাউইদার এবং তোপান্দাজ। তিনি কেল্লার সুরক্ষা এবং আক্রমণের রণনীতি নিশ্চিত এবং কেল্লায় ঢোকা বেরোনো নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন। আওরঙ্গজেবের সঙ্গে মীর জুমলা দুর্গ নিরীক্ষণ করলেন এবং বাইরে পরিখা(মালছার) কাটা দেখলেন। দুর্গ থেকে নিরন্তর গোলাগুলি চললেও সেই পরিখা ভর্তি করে, দুদিনের মধ্যে কামানগুলি বসাতে সক্ষম হলেন মীর জুমলা এবং তাদের এই কাজে সমুচিত জবাব দিতে থাকল মুঘল বাহিনী। আক্রমন প্রতিআক্রমণে মুঘল বাহিনীর দিকে পাল্লা ভারি হতে থাকল। শেষে মুঘলেরা তাঁদের দুটি কামান ধ্বংস করে, বাইরের দিকের দেওয়ালের নিচের অংশ দুর্বল করে দিতে সক্ষম হয়। ২৯ মার্চ ১৬৫৭ সালে মহম্মদ মুরাদের নেতৃত্বে বানহিনী মীর জুমলার মালছারের উল্টোদিকের দেওয়াল বেয়ে দুর্গ বুরুজে উঠতে সক্ষম হয়। মীর জুমলার বাহিনীর ছোঁড়া হাউইয়ের স্ফুলিঙ্গ বারুদের গুদামে পড়ে বিষ্ফোরণে সিদ্দি আহত হন এবং দুর্গ মুঘলদের হাতে তুলে দেন।
বিদর দখল হওয়ার পরে মহবত খানকে পাঠনো হল বীজাপুর লুঠ আর ছারখার করতে এবং মুঘল বাহিনীর জন্য পথ উন্মুক্ত করতে।২৭ এপ্রিল বিদর থেকে রওনা হয়ে ৩ মে ৪০ মাইল দূরে মীর জুমলা আওরঙ্গজেবের সঙ্গে মিলিত হলেন ৩ মে কল্যাণীতে। ঐদিনই তারা দুর্গের নিরাপত্তা ঘুরে দেখলেন এবং তাঁদের ওপর নিরন্তর গোলাগুলি চললেও, তারা তারা পরিখা উন্নত(ভর্তি) করে দমদমা(বড় ব্যাটারি) রেখে যে কোন উপায়ে দুর্গে পৌছতে দৃঢ সংকল্প করলেন। মুঘলদের প্রত্যাঘাতে শত্রুর প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হল। তাঁদের ছোঁড়া টপ আর তুফাং মুঘল সেনানীদেরও প্রচুর ক্ষতি সাধন করল। রাতে পরিখাটি আরও ভরে ফেলার কাজ চলল। ২৩ মে পরিখার ২/৩ অংশ ভরে গেল এবং দুর্গটি দখলে আসা এখন সময়ের অপেক্ষা। বীজাপুরীরা আক্রমণকারীদের নজর তখন ঘুরয়ে দেওয়ার জন্য ব্যস্ত। মুঘল শিবিরের ৪ মাইল দূরে যখন ৩০০০০ বিজাপুরী সেনানী আক্রমণ করতে উপস্থিত, ২৮ মে আওরঙ্গজেব দুর্গের সামনে তাঁবুতে পর্দা ফেলে দিয়ে তাদের দিকে আগ্রসর হলেন। মীর জুমলা, নাজাবত খান, সুজন সিং বুন্দেলা, দিলির খানের নেতৃত্বে মুঘল বাহিনী ভালোলের নেতৃত্বাধীন আদিলশাহী বাহিনীর মুখোমুখি হল। প্রচণ্ড যুদ্ধ চলল। চতুর আদিলশাহী বাহিনী সব দিক থেকে মুঘল বাহিনীকে আক্রমন করেও হঠাতে পারল না। উল্টোদিকে মুঘল অশ্বারোহীরা প্রচণ্ড বেগে বিপক্ষকে আক্রমন করল। ইতিমধ্যে মীর জুমলার সঙ্গে শাহ নাওয়াজ খান, রাও ছত্রশাল, শামসুদ্দিন খোয়েসগি এবং মহাবত খান শত্রুকে চারপাশ থেকে নিপুণ আক্রমন করে পর্যুদস্ত করে ফেলল।
দুর্গের সামনে যে খনন করা পরিখা ভর্তি হয়েছে সেটি সুরক্ষার শর্ত হল সেখানে মুঘলদের অন্তত সন্ধ্যার সময়ে ফিরে যেতে হবে। কিন্তু ততক্ষণে বিপক্ষ শুকনো গাছপালা দিয়ে ভর্তি করা পরিখা ন্যাপথা, বারুদ ইত্যাদি দিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছে। তাই নতুন করে আবার পরিখা বোজানোর কাজ শুরু হল। ২২ জুলাই ১৬৫৭ মীর জুমলা, নাজাবত খান, রাও ছত্রশাল, মির্জা সুলতান এবং দিলের খানের সঙ্গে তার বড় পুত্রকে পাঠালেন আদিলশাহী বাহিনীকে পরাস্ত করতে। তাদের প্রতি নির্দেশ ছিল তারা শত্রুর প্রতিরোধ এমনভাবে গুঁড়িয়ে দেবে যাতে তারা না উঠে দাঁড়াতে না পারে। ৪৮ মাইল গিয়ে মুঘল বাহিনী শত্রুর পতাকা দেখতে পেয়েই আলোর গতিতে এমনভাবে শত্রুব্যুহে ঢুকে গিয়ে আক্রমন করল যে শত্রুকে পিছিয়ে যেতে হল; তাতেও রক্ষা নেই, তাদের ৪ মাইল ধাওয়া করে খতম করল। ফেরার সময় তারা রাস্তার দুপাশে সমস্ত এলাকা লুঠ করে পুড়িয়ে দিয়ে দিনের শেষে কুলবর্গার কসবায় পৌছে শুধু সাধু সঈদ গিসে দারাজের মাজারটিকে বাদ দিয়ে লুঠের ঝাড়ু হাতে যেন সারা দেশ সম্পদ শূন্য করে দিল।
শেষে পরিখাটি পাথর আর কাদা দিয়ে পূর্ণ করে মীর জুমলার গোলান্দাজ বাহিনী বিপক্ষের সুরক্ষা কবচ ধ্বংস করে দেয় এবং ২৯ জুলাই আক্রমণকারীরা দুর্গের প্রাকারে উঠে বুরুজ দখল করে নেয়। ৩১ জুলাই দুর্গ রক্ষক দিলাওয়ার হাবসি আত্মসমর্পণ করে এবং ১ আগস্ট তিনি তাদের দুর্গের চাবি তুলে দেন।
সম্রাট আওরঙ্গজেব এবং অন্যান্য সেনানায়ককে উপযুক্তভাবে উপঢৌকন দেন। মীর জুমলাকে বিশেশ আংরাখা দিয়ে সম্মান জানিয়ে তার জন্য কর্ণাটক রাজ্যের ৪ কোটি দামের রাজস্বওয়ালা কয়েকটি মহলের অধীশ্বর(মহলইওয়ালিয়ত) বানানো হয়।
(চলবে)
No comments:
Post a Comment