জগদীশ নারায়ণ সরকার
৬। পারেন্দা থেকে মীর জুমলার পশ্চাদপরণ
বীজাপুরী সম্ভাব্য আক্রমণের খোরাক হয়ে, শাহজাদার সঙ্গে দুর্গের বাইরে পরিখার ধারে ঘাঁটি গেড়ে থাকা সুবুদ্ধির কর্ম নয় বুঝেই আওরঙ্গজেব, সীমান্ত নির্ধারণের কাজ আগামী দিনে কোন এক সময়ের জন্য মুলতুবি করে মীর জুমলাকে পশ্চাদপসরণের নির্দেশ দিলেন। মীর জুমলাকে প্রলুব্ধ করতে আওরঙ্গজেব প্রস্তাব দিলেন কুতুব শাহের কবল থেকে কাম্বাম দখল করতে একট আভিযানের। যদি মনে হয়, মীর জুমলা মহম্মদ সুলতানকে আহমদনগর পাঠিয়ে দিয়ে কয়েকদিন সেখানে তাকে বসিয়েও রাখতে পারেন।
অন্যদিকে মীর জুমলা আওরঙ্গজেবকে পালটা প্রস্তাব দিলেন(১৮ নভেম্বর) তার সঙ্গে যোগ দিয়ে বীজাপুরীদের শায়েস্তা করতে। আওরঙ্গজেব বললেন, খান মহম্মদের হত্যার কারণ দেখিয়ে এক্ষুনি তাদের শাস্তি দিতেই পারি, সেটা তাদের জন্য বাকিও আছে, কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে তার সেখানে যাওয়া ঠিক হবে না বলেই মত প্রকাশ করলেন। জীবিত থাকা কালীন খান মম্মকদ আমায় বলেছে, যে বীজাপুরীরা বিশ্বাসঘাতক এবং মিথ্যাচারী। মুল্লা আহমদ সারা বছর ধরে আপ্রাণ চেষ্টা করেছে, কিন্তু সে সফল হয়নি। এটা এই মুহূর্তে সফল হওয়ার নয়। সেনারা সম্রাটের স্বাস্থ্য ভাঙ্গার খবরে এবং অন্যান্য ঘটনায় হতোদ্যম হয়ে পড়েছে। তারা এতই গোলযোগে পড়ে রয়েছে যে সেটা ব্যখ্যার অতীত। তিনি তাই মীর জুমলাকে বললেন বীর থেকে এই নষ্ট ঘটনায় সময় ক্ষয় না করে সেই মুহূর্তেই ফিরে আসুন।
তার চিঠির উত্তর পাওয়ার জন্য পান্দেরায় অপেক্ষা করে থেকে থেকে মীর জুমলা বীরের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন মহম্মদ সুলতানকে সংগে নিয়ে। ২৬ নভেম্বরের শাহজাদার চিঠিতে এই সংবাদ পেয়ে লিখলেন, কিছু দিন বীরে থেকে যেতে, যদি তিনি অভিযান শুরু করে থাকেন, আর যদি না করেন তাহলে পারেন্দাতেই এক পক্ষকাল শাহজাদাকে নিয়ে অপেক্ষা করতে।
মীর জুমলার চিঠির উত্তরে সাঙ্কেতিক ভাষায় আওরঙ্গজেব লিখলেন, অসম্ভব মানসিক যন্ত্রণায় তিনি কাটাচ্ছেন এবং কেন মীর জুমলার তার সঙ্গে অবিলম্বে যোগ দেওয়া দরকার সেটাও জানালেন, না হলে তিনি হয়ত সিংহাসন দখলের সুযোগটাই হারাবেন(ইতোমধ্যে সম্রাটের মারা যাওয়ার খবর আসে) যদি বীজাপুর সমস্যা তাদের দুজনকে আরও দীর্ঘকাল ব্যস্ত রাখে আর তার ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সেনাবাহিনীকে তিনি একত্র না করতে পারেন।
৬ ডিসেম্বর নাগাদ পারেন্দা থেকে আওরঙ্গজেব মহম্মদ সুলতানকে ডেকে নেন, বুরহানপুরের জমিদারদের দমন করতে এবং নর্বদা পর্যন্ত এলাকাকে বিদ্রোহী মুক্ত করতে। শাহজাদা মহম্মদ মুয়াজ্জমের সঙ্গে সেনাবাহিনীর একটি অংশ দিয়ে পারেন্দায় পাঠালেন এবং মীর জুমলাকে বললেন বীরে তার সঙ্গ দিতে, যাতে বীজাপুরীদের সবক শেখানো যায়। এখানে মধ্য ডিসেম্বরে মীর জুমলা আওরঙ্গজেবের সচিবের সঙ্গে তিনিটি গোপন বৈঠক করেন।
৭। মীর জুমলাকে দরবারে ডেকে পাঠানো হল
৬ নভেম্বরের মহম্মদ আমীন খানের পাঠানো চিঠির সূত্রে মীর জুমলা ইঙ্গিত পেয়ে গিয়েছিলেন, যে দারা তার বিরুদ্ধে দরবারে ঘুঁটি সাজাচ্ছেন এবং এই বিষয়ে তিনি তার পুত্রকে চিঠি লেখার আগে আওরঙ্গজেবের পরামর্শ চেয়ে পাঠান। ৯ নভেম্বরের চিঠিতে আওরঙ্গজেব লিখলেন, অজ্ঞকে প্রজ্ঞা শেখানো যায় না। তাকে কিভাবে আঘাত করবে তা তোমার নিজস্ব প্রজ্ঞার ওপর নির্ভর করবে। বড় শাহজাদা(দারা)র নির্দেশের প্রেক্ষিতে তোমার দীর্ঘকালের সঞ্চিত প্রজ্ঞার ওপর নির্ভর করে একটি সুদীর্ঘ ভূমিকা লিখে তার সাজানো মিথ্যাকে খণ্ডন কর। তুমি যা মনে করে সেটাই লেখ।
কিন্তু মীর জুমলা দারার চাল নিষ্ফল করতে পারলেন না। ডিসেম্বর ১৬৫৭র শুরুতেই মুরাদ এবং সুজার সঙ্গে আওরঙ্গজেব হাত মিলিয়েছেন এই খবর দারার কাছে ছিল, শাহজাহানের নাম নিয়ে দারা দাক্ষিণাত্য থেকে মীর জুমলা এবং সেনাপতিদের ডেকে পাঠালেন কেননা তাদের বেশি দিন দাক্ষিণাত্যে থাকা আওরঙ্গজেবের সেনা সাজানোয় সাহায্য করবে এবং তার ভবিষ্যতের পক্ষে আশংকার হবে। ১৯ তারিখ এই ফরমানটি হাতে পেলেন আওরঙ্গজেব। এটি আওরঙ্গজেবকে হতাশার সর্বনিম্ন অতলে ছুঁড়ে ফেলে দিল। মীর জুমলার দাক্ষিণাত্য থেকে প্রস্থান তার পক্ষে সব থেকে অমঙ্গলজনক ইঙ্গিত যেমন, তিনি একই সঙ্গে খবর পাচ্ছেন, দারা সুজার বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়ী হচ্ছে। তবে তার সব থেকে বড় সাথী মীর জুমলার দাক্ষিণাত্যে থাকাটা খুব জরুরি বলেই মনে করলেন। ২২ তারিখ হতাশ সুবাদার মীর জুমলাকে একটা চিঠি লিখলেন নিজের হাতে, সাম্রাজ্যের মন্ত্রীকে বন্ধু সম্বোধন করে, সর্বশক্তিমান তোমায় সাহায্য করুণ! আমার নিজের অশান্তি নিয়ে কি আর বলব! আমি জানি দিন কিভাবে কেটে যাচ্ছে! আমার হাতে কোন নিদান নেই। ধৈর্য ধর!
৮। মীর জুমলাকে গ্রেগতার করলেন আওরঙ্গজেব
অবশেষে আওরঙ্গজেব নিজেকে ফিরে পেলেন। অভিজ্ঞ, দক্ষ, বুদ্ধিমান, কুশলী, কূটনীতিতে দক্ষ, অভিজ্ঞ সেনানায়ক, এবং সব থেকে বড় কথা বিপুল ঐশ্বর্যের অধিকারী মীর জুমলা যদি ক্ষমতায় থাকা শাহজাদার সঙ্গে যোগদেন, সেটা তার পক্ষে হবে সব থেকে বড় দুর্ভাগ্য আর অভিশাপের কারণ। ফলে দাক্ষিণাত্যের সুবাদারকে সক্রিয় হয়ে শাহজাদার শেষতম অভিসন্ধি বিফল করতে মাঠে নামতেই হল। আওরঙ্গজেব জুমলাতউলমুলক মীর জুমলাকে মহম্মদ মুয়াজ্জমকে নিয়ে বীর ছাড়তে নির্দেশ দিলেন ২৭ ডিসেম্বর। কিন্তু বলে দিলেন, তার সঙ্গে দেখা না করে যেন কেউই দিল্লির পথ না ধরেন। তার জীবনের সব থেকে খোশামুদে চিঠি লিখলেন আওরঙ্গজেব মীর জুমলাকে – তাকে বললেন সব থেকে বড় বন্ধু, আত্মনিবেদনকারী শুভচিন্তক, এবং তার প্রজ্ঞার প্রতি তার আসীম সম্মান রয়েছে। আমি জানি তুমি নিজের কথার ওজনকে সব থেকে বেশি গুরুত্ব দাও। তোমার হিন্দুস্তানে যাওয়া যে আমার ক্ষমতা, শক্তি এবং শৌর্য বাড়াবে তাই নয়, তোমার সফলতা আমার সফলতারূপে চিহ্নিত করবে। আমার হৃদয়ের শুভেচ্ছা রইল। তুমি সাক্ষাতে প্রায়ই বলতে তোমার জীবনে তুমি আমায় সিংহাসনে বসা দেখতে চাও, এবং সেই লক্ষ্য পূরণে তোমার জীবন তোমার সম্পদ সব উতসর্গীকৃত। এখন সময় এসেছে তোমার নিজের কথাকে নিজের নিবেদনকে সত্য প্রমান করার। যতক্ষণ তুমি জীবিত রয়েছে, ততক্ষণ আমি আমার জীবনে কাউকে এত গুরুত্ব দিই না। তোমার প্রতি ভালবাসা, পক্ষপাত দেখাতে কেউ আমায় রুখতে পারবে না। আমার কাছে এস। তোমার পরামর্শক্রমে আমি সিংহাসনের পথে অগ্রসর হওয়ার পরিকল্পনা রচনা করব।
১৬৫৮ সালের ১ জানুয়ারি মীর জুমলা আহমদনগরে পৌঁছলেন। অবিলম্বে তিনি তাকে গ্রেফতার করে দৌলতাবাদ কারাগারে বন্দী করলেন। তার সব সম্পত্তি, ইওরোপিয়দের ব্যবস্থাপনায় রাখা গোলাবারুদ এখন আওরঙ্গজেবের কবলে পড়ল। যে সময় তার প্রচুর সম্পদ দরকার, সেসময় মীর জুমলার সম্পত্তি তার হাতে এসে পড়ায়, তার লক্ষ্য পূরণ সহজ হয়ে গেল।
(চলবে)
No comments:
Post a Comment